আমিন খান সফল না হওয়ায় ভুগেছে ঢালিউডও
আমিন খান নাম নিয়ে ছবির এই তরুণটি চলচ্চিত্রে এসেছিলেন সেই ৯০ দশকে। ১৯৯৩ সালে মোহাম্মদ হোসেন প্রযোজিত ও পরিচালিত ‘অবুঝ দুটি মন’ ছবি দিয়ে চলচ্চিত্রে পদার্পণ করেন যেখানে তার বিপরীতে ছিলেন সেই সময়ের জনপ্রিয় মডেল রথি যার পর্দায় নাম ছিল ‘চাঁদনী’ ( ব্যান্ড শিল্পী জেমসের প্রথম স্ত্রী)।
নায়িকা চাঁদনী ‘অবুঝ দুটি মন’ ছবির পর হারিয়ে গেলেও আমিন খান রয়ে যান। ‘অবুঝ দুটি মন’ ছবিটি মুক্তি পাওয়ার আগেই আলোচিত সমালোচিত হয়েছিল কিছু কারণে কিন্তু ছবিটি ব্যবসায়িকভাবে সুপারহিট হয়েছিল এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। মোহাম্মদ হোসেনের ‘অবুঝ দুটি মন’ আমার কাছে ফালতু ছবির নমুনায় থাকা ছবিগুলোর একটি কিন্তু আমিন খানের সেখানে কোন দোষ ছিল না কারণ আমিন খানের সেটাই প্রথম ছিল।
‘অবুঝ দুটি মন’ ছবির পর আমিন খান এগিয়ে যান বেশ প্রতিশ্রুতিশীল ও সম্ভাবনাময় হিসেবেই। নবীন সালমান-সানী, তরুণ রুবেল-মান্না ও প্রবীণ জসীম, কাঞ্চন, আলমগীর, সোহেল রানা’র দাপটে দর্শকদের তখন আমিন খান নিয়ে আলাদাভাবে ভাবার অবকাশ ছিল না। তবুও আমিন খান আলাদাভাবে নজর কাড়েন দিলীপ সোম পরিচালিত মিউজিক্যাল লাভ স্টোরি ‘হৃদয় আমার’, ‘হৃদয় থেকে হৃদয়’, বাদল খন্দকারের ‘দুনিয়ার বাদশা’, ‘বিশ্বনেত্রী’, জামসেদুর রহমানের ‘লাভ লেটার’, তাহের উদ্দিন ঠাকুরের ‘মহাভুমিকম্প’, মোহাম্মদ হোসেনের ‘বীরসন্তান’-এর মতো ছবিগুলো দিয়ে।
বাংলা চলচ্চিত্রের সেরা যুগে আগমন করেছিলেন বলেই হয়তো আমিন খান খুব বেশি গুরুত্ব পায়নি কিন্তু নায়কোচিত সবকিছুই আমিন খানের মাঝে বিদ্যমান ছিল। তাকে সবচেয়ে ভালো ব্যবহার করেছিলেন প্রয়াত দিলীপ সোম তার দুটো রোমান্টিক ছবিতে। সেই সময় তরুণ প্রজন্মের দর্শকদের কাছে নবীন সালমান সানীর পর আমিন খান ছিলেন তৃতীয় পছন্দের নায়ক। যিনি জসীম, কাঞ্চন, রুবেল, মান্না, ওমর সানী’র মতো সময়ের তারকা অভিনেতাদের সঙ্গে একই ছবিতে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছিলেন। অ্যাকশন ও রোমান্টিক দুটো ধারাতেই আমিন খান নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন।
সালমানের মৃত্যু ও সানীর বিদায়ের পর অশ্লীল যুগে শরিফ উদ্দিন খান দিপু, মোস্তাফিজুর রহমান বাবু, এম এ রহিম, এম এ আউয়াল, পল্লী মালেক, রাজু চৌধুরী, বাদশা ভাই , এনায়েত করিম, মোহাম্মদ হোসেনের মতো প্রযোজক পরিচালকদের খপ্পরে পরে পুরো ক্যারিয়ারটাই ধ্বংস করে দেন আমিন খান। তা না হলে সেই সময় মান্না ও রিয়াজের সঙ্গে সামাজিক অ্যাকশন রোমান্টিক দুই ধারার ছবিতেই আমিন খানকে খুব ভালোভাবেই ব্যবহার করা যেতো।
অশ্লীল যুগে এফ আই মানিকের ‘হৃদয়ের বন্ধন’, ‘ফুল নেবে না অশ্রু নেবে’ এবং মোহাম্মদ হোসেনের ‘আজ গায়েহলুদ’ (কাজী জহিরের ‘অবুঝ মন’ ছবির রিমেক) ছবিগুলোতে বেশ ভালোই অভিনয় করেছিলেন। এসব ভালো ছবির বিপরীতে সেই সময় আমিন খানের অনেকগুলো অশ্লীল ছবি থাকায় আলাদাভাবে নজর কাড়তে পারেননি। তিনি সময় থাকতেই ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছেন অথচ তার কাছ থেকে ভালো কিছু পাওয়ার সম্ভাবনা এখনও অনেক আছে। শুধু দরকার যোগ্য প্রযোজক, পরিচালক যারা আমিন খানকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারবেন।
এবার আসি একটু অন্য প্রসঙ্গে। বেশ কিছুদিন আগে আমিন খানের একটা সাক্ষাৎকার প্রথম আলোয় পড়লাম। সেখানে আমিন খান বেশ কিছু বিষয়ে খোলামেলা বলেছেন সেই ব্যাপারে কিছু বলতে চাই— ৯০ দশকের নিয়মিত একজন সিনেমা দর্শক হিসেবে।
আমিন খান বলেছিলেন তিনি ‘ইন্ডাস্ট্রির নোংরা রাজনীতির শিকার’ এই ব্যাপারে আমি সম্পূর্ণ সহমত। আমিন খানকে নিয়ে আজ থেকে ৫ বছর আগে উপরের বিস্তারিত লেখায় এই কথাটাই বোঝাতে চেয়েছিলাম। সেই সময়ের সিনেমা হলের নিয়মিত দর্শক হিসেবে আমিন খানকে প্রথম দেখেছিলাম মোহাম্মদ হোসেনের ‘অবুঝ দুটি মন’ সিনেমায়। ছবিটিতে সুদর্শন আমিন খানকে ভালো লাগলেও ছবিটি আমার ভালো লাগেনি যদিও ‘অবুঝ দুটি মন’ সুপারহিট হয়েছিলো। এরপর বাদল খন্দকারের ‘দুনিয়া বাদশা’ সিনেমায় দেখি এবং প্রথম মনে হয়েছিলো সালমান শাহ, ওমর সানীর মতো আরেকজন নায়ক পাওয়া গেলো যাকে কাজে লাগাতে পারলে ভালো। কিন্তু তাকে সেই সময় আলমগীর পিকচার্স, আনন্দ মেলা চলচ্চিত্র, হাসনাবাদ কথাচিত্র, মৌসুমী কথাচিত্র, যমুনা ফিল্মস, সানফ্লাওয়ার মুভিজ, এস এস প্রোডাকশন, জ্যাম্বসের মতো কোন বড় প্রোডাকশন হাউসের সিনেমায় পেলাম না। এমনকি এ জে মিন্টু, আজিজুর রহমান, কাজী হায়াৎ, দেওয়ান নজরুল, শিবলী সাদিক, মতিন রহমান, সোহানুর রহমান সোহান, শাহ আলম কিরণ, মনতাজুর রহমান আকবর, মনোয়ার খোকন, মালেক আফসারী, নাদিম মাহমুদ, এফ আই মানিক, জীবন রহমানের মতো ব্যস্ততম ও জনপ্রিয় পরিচালকদের সিনেমায় দেখতে পাইনি।
প্রবীণদের মধ্য এক দিলীপ সোম শুধু আমিন খানকে নিয়ে ‘হৃদয় আমার’ ও ‘হৃদয় থেকে হৃদয়’ দুটি রোমান্টিক গল্পের সিনেমা নির্মাণ করেছিলেন যার প্রথমটি সুপারহিট আর পরেরটি ফ্লপ হয়। এ ছাড়া আমিন খানকে সেই সময় এ গ্রেডের কোন পরিচালকের সিনেমায় দেখেছি বলে মনে পড়ে না। জামসেদুর রহমানের ‘লাভ লেটার’, আজিজ আহমেদ বাবুলের ‘দোস্ত আমার দুশমন’, মোহাম্মদ হোসেনের ‘বাংলার কমান্ডো’ এগুলোই ছিলো সেসময় আমিন খানের উল্লেখযোগ্য সিনেমা। অর্থাৎ শুরুর দিকে স্বনামধন্য প্রযোজক, পরিচালকদের সিনেমা থেকে বঞ্চিত ছিলেন। অথচ ওপরে উল্লেখিত প্রযোজনা সংস্থা ও পরিচালকদের মধ্য থেকে দু-তিনজন পরিচালক যদি সেই সময় আমিন খানকে কাজে লাগাতে পারতেন তাহলে হয়তো তার ক্যারিয়ার অন্যরকম হতো। যদিও পরবর্তীতে মনতাজুর রহমান আকবর, মালেক আফসারী, এফ আই মানিকের সিনেমায় সুযোগ পেয়েছিলেন কিন্তু সেটা অনেক দেরিতে, যখন সালমান শাহ নেই, ওমর সানী বিদায় নিচ্ছেন এমন সময়ে।
শুরু থেকেই মোহাম্মদ হোসেন, আজিজ আহমেদ বাবুল টাইপ পরিচালকদের সিন্ডিকেটে পড়ে গিয়েছিলেন যাদের সিনেমার মান, পরিচালনার মান খুব একটা ভালো পর্যায়ের না। অনেকে বলবেন তাদের তো অনেক সিনেমা সফল আছে, বাণিজ্যিক সিনেমায় সফলতাই সবকিছুর বিচারের মানদণ্ড নয়। ব্যক্তি ইমেজ ও পরিচালনার মানে তারা কখনো ওপরে উল্লেখিত পরিচালকদের মতো তখনকার দর্শকদের কাছে ছিলেন না। অশ্লীল ছবির পরিচালকদের সিন্ডিকেটে পড়ে গিয়েছিলেন যার ফলে আমিন খানকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো হয়নি।
আমিন খান একই সাক্ষাৎকারের মান্নার মৃত্যুর পর প্রোডাকশন বয়দের প্রযোজক হওয়ার কথা বললেন যা সম্পূর্ণ সঠিক এবং এরাই ইন্ডাস্ট্রির কফিনে সর্বশেষ পেরেকটা ঠুকে দিয়েছে একজন নায়কের সিন্ডিকেট গড়ে। তা না হলে মান্নার মৃত্যুর পরেও তাকে কাজে লাগানো যেতো। সবশেষে এইটুকুই বলবো নায়কোচিত সব ধরনের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও আমিন খানের মতো একজন সুদর্শন নায়কের কীভাবে ক্যারিয়ারের অপমৃত্যু হয় সেটা ইন্ডাস্ট্রিতে একটা উদাহরণ হয়ে থাকবে সব সময়।
৯০ দশকের গুনি পরিচালকরা ইন্ডাস্ট্রিতে নেই তাই মান্না মারা যাওয়ার পর নতুন পরিচালকরা হিট পাওয়া শাকিব খানের দিকে ঝুঁকে পড়ায় আমিন খানের দিকে ভালোভাবে কেউ নজর দেয়নি। তা না হলে যদি শাকিবের সঙ্গে সঙ্গে আমিন খানকে সঠিক ভাবে ব্যবহার করা যেতো তাহলেও বাণিজ্যিক মূলধারার চলচ্চিত্রে একটু হলেও প্রতিযোগিতা থাকতো এবং একটি সিন্ডিকেটের দখলে পুরো ইন্ডাস্ট্রি জিম্মি হয়ে যেতো না। গত কয়েক বছরে শাকিব খান বলয়ের একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পেছনে কিছু নির্মাতাদের অবহেলা, দূরদর্শী চিন্তার অভাব দায়ী যার কুফল আজ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে মূলধারার বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি।
সালমান মারা যাওয়ার পর সানি ব্যর্থ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নির্মাতারা এক দিকে যেমন মান্নাকে কাজে লাগিয়েছিলেন ঠিক তেমনি অন্যদিকে রিয়াজকেও কাজে লাগানো হয়েছিল যার ফলে অশ্লীল যুগেও মান্নার কাছ থেকে আম্মাজান, কষ্ট, তেজি, সমাজকে বদলে দাও, ভাইয়া’র মতো ছবি পেয়েছিলাম ঠিক তেমনি রিয়াজের কাছ থেকে পৃথিবী তোমার আমার, হৃদয়ের আয়না, বিদ্রোহ চারদিকে, প্রাণের চেয়ে প্রিয়, ভালোবাসি তোমাকে, প্রেমের তাজমহল, হৃদয়ের বন্ধন, এ বাঁধন যাবে না ছিঁড়ে, মনের মাঝে তুমি’র মতো চলচ্চিত্র পেয়েছিলাম।
আজ অশ্লীল যুগ নেই কিন্তু তারপরেও আজও বাংলা বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের করুণ দশা যায়নি কারণ গত ৭/৮ বছর ধরে একজন নায়কের বলয় প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে পুরো ইন্ডাস্ট্রি এখন জিম্মি হয়ে গিয়েছে ফলে ওই একজন নায়কের একঘেয়েমি ছবিগুলোই দর্শকদের বাধ্য হয়ে গিলতে হচ্ছে। ইন্ডাস্ট্রিতে যখন প্রতিযোগিতা থাকে না তখন শিল্প হয়ে যায় একচেটিয়া বাজারের ব্যবসায়ী নামের দস্যুদের হাতে অসহায় যার খেসারত দেয় ইন্ডাস্ট্রি, ভোক্তা, ভক্ত, দর্শকসহ সাধারণ মানুষের। অথচ পাশের দেশ ভারতের দিকে তাকান সেখানে ৯০ দশকে আসা শাহরুখ, আমির খান, সালমান, অক্ষয়, অজয়’রা যেমন আজও দাপটে আছে ঠিক তেমনি ঋত্বিক, শহীদ কাপুর ও আজকের রণবীর’রাও দাপট দেখাচ্ছে যার সুফল ভোগ করছে চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি ও সাধারণ দর্শক ভক্তরা।