সালতামামি ২০২২ : ঢালিউডের ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত
২০২২ সাল বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য একটি ইতিবাচক বছর। বিগত কয়েক বছরের তুলনায় এই বছর মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির সংখ্যা যেমন বেশি, তেমনি ব্যবসাসফল ও দর্শক-সমালোচকদের কাছে প্রশংসিত হওয়া ছবির পরিমাণও বেড়েছে। করোনা সংকটের পর এই ঘুরে দাঁড়ানো ঢালিউডকে নতুন কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে।
এক নজরে ২০২২
২০২২ সালের মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম ছবি হল ১৪ই জানুয়ারিতে মুক্তি পাওয়া এইচ আর হাবিবের ছিটমহল। এই মাসের শেষে মুক্তি পায় এম কে জামানের তোর মাঝেই আমার প্রেম। ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে মুক্তি পায় শাপলা মিডিয়ার পরাণে পরাণ বাঁধিয়া । দীর্ঘ বিরতির পর দেবাশীষ বিশ্বাসের পরিচালনায় মুক্তিপ্রাপ্ত শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ ২ দিয়ে দর্শক ফেরে প্রেক্ষাগৃহে। এছাড়া মুক্তি পায় শাহীন সুমনের মাফিয়া ১, যার আরও ৬টি কিস্তির পরিকল্পনা রয়েছে।
মার্চ মাসে ইফতেখার শুভর চলচ্চিত্র পরিচালনায় অভিষেক ঘটে মুখোশ দিয়ে। পরের সপ্তাহে একই দিনে মুক্তি পায় দেশের বাইরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রশংসিত রুবাইয়াত হোসেনের শিমু এবং নন্দিত পরিচালক গিয়াস উদ্দিন সেলিমের গুণিন। মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে মুক্তি পায় শাহ আলম মণ্ডলের লকডাউন লাভ স্টোরি এবং সাজ্জাদ হায়দারের জাল ছেঁড়ার সময়।
পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষ্যে মুক্তি পায় ৪টি চলচ্চিত্র, তন্মধ্যে এম রাহিমের শান ও এস এ হক অলিকের গলুই ব্যবসাসফল হয়; অন্যদিকে সেলিম খানের বিদ্রোহী গড়পড়তা ব্যবসা করে এবং জুয়েল ফারসীর বড্ড ভালোবাসি আশানুরূপ ব্যবসা করতে পারেনি। এছাড়া মে মাসে মুক্তিপ্রাপ্ত গিয়াস উদ্দিন সেলিমের পাপ পুণ্য প্রশংসিত হয়।
জুন মাসে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে অঞ্জন আইচের আগামীকাল, শামীম আহমেদ রনীর বিক্ষোভ; সৈকত নাসিরের তালাশ এবং অনন্য মামুনের অমানুষ। জুলাই মাসে চুপিসারে মুক্তি পায় টেলিভিশনের জনপ্রিয় পরিচালক ভিকি জাহেদের প্রথম ছবি কার্নিশ এবং বর্ষীয়ান সৈয়দ সালাউদ্দীন জাকীর যা হারিয়ে যায়।
পবিত্র ঈদুল আযহা উপলক্ষ্যে মুক্তি পায় মুর্তজা অতাশ জমজমের বড় বাজেটের দিন দ্য ডে; রায়হান রাফীর পরাণ, ও অনন্য মামুনের সাইকো। পরাণ ছবিটি ব্যবসা সফলতা লাভ করে ও প্রশংসিত হয়। জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে মুক্তিপ্রাপ্ত মেসবাউর রহমান সুমনের হাওয়া ছবিটি ব্যবসাসফল ও বিপুল সমাদৃত হয় এবং দেশের বাইরেও ব্যবসাসফল হয়।
আগস্ট মাসে মুক্তি পায় মোস্তাফিজুর রহমান মানিকের পরিচালিত আশীর্বাদ ছবিটি। সেপ্টেম্বরে মুক্তি পায় রকিবুল আলম রকিবের ভাইয়ারে; শামীম আহমেদ রনীর লাইভ; সাইদুল ইসলাম রানার বীরত্ব। এই মাসে মুক্তিপ্রাপ্ত দীপঙ্কর দীপনের ওয়াইল্ড-লাইফ অ্যাডভেঞ্চার নিয়ে নির্মিত অপারেশন সুন্দরবন এবং মাহমুদ দিদারের দীর্ঘ অপেক্ষমান বিউটি সার্কাস ব্যবসাসফল হয় এবং প্রশংসিত হয়। এই মাসের শেষ সপ্তাহে মুক্তি পায় ডায়েল রহমানের ঐতিহাসিক পটভূমিতে নির্মিত ঈশা খাঁ।
অক্টোবর মাসে মুক্তি পায় ইস্পাহানী-আরিফ জাহানের রোমান্টিক ঘরানার হৃদিতা মোস্তাফিজুর রহমান মানিকের যাও পাখি বলো তারে; মিজানুর রহমান মিজানের লেডি-অ্যাকশন ধারার রাগী; আসাদ সরকারের জীবন পাখি; রোহিঙ্গাদের জীবনযাপন নিয়ে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার বিজয়ী সৈয়দ ওয়াহিদুজ্জামান ডায়মন্ডের রোহিঙ্গা; রফিক সিকদারের বসন্ত বিকেল ও রাসেল আহমদের ইস্টিশন। এই মাসে মুক্তিপ্রাপ্ত স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল নিয়ে নির্মিত রায়হান রাফীর ক্রীড়া-মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক দামাল ছবিটি আলোচিত হয়।
নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে মুক্তিপ্রাপ্ত মুহাম্মাদ কাইউমের কুঁড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া দেশে ও দেশের বাইরে প্রশংসিত হয়। এছাড়া এই মাসে মির্জা সাখাওয়াত হোসেনের ভাঙন; আশুতোষ সুজনের দেশান্তর; ইমরাউল রাফাতের চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার মেইড ইন চিটাগাং; আবুল কালাম আজাদের ও মাই লাভ ছবিগুলো মুক্তি পায়।
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে অনুদানের দীর্ঘ এক দশক পর মুক্তি পায় প্রশান্ত অধিকারীর হডসনের বন্দুক। বিজয় দিবসে মুক্তি পায় কাজী হায়াতের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক জয় বাংলা ও মিজানুর রহমান শামীমের ৭১ এর একখণ্ড ইতিহাস। এছাড়া এই মাসের শেষভাগে মুক্তি পায় সাইফুল ইসলাম মান্নুর পায়ের ছাপ; জুলফিকার জাহেদীর কাগজ এম সাখাওয়াত হোসেনের বীরাঙ্গনা ৭১ এবং আউয়াল রেজার মেঘ রোদ্দুর খেলা।
ব্যবসাসফল ও আলোচিত চলচ্চিত্র
এই বছরের ব্যবসাসফল ও আলোচিত চলচ্চিত্রের তালিকায় শীর্ষে পরাণ ও হাওয়া। বরগুনায় আলোচিত শাহনেওয়াজ রিফাত শরীফ হত্যার ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত ত্রিভুজ প্রেমের পরাণ মুক্তির পরপরই দর্শক তা লুফে নেয়। ছবিটির পরিবেশক জাহিদ হাসান অভি জানান ছবিটির ১৫ কোটি টাকার টিকিট হয়েছে। তিনি বলেন, মাল্টিপ্লেক্সগুলো ১০ কোটি টাকার টিকিট বিক্রি করেছে। যার মধ্যে ৭ কোটি টাকারও বেশি ছিল স্টার সিনেপ্লেক্সে। অন্যদিকে মেজবাউর রহমান সুমন তার প্রথম ছবি দিয়েই বাজিমাৎ করেছেন। ছবিটি আড়াই মাসের বেশি দেশের মাল্টিপ্লেক্সগুলোতে চলেছে। দ্য ডেইলি স্টারের খবর অনুসারে এই সব প্রেক্ষাগৃহে ১৪ কোটিরও বেশি টাকার টিকিট বিক্রি হয়েছে। দেশের বাইরে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় রেকর্ড সংখ্যক ১১৭টি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় ছবিটি। পরিবেশনা সংস্থা স্বপ্ন স্কোয়ারক্রো জানায় পাঁচ সপ্তাহ প্রদর্শনের পর বাংলাদেশি চলচ্চিত্র হিসেবে সর্বোচ্চ ৩ লাখ ৫৮ হাজার ডলারের বেশি বা প্রায় ৩ কোটি ৭২ লাখ টাকা গ্রস আয় করে ছবিটি।
এই দুটি চলচ্চিত্রের পর সুপারহিট তকমা পায় নবাগত পরিচালক এম রাহিমের শান। মানব পাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এক পুলিশ অফিসার শানের শানদার অপারেশন এই ছবিটিকে দর্শক টানতে সাহায্য করে। দেশের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের ৫৯টি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় ছবিটি। শানের সাথে ঈদুল ফিতরে মুক্তিপাপ্ত এস এ হক অলিকের অনুদানের ছবি গলুই শহুরে দর্শক টানতে নাপারলেও মফস্বলে ব্যবসা করে হিট তকমা লাভ করে।
স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল নিয়ে নির্মিত রায়হান রাফীর দামাল ছবিটি তার নির্মিত পরাণ ছবিকে ছুঁতে না পারলেও এটি উপভোগ্য ছিল। ভালো রিভিউর পরও দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে ছবিটির দর্শক কমতে থাকে। র্যাবের পৃষ্ঠপোষকতায় নির্মিত অপারেশন সুন্দরবনে দেশের বনজ সম্পদ রক্ষার একটি প্রয়াস দেখানো হয়েছে। সুন্দরবনের নান্দনিক দৃশ্য সংবলিত ছবিটি হিট ব্যবসা করে। ১০০ কোটি টাকার বাজেট ও ইরানি নির্মাতা মুর্তজা অতাশ জমজম এই স্টান্ট নিয়ে অনন্ত জলিলের ‘দিন দ্য ডে’ ছবিটি প্রথম সপ্তাহে ব্যবসা করলেও দুর্বল ভিএফএক্স ও অন্যান্য কিছু কারণে দর্শক সমালোচনা ও হাস্যরসের শিকার হলে গড়পড়তা ব্যবসা করে প্রেক্ষাগৃহ থেকে নেমে যায়।
ব্যবসায়িক দিক থেকে সফল না হলেও দেশের গার্মেন্টস শিল্পে কর্মরত নারীদের জীবন নিয়ে নির্মিত ‘শিমু’ ছবিটি দেশে ও দেশের বাইরে বিপুল প্রশংসিত হয়। হাওর অঞ্চলের জীবনচিত্র নিয়ে মুহাম্মাদ কাইউমের ‘কুঁড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’ ছবিটি দেশে কেবল একটি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেলেও প্রিমিয়ারেই প্রশংসিত হয় এবং দেশের বাইরে বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শনের পর পুরস্কৃত হয়। এছাড়া সার্কাস পরিচালনার আড়ালে এক যুদ্ধপরাধীকে খুঁজে ফেরা ও প্রতিশোধ নিয়ে নির্মিত মাহমুদ দিদারের বিউটি সার্কাস, গিয়াস উদ্দিন সেলিমের পাপ পুন্য,ও গুণিন, এবং আশুতোষ সুজনের দেশান্তর প্রশংসিত হয়।
আলোচিত ঘটনাবলি
বছর শুরু হয় শরিফুল রাজ ও পরীমনির বিয়ে আলোচনা দিয়ে এবং শেষ হয় তাদের বিচ্ছেদ দিয়ে। রাজ-পরীর প্রেম ও বিয়ের ঘটনাটি ঘটে গিয়াস উদ্দিন সেলিমের ‘গুনিন’-এর শুটিংয়ে। ২০২১ সালের অক্টোবরে বিয়ে করলেও ২০২২ সালের ২২ জানুয়ারি জমকালো আয়োজনে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা হয়। ১০ আগস্ট পরীমনি জন্ম দেন তাদের সন্তান রাজ্যকে। এদিকে এই বছর রাজের সাথে দুটি হিট ছবি করা মিমকে নিয়ে তাদের বিয়েবহির্ভূত সম্পর্কের ব্যাপারে ফেসবুকে পোস্ট করেন পরী। ‘পরাণ’ ও ‘দামাল’ সিনেমার সফলতায় বিভ্রান্ত হয়ে পরী এমনটা করছে বলে ইঙ্গিত দেন মিম। ৩১ ডিসেম্বর পরী তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে জানায় রাজ্য এবং রাজের মঙ্গল এর জন্যেই তারা আলাদা হয়ে যাচ্ছে।
এই বছরের অন্যতম স্টান্টবাজি ছিল ‘দিন দ্য ডে’-এর বাজেট নিয়ে প্রচারণা। অনন্ত জলিলের দাবি ছবিটির বাজেট ১০০ কোটি টাকা। ছবিটির পরিচালক মুর্তজা আতশ জমজম ইনস্টাগ্রামে ‘দিন দ্য ডে’র জন্য তার সঙ্গে অনন্তের করা চুক্তিপত্র প্রকাশ করেন। সেখানে দেখা যায় ছবিটির বাজেট মাত্র পাঁচ লাখ ডলার বা ওই সময়ে বাংলাদেশি মুদ্রায় ৪ কোটি টাকা। আতশ জানান ২০১৮ সালে চুক্তিটি সম্পন্ন হয়েছিল। সে সময়ে ডলারের দাম ছিল ৮২ টাকা। সে হিসেবে ‘দিন দ্য ডে’ ছবির মূল বাজেট চার কোটি টাকার একটু বেশি।
‘হাওয়া’ চলচ্চিত্রে একটি শালিক পাখিকে খাঁচায় আটকে রাখা ও এক পর্যায়ে হত্যা করে খাওয়ার দৃশ্য দেখানোর মাধ্যমে বন্যপ্রাণী আইন লঙ্ঘন হয়েছে বলে অভিযোগ তোলা হয়। এর প্রেক্ষিতে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন-২০১২ এর ধারা ৩৮ (১-২), ৪১ ও ৪৬ লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০ কোটি টাকার মামলা করে। এই অবস্থায় আত্মপক্ষ সমর্থনে ফেইসবুকের শরণ নিয়ে সুমন লিখেছেন, “নির্মাতা হিসাবে আমি এটুকুই বলতে চাই, হাওয়া’র পাখিটি রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আর এই নির্মাণের জন্য যে সিনেমাটিক রিয়্যালিটি তৈরি করতে হয়েছে, সেটা সত্য নয়। ছবির শুরুতে ‘Disclaimer’-এ আমরা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছি।”
এই বছর সিঙ্গেল স্ক্রিনের চেয়ে এগিয়ে ছিল মাল্টিপ্লেক্স। যে কয়টি ছবি ব্যবসাসফল হয়েছে সেগুলোর আয়ের বড় একটা অংশ এসেছে মাল্টিপ্লেক্স থেকে। সিনেপ্লেক্সের শাখা ও স্ক্রিনের সংখ্যা বেড়েছে। চট্টগ্রামের বালি আর্কেড শপিং কমপ্লেক্সে তিনটি হল নিয়ে নতুন একটি শাখার উদ্বোধন হয়।
এই বছর একাধিক চলচ্চিত্র ঢালিউডের ঘুরে দাঁড়ানোর আভাস দিয়েছে। আশার সঞ্চার করেছে পরিচালক-প্রযোজক থেকে শুরু করে দর্শক-সমালোচক মহলে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে নতুন ধারার গল্প বলা নিয়ে। এইভাবে নতুন গল্প আর মানের দিকে খেয়াল রেখে এগিয়ে গেলে ঢালিউড শীঘ্রই তার সোনালি দিনের দেখা পাবে।