সাধারণ দর্শককে নিজের অবস্থান বুঝতে সাহায্য করে ‘বাজি’
ওয়েব সিরিজ ‘বাজি’। বারে মদ খাচ্ছেন ইন্সপেক্টর তপু, তার সঙ্গে অধীনস্থ অফিসার ফারুক। তপুর জীবন ঘোলাটে। মানিয়ে নিতে পারছেন না ব্যক্তিগত-পারিবারিক জীবনের অবশ্যম্ভাবী কিছু বোঝাপড়াকে। আর ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজছে ‘টাকা ও পাখি’ গানের সলো। এক রুঢ় বাস্তবতা এসে যেন ধরা দিয়ে যাচ্ছে দর্শকের সাবকনসাসে। গানের মতো করে টাকা তো আমাদের কাছে ধরা দেয় না, আমরা ধরা দিই টাকার কাছে। তার জন্য জীবন বিকিয়ে দেই, কিংবা টাকাই এসে আমাদের জীবন নিয়ে নেয়। ‘বাজি’ ওয়েব সিরিজ আমাদের সামনে যেন সেই পরিচিত সত্যের রিমাইন্ডার হয়ে আসলো।
ঈদুল আজহার দিন ওটিটি প্লাটফর্ম চরকিতে মুক্তি পেয়েছিল ‘বাজি’। আরিফুর রহমানের পরিচালনায় ৭ এপিসোডের সিরিজটি ছিল ঈদে ওটিটির অন্যতম আকর্ষণ।
আদিত্য সেনগুপ্ত ও হাসানাত যৌথভাবে লিখেছেন সিরিজের মূল গল্প। গল্পে দেখা যায় হঠাৎ দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করে ‘ম্যান অব দি ম্যাচ’ হওয়ার পর টিম হোটেলে রহস্যজনকভাবে মৃত্যু হয় উদীয়মান ক্রিকেটার অপুর। এই মৃত্যুর তদন্ত করতে এসে তার ভাই তপু খুলতে থাকেন একের পর এক রহস্যের জট। বাতাসে ভাসতে থাকে এই মৃত্যুর সাথে দেশের সবচেয়ে বড় তারকা ক্রিকেটারের জড়িত থাকার কথা। সেসব নিয়ে ডিল করতে করতে তপু প্রমাণ পান বেটিং জগতের সঙ্গে এই হত্যার যোগসাজশের। আবার বেটিং জগতকে নিয়েও একের পর এক চাঞ্চল্যকর দৃশ্য হাজির হতে থাকে। পাওয়ারপ্লে, হাউস দ্যাট, ডিসিশন পেন্ডিং, কট বিহাইন্ড, ইনসাইডআউট, স্ট্র্যাটেজিক টাইমআউট ও ডেথ ওভার— এই সাতটি ক্রিকেট টার্ম দিয়ে এপিসোডের নামকরণ করা হয়েছে। ক্রিকেটকে ঘিরে বেটিং এবং তার কনসিকোয়েন্স নিয়ে গল্পটি তৈরি হলেও ক্রিকেটের জন্য স্পেস কম রাখা হয়েছে। ফলত এই স্টোরির ফ্রেমটা ভিন্ন হলেও আদত দিনশেষে গল্পটা গিয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের চিরচেনা মার্ডার মিস্ট্রিতেই।
মার্ডার মিস্ট্রি হলেও স্ক্রিপ্টরাইটার চেষ্টা করেছেন চিত্রনাট্যে ছোট ছোট সাবপ্লট আর ডায়ালগ দ্বারা এই গল্পে পারিবারিক জীবন, পুলিশের আভ্যন্তরীণ বায়াসনেস, পাওয়ার প্র্যাকটিসের সম্পর্ক, জার্নালিজমের ‘এডিটরস চয়েজ’সহ নানা কিছুকে টেনে আনতে। কিছু ক্ষেত্রে হাসানাত সফল, পরিচালক আরিফুর রহমানও পেরেছেন স্ক্রিপ্টকে সেভাবে এক্সিকিউট করতে। সাংবাদিক জিনিয়ার সঙ্গে তার সম্পাদকের বোঝাপড়া, সিনিয়র ক্রিকেটার আবিরের সঙ্গে জুনিয়র অপুর সম্পর্ক, বড় ভাই তপুর সঙ্গে অপুর ইগোস্টিক কিছু সমীকরণ, ভাড়াটে খুনী মিসেস ৪৫-এর খুনী জীবন আর সংকটময় পারিবারিক জীবনের বিরহের চিত্র এসবকিছুকে ফুটিয়েছেন ব্যালান্স করেই। তবে বেটিংয়ের যে মাস মার্কেট যেখানে রিকশাওয়ালা, স্টুডেন্ট থেকে শুরু করে প্রান্তিক মানুষেরাও জড়িত সেদিকটা এখানটায় উঠে আসে নাই খুব একটা। মনে হবে বেটিং বুঝি বড়লোকদের কালচার।
বেটিংকে এমন একটা সময়ে ট্যাবুরূপে ফিকশনে প্রেজেন্ট করা হচ্ছে যখন টুর্নামেন্টগুলো, টিভি চ্যানেলগুলো বেটিং সাইটকে প্রমোট করছে। সেক্ষেত্রে বেটিং ব্যাপারটাকে আমাদের সোসাইটিতে পরিচালক ঠিক কোন অবস্থানে দেখাতে চাইছেন স্পষ্ট না। তপু এমন এক্সক্লুসিভ ফ্র্যাঞ্চাইজির প্র্যাকটিস সেশনে ঢুকে পড়াটাও খুব লজিক্যাল না, অথচ এই ছোট্ট সাবপ্লটটিকে ঘিরেই গল্প তৈরি হয়েছে বড় সারফেসে।
তাহসান আর মিথিলার সম্পর্ক-বিচ্ছেদ আর কাজের সূত্রে একত্র হওয়াকে আলাদা একটা সাবপ্লটে ‘উই আর প্রফেশনালস’ এই উক্তি দিয়ে সকল উত্তর দিয়ে দেওয়াটা মেটাফোরের দারুণ রেফারেন্স। ‘মদ খা, মানুষ হ’, কিংবা ‘ঢাল নাই, তলোয়ার নাই, নিধিরাম সর্দার’ এই ডায়ালগগুলো গল্পের সঙ্গে মিলেছে খুব। কিন্তু তপু-রেনুর দাম্পত্য জীবনে ইনফার্টিলিটির সংকট, আমাদের ওয়েব সিরিজগুলোয় পুলিশকে যেকোনোভাবেই একটা পারিবারিক/প্রফেশনালি/ইকোনমিক্যালি লুজার ক্যারেক্টারে হাজির করাতে চাওয়ার যে টেন্ডেন্সি এসব সিরিজে নতুন কিছু না। পরিচালকদের এইদিকগুলো বিবেচনায় নেওয়া জরুরি। এই চিত্রনাট্যের উল্লেখযোগ্য দিক হলো প্রত্যেকটা ক্যারেক্টারই সমান স্পেস পাওয়া।
‘বাজি’ পুরোপুরি তারকাখচিত ওয়েব সিরিজ। নাজিয়া হক অর্ষা নিঃসন্দেহে এই সিরিজের সেরা অভিনয়ের ক্রেডিট পাবে। মিসেস ৪৫ চরিত্রটা একাই একটা শো’কে রান করতে পারে। সেটা চিত্রনাট্যের ক্রেডিট। অর্ষা স্পেশাল কারণ এই ক্যারেক্টারে তাকে একজন মা, একজন পঙ্গু মানুষের স্ত্রী, একজন ফ্যামিলি গেটওয়ে, আবার একইসঙ্গে বর্বর ভাড়াটে খুনীর চরিত্র করতে হয়েছে। এমনও ছিলো একটাই দৃশ্য যেখানে তাকে তার কোমলমতি সন্তানের সঙ্গে খেলতে হচ্ছে আবার খুনের ডিলও করতে হচ্ছে। দীর্ঘদিন পর ওটিটিতে এই অর্ষাকে দর্শকমাত্রই উপভোগ করবেন।
তাহসান খান ওটিটিতে অভিষেক করেছেন ‘বাজি’ দিয়ে। তাহসান অভিজ্ঞ অভিনেতা। সে হিসেবে আবির চরিত্রটি তার জন্য কঠিন ছিলো না। অভিনয় দিয়ে টেনশন ক্রিয়েট করা হোক বা টেনশনের মধ্য দিয়েই নিজেকে বুস্ট আপ করে সামনে এগিয়ে নেওয়া এসব তাহসান কমফোর্টেবলিই সামলেছেন। একজন প্রফেশনালের ওয়ার্কিং ইথিকস আর সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’ সিনেমার মতো অনেক উঁচু থেকে ফল করার ভয় এইদিকটি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ক্রিকেটার আবির হিসেবে তাহসান মোটেও সাবলীল নন। ব্যাটের গ্রিপ ধরা, পজিশন নেওয়া, ব্যাট চালানো, শট সিলেকশন কোনোটাই প্রফেশনাল ধাঁচে হয়নি। তবুও আবির পাসমার্ক পাবেন কেননা ইমোশনের জায়গায় তাহসান বেশ ভালো করেছেন। ক্যারেক্টার বিল্ড আপে বিশেষ সময় নেননি। আপস অ্যান্ড ডাউন্সগুলোয় ফ্লো হারিয়ে ফেলেননি।
মনোজ প্রামাণিকের রোমান্টিক তপু আর পুলিশ অফিসার তপু হিসেবে অভিনয় উল্লেখ করার মতন। এই গল্পটার পরিণতি প্রেডিক্ট করা যাচ্ছিলো বলে তপুর স্ট্রাগলটা বিশেষ চোখে পড়ছিলো না। সম্ভবত মোশন পিকচার্সের সৌন্দর্যই এটাই। ভাই হিসেবে তপু দারুণ করেছেন। একজন অর্ডিনারী পুলিশ অফিসার হিসেবেও। কিন্তু মারামারির দৃশ্যে সাবলীল ছিলেন না। ব্যাটিংয়ের দৃশ্যেও বাজে অভিনয় করেছে। গ্রিপ ধরা বা পজিশন কোনোটাই ভালো না।
মিথিলা একজন তরুণ সাংবাদিকের চরিত্রে হাজির হয়েছেন এই সিরিজে। সাংবাদিক জিনিয়া চরিত্রটা কিছু কিছু জায়গায় খেই হারিয়েছে। কন্টিনিউটি রাখতে গিয়ে গল্পের সঙ্গে যোগসাজশ মেলানোর তাড়াহুড়াও লক্ষ্য করা গেছে। এর বাইরে মিথিলা যেটুকু দিয়েছেন তা ভালোই। তবে এই গল্পে তার স্পেস অন্যদের চেয়ে কম ছিলো, এবং ট্রেলার আর সিরিজের মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজিতে মিথিলা ছিলেন অন্যতম আকর্ষণ। ফলাফল যা হওয়ার তাইই হয়েছে। একরাশ হতাশা।
তাসনুভা তিশা হাউজওয়াইফ রেনুর চরিত্রে অভিনয় করেছেন। তপু-রেনুর রোমাঞ্চ, রেনুর সংসারের সাথে মিশে যাওয়া, অপুর মৃত্যুতে ব্যথিত হওয়া, এই অল্প কয়টা দৃশ্যেই তিশা নিজেকে হাজির করেছেন মূল আকর্ষণরূপে। পার্থ শেখের অভিনয়ের কথা বলতে হয়। মিম মানতাশা, আবরার আতাহাররাও দিয়েছেন নিজের ভালোটুকু।
সিরিজের সিনেমাটোগ্রাফার সুমন সরকার। বাংলাদেশের অসংখ্য উল্লেখযোগ্য প্রোডাকশন তার হাত ধরে দাঁড়িয়েছে। সুমন বরাবরের মতো এখানেও তার নামের পরিচয় দিয়েছেন। তপুর সঙ্গে তার বউয়ের বেডরুমে রোমান্টিক মুহূর্তের দরজার বাইরে থেকে নেওয়া ফ্রেমটা সুন্দর। ইনডোরের প্রায় প্রতিটি শটই আকর্ষণীয়। তপুর বউয়ের রেগে মাছ খাওয়ার দৃশ্যটা একাডেমিক্যালিই রীচ শট। ওয়াইড ফ্রেমে সুমনের কাজ বরাবরই অনবদ্য। সকালে অপু-তপুর ব্রেকফাস্ট এর দৃশ্যটাও সুন্দর। কিন্তু যে ক্রিকেটকে ঘিরে এই সিরিজটা সে ক্রিকেটের সম্প্রচারের যে সিনেমাটোগ্রাফি তা কোনোমতেই ওটিটির উল্লেখযোগ্য কাজের মানদণ্ডে পড়ে না। খেলার যতগুলো সিন এসেছে সবই বাজে। খুবই নবিশ কাজ। এটা খুবই বেসিক আইডিয়া যে লাইভ স্পোর্টস ব্রডকাস্টকে আপনি ইউজুয়াল সিনেমাটোগ্রাফির গ্রামারে ফেলতে পারবেন না।
ডিজাইন করেছেন শৈব তালুকদার। ডাবিংয়ে কয়েক জায়গায় লিপ সিঙ্কের সমস্যা বাদ দিলে সিরিজে ফলি ও ডাবিংয়ের মিক্সআপ ভালোই ছিলো। তবে ভিআইপি গ্যালারিতে কাঁচের ভেতরেও ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকের কথা শোনা যাওয়াটা খুবই ইলজিক্যাল। জাম্পকাটের সঙ্গে সঙ্গে মিউজিকের রেশটা মিলিয়ে যাওয়ার আগেই কানে ধাক্কা লাগছিলো। এখানটায় আসল দোষটা রাফকাটের মূলত। কিন্তু রাফকাট দেখে বিজিএম দাঁড় করানো গেলে এই সমস্যাটা হতো না। ফলিটা খুবই বাস্তবিক লেগেছে। লেপেলে নেওয়া সাউন্ডগুলোও নয়েজবিহীন বলে শুনে শান্তি পাওয়া গেছে। বিজিএম স্কোর করেছেন জাহিদ নীরব।
‘বাজি’ কাজ হিসেবে পিছনে পড়ে যাওয়ার কারণ সম্ভবত বাজে এডিট। এডিটর ছিলেন মাহাদী হাসান। স্কোর লাইনের এডিটের কথা যদি বাদই দিই, সামান্য স্ক্রিনে ভেসে আসা স্কোরলাইনের এডিটটুকুও ঠিকভাবে হয়নি। মুন্নার ওভার শুরু হওয়ার আগেও স্কোরলাইনে ছিলো ৯ ওভার। ওভার শেষ হওয়ার পরও। আবার মুন্নার ওভারে সিক্স মারার পরেও তার বোলিং ইকোনমি চেইঞ্জ হচ্ছিল না। আবার পরের ওভারে পেসার বল করার সময়েও চেঞ্জ হয়নি স্কোরলাইন। বোলারের নেইম, ওভার, কোনোকিছুই। হোটেলের ছাদে আবিরের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় অপুর মোবাইল ফেলে যাওয়াটা বেমানান। জাম্পকাটগুলো ভীষণ তড়িঘড়ি করে করা। ফলে ফেইড আউটের অভাবে ভুগেছে গোটা স্ক্রিনটাইম। মীর মোকাররম হোসেন নামে পুলিশ অফিসার ফ্রেম থেকে বের হয়ে যাওয়ার দৃশ্যে ঘড়ির কাঁটা ১১টা ৪০ মিনিটে ছিল। কিন্তু পরের সিনে ফারুকের সাথে কনভারসেশনে সাড়ে ১১টা। এডিটে এমন অপারদর্শিতার কাজ আশাহতই করে দর্শককে।
কালারিস্ট ছিলেন চিন্ময় রায়। ঘরের ভেতরে তপুর মায়ের আবায়া পড়ে থাকার সময়ের কালারটা মনোরোম। সিঙ্গেল শটগুলোতে কস্টিউমের একটা প্রভাব ছিলো কালারের সঙ্গে ব্যালেন্স তৈরি করতে। কস্টিউম ডিজাইন করেছেন ইদিলা ফরিদ তুরিন। থানার কালার, অর্ষার ক্যারেক্টারের সঙ্গে রেডিশ গ্রিটি টোনের একটা মিস্ট্রিয়াস ভাইব সবগুলো সিনে, তার শাড়ির কালার সিলেকশনে গুরুত্ব দেওয়াটা কাজটাকে আরো নতুন ডাইমেনশন দিয়েছে। কস্টিউম যে ফিকশনে ক্যারেক্টারের ডমিনেশন তৈরি করতে অর্থবহ ভূমিকা রাখে অর্ষার মিসেস ৪৫ তার প্রমাণ। মেকআপের কাজও ঠিকঠাক মনে হয়েছে।
টেকনিক্যাল ফল্ট বাদ দিয়ে গল্পে যদি আসি ‘বাজি’ আমাদের সোসাইটির একটা বিশেষ শ্রেনীর গল্পই বলে গেছে। যে শ্রেণীকে বাদ দিয়ে আমাদের সোসাইটি দাঁড়ায় না। এই শ্রেণীর বিশেষত্ব হচ্ছে তারা পাওয়ারের কাছাকাছি থাকেন। এই যে পাওয়ারের কাছাকাছি থাকা শ্রেনী, তাদের গল্পকে সাধারণ দর্শক নিজের সাথে কতটুকু রিলেট করতে পারবেন সে ব্যাপারে সন্দিহান। কিন্তু এই শ্রেণী ফিকশনে উঠে আসাতে মূলতঃ সাধারণ দর্শক আস্তে আস্তে যে নিজেদের আসল জায়গাটুকু কোথায় তা বুঝতে পারছেন তা-ই ‘বাজি’র মতো প্রোডাকশনগুলোর পরোক্ষ সফলতা।