Select Page

সালতামামি ২০০২: আয়ের শীর্ষে মান্নার ‘শ্লীল-অশ্লীল’ দুই সিনেমা

সালতামামি ২০০২: আয়ের শীর্ষে মান্নার ‘শ্লীল-অশ্লীল’ দুই সিনেমা

বাংলা চলচ্চিত্রের উত্তাল সময়ের আরেকটি বছর ২০০২ সাল। যখন ‘অশ্লীলতা’ নিয়ে আলোচনা ছিল তুঙ্গে। ওই সময় ঢালিউডের এক নম্বর নায়ক ছিলেন মান্না। বছরের চারটি সুপারহিট সিনেমার নায়ক তিনি। যার একটি ছিল তুমুল বিতর্কিত। ব্যবসায়িক বিচারের দুই ছবিই ৩ কোটি টাকা করে আয় করে। অন্তত প্রথম আলো সালতামামি সেই কথা বলছে।

সেখানে বলা হয়, ২০০২ সাল ছিল চলচ্চিত্রের জন্য নানা রকম ঘটনার বছর। বিশেষ করে এ বছরে বাংলা চলচ্চিত্রের ব্যবসায় ব্যাপক আকারে ধস নামে। বছর শেষে ১০টি সুপার-ডুপার হিট ছবিও খুঁজে পাওয়া যায়নি। ফলে অনেক প্রযোজনা সংস্থাই ছবি নির্মাণ বন্ধ করে দিতে বাধা হয়।

২০০২ সালে মোট ৮২টি ছবি মুক্তি পেয়েছিল। এর মধ্যে বেশির ভাগ ছবিই বক্স অফিসে ফ্লপ করে। বছরের প্রথম ছবি হিসেবে মুক্তি পেয়েছিল ‘বউ হবো’। আর শেষ ছবি হিসেবে মুক্তি পায় ডাইরেক্ট অ্যাকশন। বছরের প্রথম ছবিটিই ফ্লপ করে। এর পরে লাগাতার ছবি ফ্লপ করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত সফলতার মুখ দেখতে পাওয়া যায় ২০০২ সালের ঈদুল আজহায়। লাগাতার মন্দার বাজারে সুপার-ডুপার হিট ব্যবসা করে ইস্পাহানি আরিফ জাহান পরিচালিত ‘নায়ক’।

এর পরে নির্মাতারা আবারও আশাবাদী হয়েছিলেন ততটাই হতাশ হতে হয়। কিছুদিন পর বাজার চাঙ্গা করে তোলেন পরিচালক এফ আই মানিক। নায়ক মান্না প্রযোজিত ‘স্বামী-স্ত্রীর যুদ্ধ’ ছবিটি ছিল ওই বছরের সবচেয়ে ব্যবসাসফল ছবি। কিন্তু এরপর নামকরা বড় বড় চলচ্চিত্র নির্মাতাদের ছবি একের পর এক ধরাশায়ী হতে থাকে। তবে এ বছর উত্থান ঘটে অশ্লীল ছবির নির্মাতাদের।

আরো বলা হয়, অশ্লীল ছবির বিরুদ্ধে আন্দোলনের কার্যক্রম ঝিমিয়ে পড়লে অশ্লীল ছবির নির্মাতারা একের পর এক অশ্লীল ছবি নির্মাণ করতে থাকেন। এদের মধ্যে মোহাম্মদ হোসেন পরিচালিত (এবং মান্না ও পলি অভিনীত) ‘ফায়ার’ গত দু-তিন বছরের বাংলা ছবির ব্যবসার সব রেকর্ড ভঙ্গ করে। ফায়ারের ধাক্কায় একাধিক ছবি ফ্লপ করে। ফায়ারের কারণে আবার অনেক ছবির প্রযোজকই ছবি মুক্তি না দিয়ে পিছিয়ে যান। এ রকম ঘটনা গত পাঁচ বছরে ঘটেনি বলে জানান পরিচালক মালেক আফসারী। ফায়ারের ধাকার চোটে আঘাতপ্রাপ্ত হতে হয় মাসুদ পারভেজ ওরফে সোহেল রানার মতো পরিচালক, প্রযোজক ও নায়ককে। তিনি নিজেই বলেছেন তার ‘ভালোবাসার মূল্য কত’ ছবিতে লোকসান দিতে হয়েছে প্রায় ৭০ লাখ টাকা।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ফায়ারের ধাক্কা মোকাবিলা করেছেন সাহসের সঙ্গে কাজী হায়াৎ। তিনি তার ছেলে কাজী মারুফকে নিয়ে মুক্তি দেন ‘ইতিহাস’ ছবিটি। এই ছবিই ব্যবসার মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ছবিটি ব্যবসায়িক সাফল্য অর্জন করার পর আবারও সুস্থ ছবির নির্মাতারা আশাবাদী হয়ে উঠেন। আর তার পরপরই মনতাজুর রহমান আকবরের ‘মাস্তানের ওপর মাস্তান’ ছবিটি সুপার-ডুপার হিট ব্যবসা করে। এটি ছিল বছরের দ্বিতীয় ব্যবসা সফল ছবি।

এ বছর আবার হঠাৎ করেই অশ্লীল ছবিগুলো ফ্লপ করতে থাকে। এই ভিড়ে সুস্থ ছবির নির্মাতা জাকির হোসেন রাজু পরিচালিত ‘ভালোবাসা কারে কয়’ ব্যবসায়িক সাফল্য লাভ করে।

২০০২ সালে ৮২টি ছবি নির্মাণে বায় হয়েছে ৮২ কোটি টাকা। এর মধ্যে চারটি ছবি সুপার-ডুপার হিট হয়েছে। এই চারটি ছবির মাঝে আছে স্বামী-স্ত্রীর যুদ্ধ, নায়ক ও মাস্তানের ওপরে মাস্তান। এ ছাড়া ‘ফায়ার’ ছবিটিও ব্যবসা করেছে অস্বাভাবিকভাবে। এই ছবিটি ব্যবসা করেছে অশ্লীল দৃশ্য সংযোজন করে- এমন অভিযোগ আছে। ‘স্বামী-স্ত্রীর যুদ্ধ’ ও ‘ফায়ার’ ছবি দুটি ব্যবসা করেছে ৩ কোটি করে ৬ কোটি টাকা। আর ‘নায়ক’ ও ‘মাস্তানের ওপর মাস্তান’ ব্যবসা করেছে ২ কোটি টাকা করে মোট ৪ কোটি টাকা। এ ছাড়া ব্যবসায়িক সাফল্য পাওয়া আরো ছয়টি ছবি ব্যবসা করেছে গড়ে দেড় কোটি টাকা করে মোট ৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ ব্যবসাসাফল চলচ্চিত্র থেকে ঘরে উঠেছে ১৯ কোটি টাকা। এ ছাড়া কিছু ছবি ছিল যেগুলো ব্যবসায়িকভাবে সাফল্য অর্জন না করতে পারলেও লোকসান দেয়নি। এমন ছবির সংখ্যা হচ্ছে ১৩টি। এই ১৩টি ছবির প্রযোজকরা ১৩ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে সারা বছরে টেনেটুনে ঘরে তুলে এনেছেন ১৩ কোটি টাকা।

হিসাব করে দেখা যাচ্ছে, মোট ২৩টি ছবিতে বিনিয়োগ করে নির্মাতারা ঘরে করে এনেছেন ১৯+১৩ = ৩২ কোটি টাকা। আর ৫০টি ছবিই ফ্লপ করেছে গড়ে ৫০ লাখ টাকা করে। তার মানে লোকসানের পরিমাণ হচ্ছে, ৫০x৫০ লাখ = ২৫ কোটি টাকা। আর এই ৫০টি ছবি নির্মাণের পেছনে নির্মাতারা ব্যয় করেছিলেন ১ কোটি টাকা হারে ৫০ কোটি টাকা। সেখান থেকে প্রতি ছবিতে ৫০ লাখ টাকা করে লোকসান দিয়ে ঘরে তুলে এনেছেন ২৫ কোটি টাকা। আর ২৫ কোটি টাকা চলে গেছে পানিতে। সর্বমোট হিসাব হচ্ছে, ১২ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে প্রযোজকরা ঘরে তুলে আনতে পেরেছেন ৩২+২৫ = ৫৭ কোটি টাকা। আর লোকসান দিয়েছেন ৮২-৫ = ২৫ কোটি টাকা। মোটকথা হচ্ছে, ২০০২ সালে প্রতি ছবিতে ১ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে প্রযোজকরা ৮২টি ছবিতে ৮২ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে। তুলে এনেছেন ৫৭ কোটি টাকা আর লোকসান দিয়েছেন ২৫ কোটি টাকা।

এই বছরের উল্লেখযোগ্য ঘটনার মধ্যে ছিল সিনেমা হলে বোমা হামলা, ‘ফায়ার’ সিনেমা ও শাবনূর-রিয়াজের জুটির ভাঙন।

প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বলা হয়, রমজানের ঈদে সাতটি ছবি মুক্তি পেয়েছিল সারা দেশে। ঈদের প্রায় সবগুলো ছবি দেখার জন্য দর্শকের উপচে পড়া ভিড় দেখে চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট সবাই যখন ভীষণ খুশি, ঠিক তখনই ঈদের একদিন পরে ময়মনসিংহের চারটি সিনেমা হলে এক ঘণ্টার ব্যবধানে বোমা হামলায় নিহত-আহত মানুষের স্বজনদের আহাজারিতে কেঁপে ওঠে ময়মনসিংহ শহর। এই ঘটনায় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে নেমে আসে বড় ধরনের বিপর্যয়। সাত দিনব্যাপী শোকদিবস পালন করে চলচ্চিত্র কলাকুশলীরা। বোমা হামলার ঘটনায় নিন্দার ঝড় বয়ে যায় সারা দেশে। দর্শকশূন্য হয়ে যায় দেশের সকল সিনেমা হল। তবে কদিন বাদে হলে দর্শক ফিরে এলেও সবার মধ্যে একটা আতঙ্ক রয়ে যায়।

‘ফায়ার’ সম্পর্কে বলা হয়, মোহাম্মদ হোসেনের ‘ফায়ার’ ছবিটি সেন্সর আটকে দিলে আলোচনায় এসে যায়। পরবর্তীকালে সেন্সর বোর্ডে ছাড়পত্র  দিলে পুরো ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি হতবাক হয়ে যায়। পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে লেখালেখি হয়। শিল্পী সমিতির নেতৃবৃন্দ চট্টগ্রামের একটি সিনেমা হল থেকে গোপনে ভিডিও ক্যামেরার সাহায্যে এ ছবির রেকর্ড কপি সিডি করে আনার পর সেন্সর বোর্ড কুমিল্লার একটি সিনেমা হল থেকে ফায়ারের একটি প্রিন্ট আটক করে। আটক প্রিন্টটি দেখতে গিয়ে তারা ছবিতে সেন্সরবিহীন দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেন। এর পর সেন্সর বোর্ড প্রথমবারের মতো নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ছবির পরিচালক মোহাম্মদ হোসেন আদালতে গিয়ে ছবির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা বাতিলের রায় পান। ছবিটি আবারো পার্শ করা হলে সেন্সর বোর্ড ছবির একটি প্রিন্ট আটক করে এবং দ্বিতীয়বারের মতো ছবিটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। মোহাম্মদ হোসেন আবারও উচ্চতর আদালতে গিয়ে তার পক্ষে রায় নিয়ে আনেন। ছবিটি চলতে থাকলে সুস্থধারার ছবিগুলো ব্যবসায়িক দিক থেকে মুখ থুবড়ে পড়ে।

বছরের শীর্ষ নায়ক-নায়িকা: মান্না (২০টি), রিয়াজ (১২টি), শাকিব খান (১৯টি), ফেরদৌস (সংখ্যক উল্লেখ করা হয়নি) ও কাজী মারুফ (২টি) এবং পূণির্মা (১৫ট), শাবনূর (১০টি), মৌসুমী (১৪টি), রত্না (২টি) ও শিমলা (৫টি)

*প্রথম আলোর মূল প্রতিবেদনটি করেছেন কামরুজ্জামান বাবু। বোমা হামলা ও ‘ফায়ার’ সিনেমা সংক্রান্ত এই সংখ্যার অন্য প্রতিবেদন থেকে নেয়া। এই সম্পর্কিত পেপার কাটিং ফেসবুকে ফিল্ম অ্যান্ড থিয়েটার গ্রুপ শেয়ার করেছেন ফয়সাল বারী।


মন্তব্য করুন