সাকিনা সারোয়ার: ঢাকাই টেলিভিশনের প্রথম যুগের স্মরণীয় মুখ
১৯৬০ এর দশকের ঢাকার পাকিস্তান টেলিভিশন (পিটিভি) বা বর্তমান বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি)-র পরিচিত মুখ ছিলেন সাকিনা সারোয়ার। অনুষ্ঠান প্রযোজনা থেকে অভিনয় বা অনুষ্ঠান ঘোষক মিলিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন তৎকালীন সেলিব্রিটি।
সাকিনার বাবা ব্যবসায়ী ও মা চিকিৎসক। দুজনই খুলনার বাসিন্দা হলেও দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে তারা স্থায়ী হন ঢাকায়। সাকিনার পড়াশোনা মুনিজা রহমান গার্লস হাই স্কুলে। এরপর ইডেন গার্লস কলেজ থেকে বিএসসি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএড ডিগ্রি নেন। এরপর স্থানীয় কলেজে উদ্ভিদবিদ্যার শিক্ষক হিসেবে যোগদানের আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভিদবিদ্যায় এমএসসি পড়তে শুরু করেন।
শুরুতে তিনি ভয়েস অব আমেরিকা রেডিওতে ব্রডকাস্টার হিসেবে যোগ দেন। তখন ঢাকায় অনুষ্ঠান রেকর্ড করে প্রচারের জন্য জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়। এরপর টেলিভিশনে প্রযোজক হিসেবে যোগ দেন। কিন্তু তার ভূমিকায় এখানেই সীমিত থাকেনি।
যোগদানের পরপরই প্রশিক্ষণের জন্য রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তান টিভিতে যান। ঢাকায় ফিরে এসে সিনিয়র প্রোগ্রাম প্রডিউসার হিসেবে পদোন্নতি পান।
১৯৬৬ সালে রাওয়ালপিন্ডি থেকে প্রচার হয় প্রথম বাংলানাটক ‘নেপথ্যের নায়িকা’। সেটা ছিল খ্যাতিমান বিটিভি প্রযোজক আতিকুল হক চৌধুরীর লেখা একমাত্র বেতার নাটক। সেখানে নায়ক ও খলনায়ক চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন প্রথিতযশা দুজন বিটিভি প্রযোজক বরকত উল্লাহ ও নওয়াজিশ আলী খান এবং তাদের বিপরীতে নায়িকা চরিত্রে ছিলেন সাকিনা সারোয়ার।
একই বছর সালে সাকিনা সারোয়ার প্রথম ঢাকা কমার্শিয়াল এনাউন্সারের কাজ করেন। ওই সময় মাসুমা খাতুনের অনুপস্থিতিতে উপস্থাপক মোডি কোহেনের অনুরোধে মূল অনুষ্ঠান ঘোষণার হাতেখড়ি নেন।
সাকিনা সারোয়ার প্রযোজিকা হিসেবে ছিলেন আলোচিত। শুধুমাত্র নারীশিল্পীদের অংশগ্রহণে যন্ত্রসঙ্গীতের অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। ৭০ দশকে ছোটদের জন্য দুটো অনুষ্ঠান প্রযোজনা বিশেষভাবে খ্যতি অর্জন করেন সাকিনা—ফেরদৌসী রহমানের সঞ্চালনায় ‘এসো গান শিখি’ এবং লায়লা হাসানের নাচ শেখার অনুষ্ঠান ‘রুমঝুম’। ১৯৭৮ সালে গীতি-নৃত্য-নাট্য, বীরাঙ্গনা সখিনা’সহ বেশকিছু সাপ্তাহিক নাটক প্রযোজনা করে সুখ্যাতি অর্জন করেন।
৭০ দশকের শেষের দিকে শিশুদের জন্য শিক্ষামূলক একটি জনপ্রিয় অনুষ্ঠানের নাম ছিল ‘ক আর খ’। সুন্দর উপস্থাপনা, নিপুণ পরিচালনা, বিশেষ করে সাইদুল আনাম টুটুলের কণ্ঠে পাপেটের মজার মজার কথাগুলো বাচ্চাদের খুব আনন্দ দিতো। নাজমা চৌধুরীর উপস্থাপনা ও সাকিনা সারোয়ারের প্রযোজনায় নির্মিত সেই অনুষ্ঠান জাপানে ১৯৭৭ সালে বিশেষ পুরস্কার লাভ করে। সেই প্রথম আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পুরস্কারের খ্যতি অর্জন করেন সাকিনা। সেই অনুষ্ঠানে শিশুশিল্পী তারানা হালিমের অসাধারণ পারফরম্যান্স অনেক দর্শকদের মনে আজো গেঁথে আছে।
শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, ওস্তাদ আলী আকবর খান, ভূপেন হাজারিকাসহ অনেক প্রথিতযশা শিল্পীদের অংশগ্রহণে সঙ্গীতানুষ্ঠান পরিচালনা করে দর্শকদের কাছে স্মরণীয় হয়ে আছেন একজন সাকিনা সারোয়ার। ১৯৮৮ সালে শিল্পী সুবীর নন্দী ও সঙ্গীত পরিচালক শেখ সাদী খানের অংশগ্রহণে ‘গানগুলি মোর’ প্রযোজনা করে বিটিভি থেকে বিদায় নেন সাকিনা। তারপর থেকেই তার প্রবাস জীবনযাপন শুরু, আবার বেছে নেন শিক্ষকতা।
এ বিষয়ে তিনি বলেন, আমার সন্তানরা তাদের বাবার অভাব অনুভব করে বলে অবশেষে স্বামীর সঙে্গ যোগ দিতে ইংল্যান্ডে চলে যাই। এটি একটি কঠিন সিদ্ধান্ত ছিল, কিন্তু আমার কাজের প্রকৃতির কারণে, আমার ক্যারিয়ারের পাশাপাশি আমার সন্তানদের জন্য সময় দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছিল। যাইহোক, আমি কিছুতেই আফসোস করি না। আমি ছেলে-মেয়ে উভয়কেই তাদের শিক্ষার মাধ্যমে দেখেছি এবং উভয়েই আমার মতো একই কর্মজীবনের পথ অনুসরণ করেছে।
বিটিভির সাদাকালো থেকে রঙিন যুগের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে সাকিনা সারোয়ারের নাম। ডিআইটি ভবন থেকে অভিযাত্রা শুরু করে রামপুরা পর্যন্ত – ছোটদের অনুষ্ঠান, নৃত্যানুষ্ঠান, সংগীতানুষ্ঠানসহ বেশকিছু সৃজনশীল কাজ করে সমাদৃত হয়েছেন। সেই ধারা এখনো অনুসরণ করছে বিটিভি।
গত ১ ডিসেম্বর ইংল্যান্ডের বার্মিংহামে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সোনালী দিনের এই টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব।
তথ্য ও ছবি: বিবিসি ও কাজল রিপনের ফেসবুক পোস্ট / সব তথ্য যাচাইকৃত নয়।