Select Page

সিনেমায় নজরুল

সিনেমায় নজরুল
Kazi nazrul islam poet in film

নজরুল আমাদের জাতীয় গর্ব, সম্পদ। তাঁর জীবনটাই বলতে গেলে চলচ্চিত্র হবার জন্য যথার্থ। কারণ, তিনি যে জীবনকে দেখেছেন তার পরতে পরতে ছিল সংগ্রাম।রুটির দোকানে কাজ করা নজরুল, লেটো গানের নজরুল, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সৈনিক নজরুল, কবিতার বলিষ্ঠ কণ্ঠের নজরুল, প্রেম-মানবতার নজরুল, নার্গিস-প্রমীলার নজরুল, বাকশক্তি হারানো নজরুল এগুলোকে জড়ো করলে ‘চলৎ+চিত্র’ বিষয়টা অনায়াসে জীবন্ত হয়ে যায়। সেরকম মুন্সিয়ানা দেখানো নির্মাতা থাকলে নজরুলকে নিয়ে মাস্টারপিস সিনেমা হতেই পারে।

নজরুল ২০-২১টি ছবির সঙ্গে সরাসরি ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। এসব ছবির মধ্যে রয়েছে : জলসা (আবৃত্তি ও গান), ধূপছায়া, প্রহলাদ, বিষ্ণুমায়া, ধ্রুব, পাতালপুরী, গ্রহের ফের, বিদ্যাপতি (বাংলা), বিদ্যাপতি (হিন্দি), গোরা, সাপুড়ে (বাংলা), সাপেড়া (হিন্দী), নন্দিনী, চৌরঙ্গী (বাংলা), চৌরঙ্গী (হিন্দি), দিকশূল, অভিনয় নয়, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম (প্রামাণ্য চিত্র), বিদ্রোহী কবি (প্রামাণ্য চিত্র), কবি নজরুল (প্রামাণ্য চিত্র), কাজী নজরুল ইসলাম (প্রামাণ্য চিত্র) ও একটি উর্দু ছবি।

নজরুল থিয়েটারের সাথে জড়িত হন সিনেমা নিয়ে কাজ করার জন্য। তাঁর সঙ্গীত পরিচালনা ও গান রচনায় গিরিশচন্দ্রের ‘ধ্রুবচরিত’ নিয়ে নির্মিত হয় ‘ধ্রুব’ সিনেমা। নিজে অভিনয় করেন এ সিনেমায়। তাঁর নিজের কণ্ঠে ‘ফুটিল মানস মাধবী কুণ্জে’ নামে একটি গানও অাছে সিনেমায়।মুক্তি পেয়েছিল ১৯৩৪ সালের ১ জানুয়ারি। সিনেমায় নজরুলের অভিনয় প্রশংসিত ও দারুণভাবে অালোচিত হয়।এর পাশাপাশি অারো কিছু সিনেমায় নজরুল অভিনয়ের পাশাপাশি সঙ্গীত পরিচালনা করেন।

নজরুলের সাহিত্য নিয়ে সিনেমা হয়েছে। তবে দূরত্ব আছে বেশকিছু। উপন্যাস, কবিতা, গল্প মিলিয়ে সিনেমা আরো হতে পারত, হয়নি। মোটের উপর যে কয়েকটি কাজ হয়েছে প্রশংসনীয়। তবে সম্পূর্ণ একটি গল্প নিয়ে কাজ হলেও গানের ব্যবহার করে কাজ হয়েছে।

‘জীবন থেকে নেয়া’ সিনেমায় মাস্টারমেকার জহির রায়হান পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসককে নিজেদের জাতিগত শক্তি জানান দিতে নজরুলের গান ব্যবহার করেছেন।

‘কারার ঐ লৌহ কপাট
ভেঙে ফেল কররে লোপাট
রক্ত জমাট শিকল পূজোর পাষাণ বেদী।’

নজরুলের বজ্রকণ্ঠের চেতনা বাঙালি জাতীয়তাবাদকে ভেতর থেকে জাগিয়ে দিয়েছিল জহির রায়হানকেও।পর্দায় গানের আবেদনকে জীবন্ত করতে তাই লিজেন্ড আনোয়ার হোসেনের লিডিং রোল যুৎসই ছিল। গানটি দেখার সময় দর্শক হিশেবে টের পাই রক্ত যেন টগবগ করছে।

মুশফিকুর রহমান গুলজার পরিচালিত ‘মেহেরনেগার’ করুণ প্রেমের কাহিনী নজরুলের। মেহেরনেগার-ইউসুফের প্রেমকে করুণ পরিণতিতে নিয়ে নজরুল বরাবরের মতোই প্রেমপিয়াসী হৃদয়ের প্রমাণ দেন। সিনেমায় বাইজী মেহেরনেগার মৌসুমী এবং প্রেমিক ইউসুফ ছিল ফেরদৌস। অনবদ্য ছিল তাদের অভিনয়।গানের ব্যবহার সিনেমাটিকে উপভোগ্য করেছে। ‘দূরদ্বীপবাসিনী, ‘প্রিয় এমনো রাত যেন যায় না বৃথাই’ গান দুটোতে মৌসুমীর পারফরম্যান্স চোখ জুড়ানো। ফেরদৌসের গুরু প্রবীরমিত্রের মেয়ের চরিত্রে ইরিন জামানও চমৎকার অভিনয় করেছে। তার লিপে ‘হলুদ গাঁদার ফুল’ গানটি অনবদ্য। একটা সিকোয়েন্সে ফেরদৌস বাঁশি বাজায় আর ইরিন পেছন থেকে তাকে জড়িয়ে বলে- ‘আপনার বাঁশির সুর যে কোনো নারীর মনকে উতলা করে দেবে। আপনি শুধুই বাঁশি বাজানোর জন্য বাঁশি বাজান না। ‘অসাধারণ রোমান্টিক সংলাপ যা নজরুলের পক্ষেই লেখা সম্ভব।মৌসুমী ভালোবাসার জন্য শেষ পর্যন্ত জীবন দিয়ে দেয়। ফেরদৌস তার সমাধিতে এসে কাঁদে। ক্লাইমেক্সটি বেদনার হয়ে ওঠে।

রাক্ষুসী’ নজরুলের নামকরা গল্প। মতিন রহমান চমক দেখান রোজিনাকে দিয়ে। ফেরদৌসের সাথে জুটি বেঁধে রোজিনার দাপুটে অভিনয় ছিল সিনেমাটির প্রাণ। পূর্ণিমাও কম ছিল না। সংসারে অনেক সমস্যায় পড়ে শেষ পর্যন্ত ভালোবেসে বিয়ে করা বিন্দিয়া রোজিনাকে অবহেলা করতে থাকে পূর্ণিমার জন্য। বিবাহিত পরুষের অন্য মেয়ের প্রতি আকর্ষণ কোনো স্ত্রী-ই মেনে নেয় না। তাই রোজিনা শেষ পর্যন্ত ফেরদৌসকে খুন করার সিদ্ধান্ত নেয়।যখন দা-এর কোপ বসিয়ে দেয় তখন ফেরদৌস ভুল ভেঙে রোজিনার কাছেই ফিরে এসেছিল। তাই সংলাপটা বেদনা দেয়- ‘হামি তো তোর কাছেই ফেরত আইলাম রে বিন্দিয়া। ‘বিস্মিত রোজিনা তখন ডুকরে কাঁদতে থাকে।ততক্ষণে স্বামী অনন্তকালে।

গীতালি হাসান নজরুলের ‘অতৃপ্ত কামনা’ গল্প নিয়ে সিনেমা বানালেন ‘প্রিয়া তুমি সুখী হও। ‘সিনেমাটি আরো ভালোমত নির্মাণ করা যেত। এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে অনেকটাই বাণিজ্যিক আদলে বানিয়েছেন। প্রথমে গভীর প্রেম পরে বিচ্ছেদের করুণ গল্প এটাও। ফেরদৌসের সাথে নবাগতা শায়লা সাবি অসাধারণ অভিনয় করেছে।তার অভিনয় দেখে মনে হয়নি প্রথম কাজ দেখছি। সিনেমায় কস্টিউম ভালো ছিল এবং লোকেশনেও গল্পের সময়কে ধরার চেষ্টা ছিল।

শওকত জামিল নির্মিত ‘একজন সঙ্গে ছিল’ সিনেমাটিতে নজরুলের ‘মোর ঘুমঘোরে এলে মনোহর’ গানটির অনবদ্য উপস্থাপনা দেখে ভীষণ আপ্লুত হতে হয়। সৈয়দ শামসুল হকের কাহিনী হলেও নজরুলের গানের ব্যবহার মুগ্ধ করেছে। রিয়াজ ও সুষমা গানটিতে অন্যরকম ভালো লাগা আনে। খুব যত্নের কাজ। গানটি যেমন রোমান্টিক অভিনয়ও তেমনি ছিল।

নজরুলের সাহিত্য নিয়ে আরো সিনেমা হওয়া উচিত। বিশেষ করে তাঁর জীবনের ওপর মাস্টারপিস কাজ করা যেতে পারে। এছাড়া তাঁর ‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাসটিও সিনেমা হতে পারে।

নজরুল সিনেজগতে আরো উঠে অাসুক।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র গত শতকে যেভাবে সমৃদ্ধ ছিল সেই সমৃদ্ধির দিকে আবারও যেতে প্রতিদিনই স্বপ্ন দেখি। সেকালের সিনেমা থেকে গ্রহণ বর্জন করে আগামী দিনের চলচ্চিত্রের প্ল্যাটফর্ম গড়ে উঠুক। আমি প্রথমত একজন চলচ্চিত্র দর্শক তারপর সমালোচক হিশেবে প্রতিষ্ঠিত হবার স্বপ্ন দেখি। দেশের সিনেমার সোনালি দিনের উৎকর্ষ জানাতে গবেষণামূলক কাজ করে আগামী প্রজন্মকে দেশের সিনেমাপ্রেমী করার সাধনা করে যেতে চাই।

মন্তব্য করুন