সহজ গল্পের দারুণ নির্মাণ ‘ইতি চিত্রা’
প্রতিদিন চিঠি লেখেও চিত্রা। তবে সে চিঠি এসে পৌঁছায় না মাসুকের হাতে …
গ্রামের গল্প। প্রেমের গল্প। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে নব্বইয়ের দশক। প্রায় তিন দশকের অতীত থেকে ‘ইতি চিত্রা’র কাহিনি তুলে এনেছেন নির্মাতা অনিক। গল্প যখন উল্টো দিকে হাঁটে, তখন তার অনুষঙ্গও বদলে যায়। ফলে চরিত্রদের হাতে স্মার্টফোন নেই, সার্বক্ষণিক যোগাযোগ নেই। আছে শুধু অপেক্ষা। লোকচক্ষু এড়িয়ে প্রিয় মানুষটির মুখের হাসি দেখার, তার কথা শোনার, কাছে থাকার যে দীর্ঘ অপেক্ষা ও অস্থিরতা; সেটা এই অনলাইনের যুগে এসে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা শক্ত। অথচ সে অপেক্ষাই ইতি চিত্রা সিনেমার প্রধান আবেগের জায়গা।
মেহেরপুরের এক গ্রামের কলেজপড়ুয়া দুই তরুণ-তরুণী মাসুক ও চিত্রা। তারা পরস্পরকে ভালোবাসে। চিত্রা রোজ বিকেলে গাছতলায় অপেক্ষায় করে, মাসুক ওদিকে খেজুরগাছে উঠে পেড়ে আনে রসের হাঁড়ি। সাইকেলের প্যাডেল ঘুরিয়ে পৌঁছে যায় চিত্রার কাছে। গোধূলির অস্তায়মান সূর্যকে পেছনে রেখে, খেতের সরু আইল ধরে ছুটে চলে চিত্রা, পেছন পেছন মাসুক। চিত্রাকে সে উপহার দেয় প্রিয় কোনো বই। তবে তাদের এই প্রেমপর্ব বেশি দিন নির্বিঘ্নে চলে না। কোচিংয়ের জন্য চিত্রাকে যেতে হয় শহরে। পরিবারের অসচ্ছলতার জন্য গ্রামেই থেকে যেতে হয় মাসুককে। দুজনের মাঝখানে ঘনিয়ে আসে দূরত্ব।
শহরে যাওয়ার আগে চিত্রা কথা দিয়ে যায় মাসুককে, ‘আমি প্রতিদিন তোকে একটা করে চিঠি লিখব।’ প্রতিদিন চিঠি লেখেও চিত্রা। তবে সে চিঠি এসে পৌঁছায় না মাসুকের হাতে। চিত্রার চিঠির অপেক্ষা করতে থাকে মাসুক। অন্যদিকে চিত্রাও অপেক্ষায় থাকে চিঠির জবাবের। কিন্তু ফিরতি চিঠি তো আসে না। তাদের সব চিঠি মাঝখান থেকে গায়েব করে দিতে থাকে কেউ। মাসুক ও চিত্রার মধ্যে ভুল-বোঝাবুঝি বাড়তে থাকে। সেটা তাদের সম্পর্ককে নিয়ে যায় জটিল পরিণতির দিকে।
ইতি চিত্রা সিনেমার সবচেয়ে দুর্বল জায়গা এর চিত্রনাট্য ও সংলাপ। খুব সাধারণভাবে এগিয়েছে গল্প। সংলাপ অত মনকাড়া নয়। মাঝেমধ্যে বিস্ময়কর কোনো টুইস্ট এসেও নাড়া দিয়ে যায় না। ফলে সহজেই অনুমান করে নেওয়া যায়, এরপর কী ঘটতে যাচ্ছে। তবে এই সাধারণ গল্পকে অনেকটাই অসাধারণ করে তুলেছে চিত্রায়ণ ও সংগীত। চিত্রগ্রাহক ফরহাদ হোসেন তাঁর ক্যামেরায় যেভাবে গ্রামের সৌন্দর্য ধরেছেন, তা সত্যিই ইতি চিত্রাকে অনেকখানি এগিয়ে দিয়েছে। আর চিত্রনাট্যের খামতি অনেকটা পুষিয়ে দিয়েছে অধ্যয়ন ধারার আবহসংগীত।
মাসুক চরিত্রে ইভন স্বতঃস্ফূর্ত ছিলেন আগাগোড়া। তবে তাঁর চরিত্রকে এতটা গাম্ভীর্যের চাদরে ঢেকে না দিলেই পারতেন নির্মাতা। তাতে চরিত্রটির সঙ্গে দর্শক আরও একাত্ম হতে পারতেন। চিত্রা হিসেবে শুরুর দিকে ঋতু অতটা সপ্রতিভ ছিলেন না। শেষের দিকে, বিশেষ করে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর সংগ্রামের দিনগুলোতে তাঁর অভিনয় মনে রাখার মতো। মাসুকের বাবার চরিত্রে নরেশ ভুঁইয়ার অভিনয়ও আবেগপ্রবণ করে তুলবে। ইতি চিত্রা নির্মাতা রাইসুল ইসলাম অনিকের প্রথম সিনেমা। সিনেমা হলে ব্যাপক ভিড় আনতে না পারলেও, তাঁর প্রথম কাজে বোঝা গেল, ভালো কিছু করার বিস্তর সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে তাঁর মধ্যে। শুধু সময় ও সুযোগের অপেক্ষা।
*লেখাটি আজকের পত্রিকায় পূর্ব প্রকাশিত