সিনেমার নেপথ্য কাহিনি : সূর্যগ্রহণ ও সূর্য্য সংগ্রাম
দেশের প্রথম সিক্যুয়েল বা পার্বিক চলচ্চিত্র ‘সূর্যগ্রহণ’ ও ‘সূর্য্য সংগ্রাম’। প্রথমটা মুক্তি পায় ১৯৭৬ ও ১৯৭৯ সালে …
পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে আব্দুস সামাদ লন্ডন যান। পড়ার কথা ছিল ব্যারিস্টারি। কিন্তু ভর্তি হন বৃটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটে। আর ফার্স্ট ইয়ারের রেজাল্টে মুগ্ধ প্রিন্সিপাল রবার্ট ডানবার পরের তিন বছরের জন্য তার স্কলারশিপের ব্যবস্থা করে দেন!
তার সামনে সুযোগ ছিল সেখানকার ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতেই ক্যারিয়ার গড়ার। শুরুও করেছিলেন শিক্ষানবীশ চিত্রগ্রাহক (apprentice cinematographer) হিসেবে। কাজ করেন The Bridge on the River Kwai (1957), Saturday Night and Sunday Morning (1960), The Guns of Navarone (1961) ও Yesterday, Today and Tomorrow (1963) ছবিগুলোতে। ১৯৬২ সালে যোগ দেন বিবিসিতে। ক্যামেরাম্যান হিসেবে। কিন্তু এরপরই ফিরে আসেন দেশে। বাবা-মায়ের কথায়।
তবে সিনেমার পোকা মাথা থেকে যায়নি কখনোই। দেশে ফিরে কাজ শুরু করেন চিত্রগ্রাহক হিসেবে। পাশাপাশি পরিকল্পনা করতে থাকেন পরিচালনার। সেজন্য নিজের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানও দাঁড়া করান- স্যামরোজ ফিল্মস। ১৯৬৭ সালে কাজী নজরুল ইসলামের ওপর সিনেমা তৈরির কাজ শুরু করেন। চিত্রনাট্য প্রস্তুতও করেছিলেন। কিন্তু বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় পাকিস্তানি সামরিক প্রশাসন।
১৯৭০ সালে কাজ শুরু করেন নতুন গল্প নিয়ে। আইল ভাঙার গল্প। জমির মালিকানার সীমা নির্ধারণের জন্য যে পায়ে হাঁটার পথ বা আইল তৈরি করা হয়। হিসেব করে দেখেন, এই আইলের জন্য তখনই সাড়ে নিরানব্বই লক্ষ একর জমি অনাবাদী থেকে যেত! সেগুলো ভেঙে, একক উদ্যোগ থেকে বেরিয়ে এসে যদি সমবায়ের মাধ্যমে চাষ করা যায়, তাহলে কৃষিজ উৎপাদন অনেকগুণ বাড়ানো সম্ভব।
তবে এটাই তর গল্পের একমাত্র বক্তব্য নয়। এই আইল বা বিভাজন রেখার প্রতীকে তিনি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভাজনগুলোকেও তুলে ধরতে চান। বোঝাতে চান এই অনৈক্য কীভাবে সমাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধ। বন্ধ হয়ে গেল আইল ভাঙার গল্প লেখার কাজ। আবদুস সামাদ শুরুতে চার বছরের মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে যান নরসিংদী। পরে ফিরে আসেন ঢাকায়। সক্রিয় সহযোগিতা করতে থাকেন মুক্তিযোদ্ধাদের। সূত্র বন্ধু বীর মুক্তিযোদ্ধা খালেদ মোশাররফ বীরউত্তম। ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলাদের বাড়িতে আশ্রয় দেন। অস্ত্র-গোলাবারুদ জমা রাখেন। নিজের গাড়িতে করে বহন করেন। এবং এসব করতে গিয়ে ধরাও পরেন। একদম শেষ মুহূর্তে। ১৪ ডিসেম্বর। ধানমন্ডিতে। আল বদর বাহিনীর হাতে। বেঁচে যান স্রেফ ভাগ্যের জোরে। তার দুই দিন পর যখন চূড়ান্ত বিজয় ধরা দেয়, খুশিতে অনেক্ষণ কেঁদেছিলেন আব্দুস সামাদ।
স্বাধীন বাংলাদেশে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করেন আবার। ১৯৭৩-৭৪-এ শেষ করেন আইল ভাঙার গল্পটা। তবে এ যাত্রায় ভূমি ব্যবস্থার পরিবর্তনের স্বপ্নের সেই প্রাথমিক গল্পে যোগ হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা। সব মিলিয়ে দৈর্ঘ্য অনেক বড় হয়ে যায়। এমনিতেই উপমহাদেশের গড়পরতা চলচ্চিত্রের দৈর্ঘ্য ইউরোপ-আমেরিকার চেয়ে এক-তৃতীয়াংশ বেশি। আর আবদুস সামাদের স্বপ্নের গল্পটা হয়ে যায় তারও দ্বিগুণ! আর তাই সেটাকে ভাগ করেন দুই ভাগে। বানান দেশের প্রথম সিক্যুয়েল বা পার্বিক চলচ্চিত্র ‘সূর্যগ্রহণ’ ও ‘সূর্য্য সংগ্রাম’। প্রথমটা মুক্তি পায় ১৯৭৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর। দ্বিতীয়টা ১৯৭৯ সালের ২০ এপ্রিল।
দুটো ছবিই বিপুল প্রশংসিত হয়। ঘরে তোলে একগাদা পুরস্কার। দুটোই অংশ নেয় মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে। তখন উৎসবটি এক বছর পর পর হতো। ‘সূর্যগ্রহণ’ অংশ নেয় ১৯৭৭ সালের দশম আসরে। আর ‘সূর্য্য সংগ্রাম’ ১৯৭৯ সালের একাদশে।
তবে শেষবারে আরো বড় কিছু হতে যাচ্ছিল। সেবার বাংলাদেশ থেকে প্রাথমিকভাবে পাঁচটি চলচ্চিত্রের নাম পাঠানো হয়েছিল।আব্দুস সামাদের ‘সূর্য্য সংগ্রাম’, সুভাষ দত্তের ‘ডুমুরের ফুল’ (শিশু চলচ্চিত্র শাখায়), আবদুল্লাহ আল মামুনের ‘সারেং বৌ’, আজিজুর রহমানের ‘অশিক্ষিত’ ও নারায়ণ ঘোষ মিতার ‘অলঙ্কার’। শেষ মুহুর্তে আরেকটি ছবি যোগ করা হয়। আমজাদ হোসেনের ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’।
সেবার উৎসবে ১১০ দেশ থেকে ৪৬৫টি চলচ্চিত্র জমা পরেছিল। জুরি বোর্ড তার থেকে ৩৫টি বাছাই করে মূল প্রতিযোগিতার জন্য। সেই তালিকায় জায়গা করে নেয় ‘সূর্য্য সংগ্রাম’। সেই প্রথম বাংলাদেশের কোনো চলচ্চিত্র নির্বাচিত হয় কোনো আন্তর্জাতিক উৎসবের মূল প্রতিযোগিতায়।
২২ আগস্ট ‘সূর্য্য সংগ্রাম’ প্রদর্শনের কথা ছিল। কিন্তু কোনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই সেদিন দেখানো হয় ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’। অভিযোগ ওঠে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের সভাপতিসহ কয়েক জন সদস্যের হস্তক্ষেপের। সে খবর ঢাকায় পৌঁছালে শুরু হয় তুমুল বিতর্ক। অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ, বিবৃতি-পাল্টা বিবৃতি থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপতিকে স্মারকলিপি পর্যন্ত দেয়া হয়।
উৎসবে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের সভাপতি ছিলেন তৎকালিন তথ্য ও বেতারমন্ত্রী হাবিবুল্লাহ খান। তিনি ১ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলন ডেকে সাফ বলে দেন, বাংলাদেশের কোনো ছবি প্রতিযোগিতার জন্য মনোনীত হয়নি। ‘সূর্য্য সংগ্রাম’ প্রথমে প্রদর্শনের জন্য মনোনীত হয়েছিল। কিন্তু পরে সিক্যুয়েলের অংশ ও সাদা-কালো বলে উৎসব কমিটিই সে ছবি বদল করে।
পরদিন পাল্টা সংবাদ সম্মেলনে আব্দুস সামাদ সপ্রমাণ হাজির হন। জানান, ‘সূর্য্য সংগ্রাম’ প্রতিযোগিতায় মনোনীত হওয়ার কাগজপত্র উৎসব কমিটি তাকে পাঠিয়েছেন। শুধু তাই নয়, সোভিয়েত ‘ফিল্ম আর্ট ম্যাগাজিন’ ছবিটিকে অ্যাপ্রিসিয়েশন সার্টিফিকেটও দিয়েছে। সেটা এমনকি সাংবাদিকদের দেখানও তিনি। উপস্থিত ছিলেন আলমগীর কবির, বাদল রহমানের মতো দেশবরেণ্য পরিচালকরাও।
কিন্তু এত কিছু করেও কোনো লাভ হয়নি। আর আসল ক্ষতি তো আগেই হয়ে গেছে। প্রতিযোগিতার জন্য মনোনীত হয়েও তাতে অংশ নিতে পারেনি ‘সূর্য্য সংগ্রাম’। ঠিক যেন আব্দুস সামাদের ব্যক্তিজীবনের গল্প। ভালোবাসার মানুষ রোজীকে পেয়েও যেমন হারাতে হয়েছিল!