সিনেমায় ভিলেন হইতে না পারাটা বরং নারী সত্তার অসম্মান
‘পরাণ’ সিনেমায় নায়িকাকে ভিলেন হিসেবে দেখানো হইছে বলে অনেকের অনেক নারীবাদী অভিযোগ দেখলাম।
আমি মনে করি, পরাণে বিদ্যা সিনহা মিমের চরিত্রকে মূল অপরাধী হিসেবে দেখানো খুব ঠিক আছে। বরং রায়হান রাফীকে আমি ব্যক্তিগতভাবে সাধুবাদ জানাইতে চাই যে তিনি তার সিনেমায় (উপমহাদেশের চলতি থিওরি ফলো করে) মিমের চরিত্রের ‘খারাপ নারী’ হবার পেছনে কোন ফালতু জাস্টিফিকেশন মার্কা গল্প ফাঁদেন নাই।
নারী চরিত্ররা পুরুষের মতো খারাপ হতে পারবে না কেন? চরিত্রহীনই বা হতে পারবে না কেন?
‘নারী’কে ‘নারী’ তো আমরা বানাইছি। নারী তো তার আগে মানুষ। পুরুষের মতোই দোষে-গুণে মানুষ। ‘নারী মায়ের জাত, মমতার জাত, মেয়েরা এমন কোন অপরাধ করতে পারে না’— এইসব তো চাপানো স্টেরিওটাইপ। সোস্যাল প্রেশার।
নারী তার নিজ যোগ্যতায় সমাজের সকল বাধা ভেঙে চাঁদে পর্যন্ত চলে গেছে, সেটা যেমন সত্যি, তেমনি নারী-পুরুষের মতো সকল ধরনের অপরাধেও নিজেকে জড়াচ্ছে সেটাও সত্যি। এটাই তো নারীর ক্ষমতায়ন। তাহলে নাটক-সিনেমায় কেন নারীকে ক্রিমিনাল হিসেবে দেখানো যাবে না?
নারীর ক্রিমিনাল হওয়াটাকে জাস্টিফাই না করে আমাদের সাবকন্টিনেন্টে এখনও মেয়েদের ভিলেন চরিত্রে দেখানো টাফ। কারণ মুক্তি পাবার পর নারীবাদীরা সেই সিনেমা এবং সিনেমার পরিচালককে হাইকোর্ট দেখাবে। এই ফিয়ার ফ্যাক্টরটা বোধহয় সাংঘাতিকভাবে কাজ করে প্রোডিউসার-ডিরেক্টরের মাথায়।
যার ফলে কোন রিস্ক নিতে চান না অনেকে। হাতে গোনা খুব কম সিনেমাই সেই সাহসটা দেখাতে পেরেছে।
ফিমেইল ক্রিমিনালিটি নিয়ে আমাদের পপুলার ন্যারেটিভগুলা দেখবেন কোন না কোনভাবে মিস্যান্ড্রিক। আমাদের দেশের সিনেমাগুলাতে নারীর ভিলেনিয়াস সত্তাকে ঘরোয়া কূটনামির মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে রাখা। তাই ‘নারী ভিলেন’ শব্দটা শুনলেই আমাদের চোখে রওশন জামিল কিংবা রিনা খানদের অবতার ভেসে উঠে। নারীর খারাপ সত্তাকে সিনেমায় এইরকম বামন করে রাখার যে পপুলার প্র্যাকটিস জারি আছে সেটা এদেশের ফেমিনিস্টরা খুব পছন্দ করেন। কিন্তু একটু গভীরে ঢুকলেই তারা বুঝতেন এই প্র্যাকটিসটা দিনশেষে পুরুষতন্ত্রকে আরো প্রগাঢ় করে বরং।
নারীদের পুরুষের মতো শুধু রাস্তায় সিগারেট ফুকা, অবাধ চলাফেরা কিংবা স্বল্প বসনের অধিকার দিয়েই নারীবাদীরা খুশি থাকতে চান। অথচ খুন, বহুগামিতা, হোয়াইট কলার ক্রাইম, মাফিয়াগিরি, সন্ত্রাসী কার্যকলাপ, লুটতরাজ থেকে তারা নারীদের দূরে রাখতে চান কেন?
কখনো ভেবে দেখেছেন কেন?
কারণ পুরুষতান্ত্রিক পুরুষের মত নারীবাদীরাও নারীকে দোষে-গুণে ‘পূর্ণাঙ্গ মানুষ’ ভাবতে পারে না। অলৌকিক স্যাক্রেড, দেবী টাইপ কিছু বানিয়ে রাখতে চায় আর কী। সিনেমায় নারীর শরীরের স্বতঃস্ফূর্ত রিপ্রেজেন্টশনকে তারা বল্ডনেস বা নারীর ক্ষমতায়ন হিসেবে প্রচার করতে পারেন, কিন্তু নারীর পুরুষের মতো করে খারাপ কাজ বা অপরাধ করা দেখানোটাকে স্বাভাবিকতা হিসেবে মেনে নিতে পারেন না।
সিনেমায় একজন পুরুষ ভিলেন যতটাই ডেঞ্জারাস কিংবা চরিত্রহীন হোক না কেন তার ক্রাইমের বা ক্রিমিনাল হবার জন্য তার পেছনের গল্প টানার যেমন আলাদা করে দরকার পড়ে না ঠিক তেমনি একজন নারীকেও একইভাবে ভিলিফাই করতে না পারাটাই বরং নারীর প্রতি অসম্মাননা। নারীর ‘দেবীত্ব’ আর যাই হোক নারীকে ‘মানুষ’ হিসেবে পূর্ণতা দেয় না।
‘পরাণ’ খুব সম্ভবত বাংলাদেশের প্রথম সিনেমা যেখানে ফিমেইল লিডকে তার অপরাধের কোন কার্যকারণ দেখানো ছাড়াই অপরাধী হিসেবে রিপ্রেজেন্ট করা হয়েছে। একটি মেয়ে যেমনটা হতেই পারে সেভাবেই রিপ্রেজেন্ট করা হয়েছে। তাই সুক্ষ্মভাবে চিন্তা করলে ‘পরাণ’ এ দেশের নারীবাদকে একটা হিপোক্রেটিক সংকীর্ণতা থেকে বের করে এক ধাপ সামনেই নিয়ে গেছে।