সিনেমা ব্যবসার মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে ২০-৩০ আসনের মিনিপ্লেক্স
দেশে সিঙ্গেল স্ক্রিনের আধিপত্য শেষ হওয়ার পাশাপাশি মাল্টিপ্লেক্সের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে অনেকদিন ধরে। সে তুলনায় মাল্টিপ্লেক্সের বিকাশ ও বিস্তার এখনো সীমিত। এর মাঝে ২০-৩০টি সিটের মিনিপ্লেক্স নিয়ে কথা উঠেছে। সম্প্রতি আহমেদ জামান শিমুল এক প্রতিবেদনে জানান, অল্প সিটের মিনিপ্লেক্স থেকে একজন প্রযোজক সিঙ্গেল স্ক্রিনের চেয়ে বেশি শেয়ার মানি পেতে পারে। নিচে তার প্রতিবেদন ও ফেসবুক পোস্ট থেকে নির্বাচিত অংশ তুলে ধরা হলো—
একটি করে পর্দা ও স্বল্পসংখ্যক আসন নিয়ে নারায়ণগঞ্জ ও সিরাজগঞ্জে চলছে দুটি মিনি সিনেপ্লেক্স। এ দুটি মিনি সিনেপ্লেক্সের অবস্থা বিশ্লেষণ করে অনুমান করা যায়, এ ধরনের উদ্যোগ সিনেমা ব্যবসায় নতুন সম্ভাবনা তৈরি করছে।
পরিত্যক্ত পার্কিংয়ে সিনেস্কোপ ও বাড়ির নিচতলায় রুটস সিনে ক্লাব
দেশের প্রথম মিনি সিনেপ্লেক্স নারায়ণগঞ্জের ‘সিনেস্কোপ’। ২০১৯ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ ছবিটি প্রদর্শনের মাধ্যমে নগরীর আলী আহাম্মদ চুনকা নগর পাঠাগার ও মিলনায়তন ভবনের আন্ডারগ্রাউন্ডে এটি চালু হয়। ৩৫ আসনের হলটির উদ্যেক্ততা স্থপতি ও চলচ্চিত্র নির্মাতা মোহাম্মদ নূরুজ্জামান ডালিম। মোট আটশ’ বর্গফুট জায়গার উপর নির্মিত হলে একটি কফি শপ রয়েছে। এতে ফোর কে রেজ্যুলেশনের পর্দা এবং ৭.১ ডলবি ডিজিটাল সাউন্ড সিস্টেম ব্যবহার করা হয়েছে। এখানকার সদস্যদের জন্য রয়েছে আজীবন ১০ শতাংশ ছাড়ের ব্যবস্থা। এছাড়া তাদের জন্য আলাদা শোয়ের ব্যবস্থাও করা হয়। প্রতিদিন এখানে ৪টি করে শো হয়। টিকেটের দাম ২০০ টাকা। দেশ বিদেশের ছবি মিলিয়ে শতাধিক ছবি এখানে প্রদর্শিত হয়েছে।
হলটির নির্বাহী পরিচালক রবি জানান, মোহাম্মদ নূরুজ্জামান ডালিম আলী আহাম্মদ চুনকা নগর পাঠাগার ও মিলনায়তন ভবনের স্থপতি ছিলেন। মিলনায়তনটি নির্মাণের পর বহুদিন এর আন্ডারগ্রাউন্ডে গাড়ি পার্কিংয়ের একটি অংশ অব্যবহৃত ছিল। এক সময় তা ময়লা অবর্জনায় ভরে যায়। তখন মোহাম্মদ নূরুজ্জামান ডালিম নারায়ণগঞ্জ সিটি মেয়র সেলিনা হায়াত আইভির কাছে এখানে একটি হল করার অনুমতি চান। মেয়র দ্রুতই অনুমতি দেন।
তিনি আরও বলেন, ‘চলচ্চিত্রের প্রতি ভালোবাসা থেকেই আমরা এ হলটি করেছি। আমারা নারায়ণগঞ্জে আরও দুটি হল করব। এছাড়া দেশের প্রতি জেলায় একটি করে আমাদের শাখা করার ইচ্ছে আছে।’
সিরাজগঞ্জের ধানবান্ধীর জেসি রোডে অবস্থিত ‘রুটস সিনেক্লাব’। এর উদ্যোক্তা সিরাজগঞ্জের সংস্কৃতিকর্মী সামিনা ইসলাম নীলা। মোট আড়াই হাজার বর্গফুট আয়তনের হলে আসন সংখ্যা ২২। এতে রয়েছে কফি শপ, ফোর কে রেজ্যুলেশনের পর্দা, ১১.২ ডলবি অ্যাটমোস্ফিয়ার সাউন্ড সিস্টেম। টিকেটের দাম ২০০ টাকা। স্থানীয় শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে একটি সিনেক্লাব রয়েছে। যারা এখানে অর্ধেক ছাড়ে ছবি দেখতে পারেন। ২০২১ সালের ২২ অক্টোবর ক্লাবটির সদস্যদের পছন্দের ছবি প্রদর্শনের মাধ্যমে এর উদ্বোধন করা হয়। তবে এখানে বাণিজ্যিক প্রদর্শন শুরু হয় ‘মিশন এক্সট্রিম’র মাধ্যমে। এখন পর্যন্ত ১০টির মতো বাংলা ছবি প্রদর্শিত হয়েছে এখানে।
সামিনা ইসলাম নীলা জানান, যশোরে তাদের আরেকটি শাখা খোলার ব্যাপারে কথা চলছে। এছাড়া সিরাজগঞ্জেও নতুন শাখা খুলবেন তারা। দেশের কোনো জায়গা থেকে যদি কেউ তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাহলে তারা সেখানেও শাখা করতে সহায়তা করবেন।
ব্যবসা প্রসঙ্গে রুটস সিনেক্লাবের চেয়ারম্যান নীলা বলেন, ‘এবারের ইদে এখানে শান চলছে। দর্শকরা আসছেন, ছবিটি ভালো চলছে। এর আগে এখানে মিশন এক্সট্রিম, রাতজাগা ফুল, মুখোশ, মৃধা বনাম মৃধা ভালো চলছে। এ ধরনের ভালো ছবি নিয়মিত পাচ্ছি না। পেলে আমরা ব্যবসায়িকভাবে লাভের মুখ দেখব। প্রতি মাসে আমাদের প্রায় ৫০ হাজার টাকা ভুতর্কি দিতে হচ্ছে। তবে আশা করছি খুব শিগগিরই আমরা ব্রেক ইভেনে পৌঁছে যাব।’
২০১৯ এ চালুর পর করোনার কারণে ২০২০ সালে আট মাস এবং ২০২১ সালে ছয় মাস করে মোট ১৪ মাস বন্ধ ছিল সিনেস্কোপ। এরপর করোনার প্রভাবে দর্শক কিছুটা কমে আসে। তবে এবারের ইদে ‘শান’র প্রতিটি শো হাউজফুল ব্যবসা করেছে। শনিবার (৭ মে) পর্যন্ত সব শো’য়ের টিকিট অগ্রিম বিক্রি হয়ে গেছে।
সিনেস্কোপের পরিচালক রবিও জানালেন, নিয়মিত ভালো ছবি এলে তারা ভালোভাবেই হলটি চালিয়ে নিতে পারবেন। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন, বর্তমানে পাইপলাইনে অনেকগুলো ভালো বাংলা ছবি রয়েছে। এগুলো মুক্তি পেলে দর্শকরা নিয়মিত হলমুখী হবেন। তখন এ ধরনের হল সারাদেশে অনেক বেশি হবে।
এ ছাড়া বগুড়ার মম ইন মুভি থিয়েটারে রয়েছে ৪০ সিট। এখানে টিকিটের দাম ২০০ টাকা। চট্টগ্রামের সিলভার স্ক্রিন মাল্টিপ্লেক্সের একটি হলের আসনসংখ্যা ১৮ হলের এর টিকিটের দাম অনেক চড়া।
মিনি সিনেপ্লেক্স নির্মাণে খরচ
রুটস সিনেক্লাবের চেয়ারম্যান নীলা জানান, হলের জায়গাটি তাদের নিজেদের হওয়ায় নির্মাণ বা ক্রয় বাবদ আলাদা কোনো খরচ হয়নি। তবে হলের আসন, প্রজেকশন মেশিন, সাউন্ড সিস্টেম, সিল্ভার স্ক্রিন ও অন্যান্য সাজসজ্জা মিলিয়ে ৬৯ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। আর জায়গার দামসহ ধরলে ১ কোটি ৪২ লাখ টাকা খরচ।
প্রযোজকের লাভ কতটুকু
২০০ টাকার টিকিটে প্রবেশ মূল্য হিসেবে ধরা হচ্ছে ১৩০-১৪০ টাকা। বাকি টাকা বিভিন্ন ট্যাক্স ও হলের পরিচালন খরচ। প্রবেশ মূল্যের অর্ধেক একজন প্রযোজক পান। অবশ্য দ্বিতীয় সপ্তাহে গিয়ে ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ পান। এ ধরনের হলগুলোতে সাধারণত শো ফাঁকা যায় না। তাতে কোনো ছবি প্রতিদিন চার শো করে এক সপ্তাহ চললে শেয়ার মানি বাবদ ৫০ থেকে ৬৭ হাজার টাকা পর্যন্ত পাবে।
অনেকের কাছে মনে হতে পারে সপ্তাহে ৫০ হাজার টাকা অনেক কম। কিন্তু দেশের অধিকাংশ সিনেমা হল এক সপ্তাহে ৫০ হাজার টাকা শেয়ার মানি দেয় না বা দিতে পারে না। যে হলগুলো ৫০ হাজার বা ১ থেকে ৪ লাখ পর্যন্ত শেয়ার মানি দিত সেগুলোর আসন সংখ্যা কিন্তু ১ হাজারের উপরে। তাও এ ধরনের হল দেশে সব মিলিয়ে চালু আছে ২০-৩০টার মত। তাদের অধিকাংশ শো হাউজফুল যাওয়ার পর প্রযোজক ওই টাকা পেতেন। তাও ঢাকার বুকের নাম করা এক হলে ১৫০ টাকার টিকেটে ৬০ টাকা প্রবেশ মূল্য। অর্থাৎ প্রযোজকের পকেটে মাত্র ৩০ টাকা। শতকরা ২০ টাকা।
এখন এ ধরনের মিনি সিনেপ্লেক্স সারাদেশে ১০০ টি হলে কোন ছবি এর মধ্যে ৪০-৫০ টি হলে মাত্র এক মাসে হল থেকে টাকা তুলে ফেলা সম্ভব। কারণ সিনেপ্লেক্স বা মিনি সিনেপ্লেক্সেগুলোর টিকেট বিক্রিতে কোন প্রকার অস্বচ্ছতা নেই। যার কারণে একজন প্রযোজক তার বিনিয়োগ ফেরতের নিশ্চিয়তা পাচ্ছেন ছবি মুক্তির আগেই। আর এখন ছবি ভালো হলে বা আলোচিত হলে তো স্পন্সর, ওটিটি রাইটস, টিভি রাইটস, ডিজিটাল রাইটস, মিউজিক রাইটস ইত্যাদি নানা খাত থেকে টাকা পাচ্ছেন। দেশের বাইরেও মুক্তি দিয়ে টাকা পাচ্ছেন।
সব মিলিয়ে সিনেমার ব্যবসা ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য দরকার এ ধরনের নানা উদ্যোগের। ১৫০-২০০ আসনের সিনেপ্লেক্সের পাশাপাশি, সময় এখন ২০-৫০ আসনের মিনি সিনেপ্লেক্স নিয়ে ভাবার।