সুনির্মিত ‘ওরা ৭ জন’
খিজির হায়াত খানের নতুন সিনেমা ‘ওরা ৭ জন’ মুক্তি পেয়েছে স্বাধীনতার মাসের ৩ তারিখে, সারাদেশব্যপী ২৫টির মত হলে।
তার সর্বশেষ মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমার অভিজ্ঞতা বেশিরভাগ দর্শকের কাছে খুব একটা সুখকর ছিল না। ‘মিস্টার বাংলাদেশ’ জঙ্গীবাদের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে নির্মিত সিনেমা হলেও, ‘সিনেমা’ হিসেবে দর্শককে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। এজন্য বেশিরভাগ দর্শক হয়তো খিজির হায়াত খানের উপরে ভরসা করাই ছেড়ে দিয়েছিলেন। অথচ এত বছর আবারও নির্মাণে ফিরে এসে খিজির হায়াত খান আসলেই চমকে দিলেন!
বাংলাদেশের অন্যান্য মুক্তিযুদ্ধের সিনেমায় মূল যে গল্প দেখা যায়, ওরা ৭ জনের গল্প সেখানে কিছুটা ব্যতিক্রম। ইন্ডিয়ান একজন চিকিৎসক পূর্ব পাকিস্তানে এসেছেন আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করতে। পাকিস্তানি বাহিনীরা খুঁজে বেড়াচ্ছে এই নারীকে, তাকে কব্জা করাই তাদের উদ্দেশ্য। ওদিকে, মাত্র ৭ জন সদস্য নিয়ে গঠিত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দলের উপরে দায়িত্ব পড়ে এই ভারতীয় নারী চিকিৎসককে পাকিস্তানিদের হাত থেকে রক্ষা করা। ওরা ৭ জন কি পারবে নিজেদের এই উদ্দেশ্যে সফল হতে?
‘ওরা ৭ জন’ একটি সম্মুখযুদ্ধের সিনেমা। ইংরেজিতে বললে ব্যাটেলফিল্ড সিনেমা। অর্থাৎ এই সিনেমাতে মূল ফোকাস হচ্ছে ময়দানের যুদ্ধে, যে যুদ্ধের বিনিময়ে আমরা পেয়েছিলাম বাংলাদেশ। এই যুদ্ধের সিনগুলো ফুটিয়ে তুলতে পুরো সিনেমার টিম সফল। সিনেমার একটি দৃশ্যে দেখানো হয়, পাকিস্তানীরা একটি গ্রামে হামলা চালায়। সেই গ্রামের মানুষদের উদ্ধার করতে আসে ৭ জনের সেই মুক্তিযোদ্ধাদের টিম। প্রায় ১০ মিনিটব্যাপী ধরে চলা এই অ্যাকশন সিকুয়েন্স দেখে যে কারো গুজবাম্প হবে। ফার্স্ট পারসন শুটিং স্টাইলেও কিছু শট নেয়া হয়েছে এই দৃশ্যে। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সৈন্যরা আমাদের উপরে অবর্ণনীয় অত্যাচার করেছে, সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। তবে এই সিনেমাটা যেখানে আলাদা, সেই অত্যাচারের মাত্রাটা বোঝা গেছে খানিকটা হলেও। কিছু অত্যাচারের দৃশ্যে হাতের মুঠো শক্ত হয়ে আসে, ঘৃণার উদ্রেক হয় পাকিস্তানিদের প্রতি। সেখানেই টিম ‘ওরা ৭ জন’ সার্থক।
সিনেমার প্রত্যেক অভিনেতাই ভালো অভিনয় করেছেন, বিশেষ করে যারা প্রথমবারের মতো খিজির হায়াত খানের সিনেমায় কাজ করলেন। এক্ষেত্রে নাফিজ ও সাইফের কথা উল্লেখ না করলেই নয়। তবে বাকি সবার চেয়ে আলাদা জাকিয়া বারী মম। স্ক্রিনে আসার পরেই সিনেমাতে অভিনয়ের মাত্রা আলাদা পর্যায়ে চলে যায় আর তখনই মনে হয়, এখনও অনেক কিছু দেয়ার বাকি জাকিয়া বারী মমর।
চমকে দিয়েছেন শিবা শানু! এফডিসির বেশিরভাগ সিনেমায় যিনি তৃতীয় শ্রেণীর ভিলেন হিসেবে কাজ করেছেন, তাকে কখনও মুক্তিযোদ্ধার রোলে দেখা যাবে আর তিনি শুদ্ধ ইংরেজিতে ডায়লগ বলবেন, এটা অপ্রত্যাশিত ছিল। ইন্তেখাব দিনার বরাবরের মতোই, তবে তার রোলটি আরেকটু ব্যাকগ্রাউন্ড ডিজার্ভ করতো।
মুক্তিযুদ্ধের সিনেমাতে যেখানে মোটাদাগে দাড়ি টুপি মানেই রাজাকার সেখানে এই সিনেমায় দাড়িটুপিওয়ালা একজন মুয়াজ্জিনকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দেখানো হয়েছে যে কিনা ‘আল্লাহু আকবর’ বলে যুদ্ধে গুলি চালায় আর এই চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেছেন ইমতিয়াজ বর্ষণ!
‘ওরা ৭ জন’ সিনেমার ৭ জন ক্যারেক্টর বিভিন্ন শ্রেণী-ধর্মেরপ্রতিনিধিত্ব করে। কেউ ডাক্তার, কেউ মেজর, কেউ মুয়াজ্জিন, কেউ হিন্দু, কেউ আবার নিজের দেশী ভাষা ছাড়া কথা বলে না- যেমনটা ছিল ১৯৭১ সালে। অথচ এদের প্রত্যেকের লক্ষ্য এক, উদ্দেশ্য এক ছিল- বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
‘ওরা ৭ জন’ সিনেমার আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে এর সাউন্ড ডিজাইন। সত্যজিৎ রায় ফিল্ম ইনস্টিটিউটের প্রফেশনালদের দিয়ে সাউন্ড ডিজাইন করা হয়েছে আর ফলাফল পাওয়া গেছে হাতেনাতেই। যুদ্ধের গোলাগুলির আওয়াজ শুনে মনে হচ্ছিল সম্মুখযুদ্ধেই আছি। ‘মন নৌকা’তে গানটি মনে থেকে যায়।
খিজির হায়াত খান নিজের সামর্থ্যের সেরাটা দিলেও কিছু ব্যাপারে খেয়াল রাখলে সিনেমাটা আরো ভালো হতে পারতো। ২ ঘন্টা ৪০ মিনিটের এই সিনেমার বেশ কিছু অপ্রয়োজনীয় দৃশ্য ফেলে দেয়া গেলে দৈর্ঘ্যে আরেকটু কম হতো। বিশেষ করে সেকেন্ড হাফের কিছু দৃশ্যে। কিছু দৃশ্যে চরিত্রদের পোশাক আর অস্ত্রগুলো দেখে সেগুলোকে ১৯৭১ সালের মনে হচ্ছিল না, এইদিকে আরও সচেতন হওয়া দরকার ছিল।
এক্ষেত্রে যেটা উল্লেখ না করলেই নয়, সিনেমার প্রতিটি চরিত্র সত্যিকারের অস্ত্র ক্যারি করছিলেন। শেষে খিজির হায়াত খানের সঙ্গে প্রধান এন্টাগনিস্টের চলা ফাইট সিকুয়েন্সের দৈর্ঘ্য আরও কমানো যেতো; এতক্ষণ ধরে চলা ফাইট সিকুয়েন্স একটা পর্যায়ে গিয়ে কিছুটা হলেও মেলোড্রামাটিক হয়ে যায়৷ সিনেমাটা যতটা ওয়েল মেড হয়েছে, ট্রেলারে তার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
‘ওরা ৭ জন’ কোন ত্রুটিমুক্ত সিনেমা নয়, তবে এটি ওয়েলমেড সিনেমা। খিজির হায়াত খান তার আগের সিনেমার ভুল থেকে যে আসলেই শিক্ষা নিয়েছেন, তার প্রমাণ হল ‘ওরা ৭ জন’। তিনি বুলিসর্বস্ব, টিপিক্যাল ন্যারেটিভের মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা বানাননি; নিজের টিমকে নিয়ে সর্বোচ্চ এফোর্ট দিয়ে যে ধরনের গল্পে বিশ্বাস করেন, সেই ধরনেরই একটি সিনেমা বানিয়েছেন। এজন্য তাকেসহ পুরো টিমকে সাধুবাদ।
‘ওরা ৭ জন’ মুক্তিযুদ্ধের সময়কে স্পষ্টভাবে মনে করানোর সিনেমা। সেই ভয়াল সময়ের হিংস্রতা, অত্যাচারকে কিছুটা হলেও যদি আপনি অনুভব করতে পারেন, তাহলেই এই সিনেমার সঙ্গে জড়িত সকলের পরিশ্রম সার্থক।