Select Page

সাদাত হোসাইনের রিভিউতে ‘প্রিয়তমা’ ও ‌’সুড়ঙ্গ’

সাদাত হোসাইনের রিভিউতে ‘প্রিয়তমা’ ও ‌’সুড়ঙ্গ’

জনপ্রিয় লেখক ও নির্মাতা সাদাত হোসাইন সম্প্রতি দেখেছেন ঈদুল আজহার দুই সিনেমা— হিমেল আশরাফ পরিচালিত ‘প্রিয়তমা’ ও রায়হান রাফীর ‘সুড়ঙ্গ’। ফেসবুকে শাকিব খান ও আফরান নিশো অভিনীত ছবি দুটির রিভিউ করেছেন তিনি। তবে পড়ে নিন।

অন্য’ শাকিবে ‘অনন্য’ সম্ভাবনা…

অনেক আগে কৌতূহল থেকেই শাকিব খানের সিনেমা দেখতে শুরু করেছিলাম। পরপর বেশ কয়েকটা।  সেই কৌতূহলের কারণ তার অভিনয় নিয়ে নানাবিধ তির্যক মন্তব্য, অদ্ভুত সব ভাইরাল সংলাপ এবং গল্প নিয়ে চারপাশের তুমুল হাস্যরস ও সমালোচনা। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, সেই সময়ের সিনেমা দেখেও আমার মনে হচ্ছিল, তিনি ভালো অভিনেতা। তার কেবল এই সময়ের সিনেমার ভাষা, গল্প ও ন্যারেটিভ সম্পর্কে সচেতন – এমন পরিচালক দরকার। পরে সুভা ও সত্তা দেখে সেই ভাবনা আরও পোক্ত হয়েছে।

অন্য সকল শিল্প মাধ্যমের তুলনায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবচেয়ে বেশি বদলায় সিনেমায় গল্প বলার ধরন। কারণ, এই ধরনের  সঙ্গে সিনেমার প্রেজেন্টেশন বা ভাষা জড়িত। আর এই প্রেজেন্টেশন ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত প্রযুক্তির সঙ্গে। ফলে প্রযুক্তি বদলালে তা যেমন মানুষের সামগ্রিক জীবন ব্যবস্থায় ম্যাসিভ পরিবর্তন ঘটায়। নতুন নতুন গল্প তৈরি করে। তেমনি তা সিনেমার গল্প (সিনেমা যেহেতু সময়/জীবনকে ধারণ করে) ও গল্প বলার ধরনকেও অনিবার্যভাবে প্রভাবিত করে। 

কিন্তু  প্রযুক্তি নিজেতো আর গল্প বলতে পারে না। একটা ক্যামেরা কখনো ছবি তুলতে পারে না, যদি না তাতে কেউ ক্লিক করেন। ভালো ছবি ওঠাতে পারে না যদি না কেউ তাতে প্রোপার লাইট, কম্পোজিশন ঠিক না করে দেন। তা যত দামি ক্যামেরাই হোক না কেন। অর্থাৎ ভালো ছবির জন্য ভালো ক্যামেরার চেয়েও ভালো ফটোগ্রাফার বেশি দরকার। একইভাবে সিনেমার প্রযুক্তিও যতই উন্নত হোক না কেন, সে নিজে নিজে কখনো সময়ের টেক্সচার বা সমকালকে ধরতে পারে না, যদি না  তা যারা ব্যবহার করেন, তারা তা ধরতে না পারে। 

এই জায়গাটিতেই সম্ভবত সংকটটা রয়ে গিয়েছিল। নাহলে দামি ক্যামেরা ও উন্নত প্রযুক্তির সকল অনুষঙ্গ থাকার পরও আমাদের এফডিসি কেন্দ্রিক পরিচালকদের ‘বাণিজ্যিক’ সিনেমায় সময়ের গল্প, সমকালীন জীবন ও ভাষা এবং  আধুনিক উপস্থাপনা বছরের পর বছর অনুপস্থিত থাকত না!

সেই জায়গাটিতে সম্ভবত পরিবর্তন আসছে। এমন নয় যে ‘প্রিয়তমা’ নামের চলচ্চিত্রটি দেখে আমি সীমাহীন মুগ্ধ হয়েছি, কিংবা এর গল্প আমাকে বিপুল বিস্ময় উপহার দিয়েছে! কিন্তু এই সিনেমা আমাকে এই বার্তা দিয়েছে যে বাংলা চলচ্চিত্রের এই সময়ের সবচেয়ে বড় সুপারস্টারকে নিয়ে যে ধরনের ‘ক্রিটিসিজম’ (অভিনেতা হিসেবে) হয়, তা তার প্রাপ্য নয়। বরং উল্টোটাই হওয়ার কথা ছিল। সকল শ্রেণীর দর্শকের কাছ থেকেই শ্রদ্ধা না হলেও অন্তত সমীহ তার প্রাপ্য ছিল। তাহলে সেটি তিনি কেন পেলেন না?

এই দায় সম্ভবত যতটা না তার, তারচেয়েও অনেক বেশি সেই ক্যামেরার পেছনে থাকা মানুষদের। এখানে একটু উল্লেখ করতে চাই, শৈশবে আমাদের কাছে যারা বাংলা সিনেমার হিরো ছিলেন (আমি সঙ্গতকারণেই নাম উল্লেখ করছি না) , এখন, আজকাল সেইসব নায়কদের সিনেমা দেখে হয়তো আমরা অনেকেই হাসাহাসি করি, ঠাট্টা মশকরা করি। এমনকি ফেসবুকেও প্রায়শই তাদের সে সময়ের সিনেমার বা গানের নানান ক্লিপ নিয়ে তুমুল ট্রল করতে দেখা যায়। বিষয়টা কি এমন যে সেসব সিনেমা আদতেই এখন যেমন মনে হয়, তখনও তেমনই মনে হতো? নাকি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সিনেমা দেখার চোখ বদলেছে? হয়তো তা-ই। কারণ বিশ্বব্যাপী  সিনেমার ভাষা ও গল্পের ধরন পাল্টেছে। একইসঙ্গে খুব সহজেই সেসব দেখার সুযোগও হচ্ছে সবার। ফলে তুলনার জায়গাও তৈরি হচ্ছে। দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে। কিন্তু তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের এফডিসি কেন্দ্রিক ‘বাণিজ্যিক’ সিনেমার পরিচালকরা কতটা বদলেছেন?

‘মেইনস্ট্রিম চলচ্চিত্রের’ পরিচালকরা যদি নিজেদের নবায়ন না করে সেই পুরনো ধ্যান ধারণা , গল্প, সংলাপ নিয়েই বছরের পর বছর একই ফর্মুলায় ছবি তৈরি করে যান, তবে তা কীভাবে অভিনেতাদের পরিবর্তন নিশ্চিত করবে?

একটা নাম উল্লেখ করি। পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত অভিনেতা প্রসেনজিৎ চ্যাটার্জির তৎকালীন অনেক ‘বাণিজ্যিক” ধারার ছবি দেখলে এখনও আমি মেলাতে পারি না যে এই এখনকার প্রসেনজিৎ আর তখনকার প্রসেনজিৎ ,মূলত একই অভিনেতা! আকাশ পাতাল তফাৎ। কারণ? কারণ, গল্প বদলেছে, সিনেমার ন্যারেটিভ পাল্টেছে, পরিচালকদের ধ্যান ধারনা পাল্টেছে। ফলে তিনিও পাল্টেছেন।

‘প্রিয়তমা’ সিনেমা দেখে এসে ধান ভানতে যেন শিবের গীত গাইছি। কেন গাইছি, তা এবার বলছি। একটি ‘বাণিজ্যিক’ সিনেমা হিসেবে প্রিয়তমায় যে অভিনেতা শাকিব খানকে আমি দেখেছি, তাকে আমার ঠিক অতোটাই সম্ভাবনাময় মনে হয়েছে। এ যেন সেই লাউড এক্টিং ছেড়ে সংযত, পরিমিত, অন্য এক শাকিব খান। এই শাকিবে সম্ভাবনা অপার। তবে সেই সম্ভাবনার সলতে-তে আগুন জ্বালাতে হবে আমাদের পরিচালকদের। দুর্দান্ত সব গল্প ও চরিত্রে তাকে কাস্ট করতে হবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তাহলেই তাকে নিয়ে যে সব আক্ষেপ , যেসব সমালোচনা তা মুগ্ধতার ফুল হয়ে ফুটবে।

তবে, আর্ট ফিল্ম নয়, আমি যেন বাণিজ্যিক সিনেমার শাকিবকেই দেখতে চাই। এমন ‘নায়কোচিত’ নায়ক তো আর নেই আমাদের! যিনি পর্দায় এলেই দর্শক তুমুল করতালিতে ফেটে পড়েন, হুইস্যালে হুইস্যালে কানে তব্দা লেগে যায়! যতক্ষণ স্ক্রিনে থাকেন, ততক্ষণ যেন আলোর উৎস হয়ে থাকেন। এই শাকিব খুব দরকারি ও দামি এক ‘প্রোডাক্ট’। তাকে যথাযথ ব্যবহার করতে পারলে তা হবে আমাদের চলচ্চিত্রের জন্যই বিশাল বড় এক জ্বালানি , শক্ত শক্তি।

‘প্রিয়তমা’ সিনেমার গল্প, দুর্বল চিত্রনাট্য, সিচ্যুয়েশনাল ট্রিটমেন্ট নিয়ে অনেক আক্ষেপ বা অবজারভেশন আমার আছে। তবে শেষ ত্রিশ মিনিট হলের আর সবার মতোই আর্দ্র হয়ে উঠেছিল আমার চোখও। শাকিব খান যেন তার সামর্থ্যের  সবটুকু দেখিয়েছেন চূড়ান্ত দক্ষতায়। এই শাকিব খান অফুরন্ত এক সম্ভাবনার নাম। সেই সম্ভাবনার বৃক্ষ পত্রপল্লবে সুশোভিত করার দায়িত্ব হয়তো নির্মাতাদেরই। সেটি না হলে তা আমাদের সিনেমার জন্য দুর্ভাগ্যই হবে।

এই ঈদের অন্য ছবিগুলো নিয়েও নানান অব্জার্ভেশন আমার ছিল। কিন্তু দীর্ঘকাল পর সিনেমার এই দারুণ নবজাগরণের সময়ে আমি ইতিবাচকই থাকতে চাই। কারণ, আমি চাই, মানুষ সিনেমা দেখুক। যত বেশি মানুষ সিনেমা দেখবে, তত বেশি নির্মাতা তৈরি হবে, সিনেমা হল তৈরি হবে। প্রযোজকরা আগ্রহী হয়ে উঠবেন, ভালো সিনেমা ও শিল্পী তৈরি হবে।

এই সিনেমায়ই যেমন ইধিকা পাল নামের অচেনা মেয়েটির অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়েছি। তিনি যেন মায়া ছড়িয়েছেন স্নিগ্ধ কবিতার মতো অভিনয়ে, অভিব্যক্তিতে। যতক্ষণ স্ক্রিনে ছিলেন, যেন বেলীফুলের সুবাসে সুবাসিত ছিল চারপাশ।

সোমেশ্বর অলির লেখা ও প্রিন্স মাহমুদের সুরে, ‘ঈশ্বর কি তোমার আমার মিলন লিখতে পারতো না!’ আমার কাছে এই ঈদের সেরা গান। এই গান অনেকদিন থাকবে। সিনেমার গানে বেশি বেশি এমন গুণী মানুষদের দেখতে চাই। শহীদুজ্জামান সেলিম ও লুৎফর রহমান জর্জ অসাধারণ। তাদের দুজনের সংলাপগুলো শতভাগ উপভোগ করেছি।

আর শাকিবের ওই কবিতার মতো মিষ্টি সংলাপ (আমি কোনো রাজপুত্র নই, কোনো রাজ্যও নেই আমার…. কিন্তু…) ও অভিব্যক্তিটুকু কী সুন্দর!

আর পরিচালক হিমেল আশরাফ এই স্বল্প সময়ে যা করেছেন, তা একপ্রকার অসাধ্য সাধন। শুনেছি মাত্র দুইমাসে এই সিনেমা হয়েছে। তার কাছ থেকে দীর্ঘ সময় নিয়ে করা আরও অনেক কাজের দাবি রইল।

পরিশেষে , ‘অন্য’ এই শাকিবে ‘অনন্য’ সম্ভাবনার যে আলো দেখলাম, সেই আলোয় উদ্ভাসিত হতে দেখতে চাই আগামীর দিন, সিনেমা রঙিন…

রাফির রোমাঞ্চকর ‘রাইড’… শ্বাসরুদ্ধকর ‘সুড়ঙ্গ’…

এবারের ঈদে সময় সুযোগ সাপেক্ষে সবগুলো সিনেমা দেখারই ইচ্ছে ছিল। কিন্তু নানাবিধ ব্যস্ততায় শেষ অবধি সেটি কতটা সম্ভব হবে জানি না। তবে রাফির ‘সুড়ঙ্গ’ দেখে রীতিমতো মুগ্ধ হয়েছি। গল্প সেই চিরাচরিত লোভে পাপ এবং পাপে পরাজয়ের পরিণতির। কিন্তু অসাধারণ নির্মাণ ও চিত্রনাট্যে সেই চিরায়ত গল্পই হয়ে উঠেছে অনন্য।দারুণ লোকেশন, সেট, আর্ট ডিরেকশন… বিজিএম ট্রিটমেন্ট দুর্দান্ত । আর অভিনয় … আফরান নিশো পরীক্ষিত অভিনেতা, নতুন করে নিজেকে প্রমাণের আর কিছু নেই তার। কিন্তু তারপরও বড় পর্দায় তার অভিষেক হলো দুর্দান্ত ! তার এই অভিষেক নিয়ে চারপাশে যেসব ফিসফাস, দ্বিধা, সংশয় ছিল, তা যেন এক ফুৎকারেই উড়িয়ে দিলেন তিনি। নিঃসন্দেহে রাজকীয় আগমন।

তমা মির্জা রীতিমতো বিস্ময় ছড়িয়েছেন। নিজের চেনা আদল ভেঙে অন্য এক কুশীলবে পরিণত হয়েছেন তিনি। এই তমা অনেকদূর যাবেন।

আর শহীদুজ্জামান সেলিম যেন শেষ বলে ছক্কা মেরে ক্যামিও ইনিংসে দল জেতানো ব্যাটসম্যান। অসাধারণ!

চিত্রনাট্যে নাজিম উদ্দৌলা দারুণ। দৃশ্যকল্প, গান, স্যুদিং। তবে সংলাপ কখনো কখনো যেন পৌনঃপুনিক লেগেছে। এখানে আরও মনোযোগী হওয়া যেত। আর একদমই ব্যক্তিগত অনুভব, এই সিনেমায় আইটেম সংটা সম্ভবত না হলেও এর এতোটুকু আবেদন কমত না।

তবে এসব এড়িয়ে যাওয়ার মতোই বিষয় ।কারণ, অসাধারণ রোমাঞ্চকর এক যাত্রার কম্প্যাক্ট এক প্যাকেজ সুড়ঙ্গ ।রায়হান রাফি ও পুরো টিমকে টুপিখোলা অভিবাদন…


Leave a reply