Select Page

প্রিয়তমা: যে গল্প নিয়ে অসংখ্য প্রশ্ন তৈরি হয়

প্রিয়তমা: যে গল্প নিয়ে অসংখ্য প্রশ্ন তৈরি হয়

স্পয়লার অ্যালার্ট: এই রিভিউর কিছু অংশ প্লট সম্পর্কে ধারণা দেবে। তাই সিনেমাটি না দেখলে এড়িয়ে যেতে পারেন।

বাংলা চলচ্চিত্রের সঙ্গে ‘শাকিব খান’ নামটা এমনভাবে জড়িয়ে গেছে- আপনি হয়তো তাকে অপছন্দ করতে পারেন; অস্বীকার করতে পারবেন না।

শাকিব খানকে কেউ কেউ বাংলা চলচ্চিত্রের ক্যাপ্টেন অব দ্য শিপও বলে থাকেন। ইদানিং শাকিব খানকে ক্যাপ্টেন মনে হওয়ার সুযোগ নেই; বরং মনে করা যেতে পারে, তিনি নিজেই একটা জাহাজ। উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তমরূপে বাংলা চলচ্চিত্রকে একা টেনে নিয়ে যাচ্ছেন কূলের দিকে। 

প্রিয়তমা সিনেমায় শাকিব খানের লুক, সামাজিক মাধ্যমে হইচই আর সিনেপ্লেক্সে চারদিনের টিকিট অগ্রিম ফুরিয়ে যাওয়ার খবরে নিজেকে ধরে রাখা গেল না। ছুটতে হলো ফার্মগেটের আনন্দ সিনেমা হলে।

এই হলে অগ্রিম টিকিটের ঝামেলা নেই। আর আসল শাকিবিয়ানদের সঙ্গে বসে সিনেমা দেখতে চাইলে সিঙ্গেল স্ক্রিনের বিকল্প হয় না বিধায় ভ্যাপসা গরম, বাজে সাউন্ড সিস্টেম, অস্বস্তিকর পরিবেশ সত্ত্বেও ছুটে গেলাম আনন্দ সিনেমা হলে।

বুধবার সন্ধ্যা ছয়টার শো হিসেবে হল হাউজফুলই বলা যায়। কিছু দর্শক হলে ঢোকার আগেই হই-হুল্লোড় শুরু করে দিলেন, টিকিট হাতে পেয়েই সিটি বাজালেন। উৎসবমুখর পরিবেশ ভ্যাপসা গরমকেও সহনীয় করে তুলল।

সিনেমা শুরু হওয়ার আধাঘণ্টার ভেতর বেশিরভাগ দর্শক চুপসে গেলেন। হাতেগোনা কয়েকজন কারণে অকারণে হুল্লোড় করে, সিটি বাজিয়ে হল মাতিয়ে রাখলেন।

বেশিরভাগ দর্শকের চুপসে যাওয়া আর অল্প কিছু দর্শকের হল মাতিয়ে রাখা স্পষ্ট একটা বার্তা দেয়। যারা ‘প্রিয়তমা’ দেখতে গিয়েছিলেন তারা চুপসে গেছেন। প্রিয়তমাকে সেই অর্থে খুঁজে পাওয়া যাবে না, সিনেমায় শক্ত একটা গল্পের প্রত্যাশা পূরণ হবে না বুঝে গেছেন।

যারা শাকিব খানকে দেখতে গিয়েছিলেন তাদের চুপসে যেতে হয়নি। কারণ সিনেমাটি ঘুরেছে শাকিব খানকে ঘিরে।

সিনেমার গল্প, প্রত্যাশা, প্রাপ্তি নিয়ে কথা বলার আগে বলতে হবে শাকিব খানের ‘লুক’ নিয়ে। তার দীর্ঘ ক্যারিয়ারে দর্শক হাতে গোনা চার-পাঁচটি লুকেই ঘুরে ফিরে দেখেছেন।

প্রিয়তমা সিনেমার লুক সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে যাওয়ার পর একটা রব উঠে যায়। এই শাকিবকে আগে দেখা যায়নি। পাঠানের শাহরুখ খানের মতো কাঁধ ছুঁই ছুঁই বাবরি, মাথায় ঝুঁটি। মেদহীন শাকিব খানকে দেখে বয়স বোঝার উপায় নেই।

শিল্পীরা লুক সেট করেন চরিত্র অনুযায়ী। কোনো শিল্পী নতুন লুকে হাজির হলে ধরে নেওয়া হয়, গল্পের প্রয়োজনে এই লুক। নতুন কিছু পাওয়া যাবে শিল্পীর থেকে, সিনেমা থেকে।

লম্বা চুলের লুক নিয়ে আলোচনা চলতে চলতে চোখে মুখে এক আকাশ বেদনা নিয়ে বৃদ্ধ শাকিব হাজির হন সামাজিক মাধ্যমে। শাকিব ভক্ত বাদেও অনেককে দেখা যায় প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতে।

ছবি মুক্তির আগে দুটি গান ছড়িয়ে পড়ে সিনেমাপ্রেমীদের মুখে মুখে। অতীতে দেখা গেছে, প্রতিটি ভালো সিনেমা এক বা একাধিক ভালো গান উপহার দেয়। ‘প্রিয়তমা’ ও ‘ঈশ্বর’ গানদুটি দর্শকের প্রত্যাশার পারদ আসমানে তুলে দেয়। 

ব্যক্তিগত নানা ঝুট ঝামেলা পাশ কাটিয়ে ফিরছেন শাকিব খান, তাও সম্পূর্ণ অচেনারূপে। বিশাল এক ধামাকার আভাস নিয়ে প্রিয়তমা দেখতে বসে হতাশ হতে বেশি সময় লাগেনি।

গণ্ডির বাইরে আসা শাকিব লড়াই করে গেছেন চিরচেনা গণ্ডিবদ্ধ এক গল্পের সঙ্গে। যে গল্প নিয়ে অসংখ্য প্রশ্ন তৈরি হয়। যার কোনো উত্তর মেলে না।

প্রথমেই বলা যায় নায়কের লুক সদ্ব্যবহারে পুরোপুরি ব্যর্থ পরিচালক। সিনেমায় এমন একটা দৃশ্যও নেই যাতে বোঝা যায়, শাকিব খান কেন এই লুক নিলেন। কেন নিজেকে ভাঙলেন, চুল বড় রাখলেন, ঝুঁটি বাঁধলেন?

ছবির গল্প ও নায়কের চরিত্রে সঙ্গে এই লুকের কোনো সম্পর্ক নেই। অথচ সিনেমার প্রথম দর্শন, টিজারে তার লুককেই হাইলাইট করা হয়েছিল।

শাকিব খান হয়তো নিজের প্রয়োজনে ওজন কমিয়েছেন, চুল বড় রেখেছেন। আগামী কয়েকটা সিনেমায় এই লুকে দেখা যাবে তাকে।

সিনেমা হিসেবে মিষ্টি একটা নাম ‘প্রিয়তমা’। এই সিনেমায় মিষ্টি কোনো গল্প নেই। নায়ক-নায়িকার দেখা হলো। নায়িকা প্রেমে পড়ার জন্য উদগ্রীব হয়েই ছিলেন। কী দেখে, কী ভেবে প্রেমে পড়লেন তার কোনো ব্যাখ্যা নেই, কারণ নেই। নায়িকা প্রেমে পড়ে গেলেন। নায়কও প্রেমে পড়ে গেলেন। শুরু হলো গান। 

প্রেম নির্ভর সিনেমায় প্রেমে পড়ার যে অত্যাবশ্যকীয় নাটকীয়তা তার কিছুই নেই। প্রেমে পড়ার পরেও নেই তেমন কোনো ঘটনা। সিনেমা শেষ করতে হবে বিধায়, নায়িকার বাবা এমপির ছেলের সঙ্গে নায়িকার বিয়ে ঠিক করে বসলেন। এবং চৌধুরী সাহেবদের মতো নিজের মতের উপর অটুট রইলেন। নায়িকাকে ঘরে আটকে রাখার হুলিয়া জারি করলেন।

হঠাৎ করে নায়িকার বাবার বিপরীত চরিত্রে হাজির হওয়ার কোনো ব্যাখ্যা নেই। বিশ্বাসযোগ্য হয়নি নায়িকার সেই বিয়েতে রাজি হওয়াটাও। স্পয়লার দেওয়াটা উচিত হবে না বিধায় গল্পের দিকে না গিয়ে এক কথায় বলা যায়, যে প্রেম দেখানো হয়েছে, প্রেমের যে পরিণতি দেখানো হয়েছে তার পুরোটাই আরোপিত। স্বতঃস্ফূর্ততার অভাব প্রতিটি দৃশ্যে। একটা দৃশ্য থেকে আরেক দৃশ্যে যাওয়ার প্রয়োজনীয় উপাদান নেই।

সিনেমার শুরুর দিকে ‘কবুল কোরো আমার কুরবানি’ গানটা হঠাৎ করে এসে হঠাৎ করে শেষ। গানের কার্যকরণ নেই, প্রয়োজনীয়তা নেই, উপযোগিতাও নেই। যেন কুরবনাীর ঈদে সিনেমা মুক্তি পাবে বিধায় কুরবানি নিয়ে একটা গান রেখে হইচই ফেলে দেওয়ার জন্যই গানটা।

একই অবস্থা শাকিব খানের ভাইরাল বৃদ্ধ লুকটারও। রাবীন্দ্রিক বাবরি, চোখে-মুখে ক্লান্তি আর বিষাদ নিয়ে বসে থাকার যেই ছবিটা ঈদের আগে প্রশংসায় ভাসছিল, ওই লুকটা ছিল মূলত সামাজিক মাধ্যমে প্রশংসা কুড়ানোর জন্যই। গল্পে এমন দরকারি কিছু ছিল না যাতে তাকে ওই লুকে হাজির হতে হবে।

শহীদুজ্জামান সেলিম ও নায়িকার বাবার (একটা মাত্র দৃশ্যে, বাকি দৃশ্যে আবার ঢাকাইয়া) মুখে চাটগাঁইয়া সংলাপ, বাকিদের মুখে ঢাকাইয়া সংলাপ যেমন খাপছাড়া লেগেছে, শহীদুজ্জামান সেলিমের মুখে মেকআপ কখনো কখনো যাত্রা শিল্পীদের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। 

শাকিব খান ও তার বাবার মধ্যবিত্ত জীবন যাপনের বিপরীতে তার ভাইয়ের আলিশান জীবনযাপনের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। মৃত নায়িকাকে (নায়িকা যে মারা যায়, সেটা ঈশ্বর গানেই দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে) বৃষ্টির ভেতর উঠোনে শুইয়ে রাখাটাও অযাচিত।

দুজনের প্রেমের এমন কোনো গভীরতা দেখানো হয়নি যাতে নায়িকার বিয়ের সংবাদে নায়ককে বোহেমিয়ান হয়ে যেতে হবে। নায়িকাকে আত্মহত্যা করতে হবে। ফেইসবুকে হয়ে যাওয়া হুটহাট প্রেম ও ব্রেকআপের মতো একটা প্রেমকে টেনে টুনে জীবন-মরণ প্রশ্নে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। 

প্রিয়তমা ‘হাজার বছর ধরে’ চলে আসা বাংলা সিনেমার গল্প। বিশেষ কিছু নেই। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে খাপছাড়া উপস্থাপন। ক্যারিয়ারের এই পর্যায় এসে শাকিব খান কেন এমন একটা গল্পে সন্তুষ্ট হলেন সেই ভাবনাটাই বড় হয়ে দাঁড়ায় সিনেমার শেষে। 

গল্প ঘুরেছে শাকিব খানকে নিয়ে। কলকাতা থেকে উড়িয়ে আনা ইধিকা পালের অভিনয়ের জায়গা রাখা হয়নি। ইধিকা পালের জায়গায় এদেশের যে কোনো নায়িকাকে নিলেও ফলাফল একই হতো।

সিনেমা হলের মান্ধাতা আমলের সাউন্ড সিস্টেম ও ঘোলাটে প্রোজেক্টরের কারণে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ও ক্যামেরার কাজ নিয়ে আলাদাভাবে বলা কঠিন। তবে দুই একটা অ্যাকশন দৃশ্যে ছোট ছোট কাজ ও দুইটা গান ভালো লাগার বেশ কিছু উপাদান আছে।

পরিচালক ও বিভিন্ন গণমাধ্যমের দাবি অনুযায়ী সিনেমাটা ভালো ব্যবসা করছে। ব্যবসা করছে মূলত শাকিব খানের কারণেই। বিষয়টা যত আনন্দের, এর পেছনে আছে বেদনা ও আশঙ্কার কথাও। শাকিবিয়ানরা বিপুল উৎসাহে হলে গিয়ে যদি একের পর এক হতাশ হন, শাকিবের ক্রেজ ফুরিয়ে যেতে সময় লাগবে না।

শাকিব খানকে গল্প বাছাইয়ে আরও পরিণত হতে হবে। ব্যক্তিগত সম্পর্কের ঊর্ধ্বে গিয়ে গল্পকে প্রাধান্য দেওয়ায় মনযোগী হতে হবে।

হলিউড, বলিউড ও সাউথ ইন্ডাস্ট্রির সুপারস্টারদের গল্প বাছাইয়ের জন্য একটা টিম থাকে। তারা সুপারস্টারের হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন কোন সিনেমা করা যাবে কোনটা করা যাবে না। শাকিব খানের এমন কোনো টিম নেই, সেটা স্পষ্ট করে তুলল প্রিয়তমা।

একজন সুপারস্টারকে সবাই ব্যবহার করতে চাইবে। কেউ যেন তাকে অপব্যবহার করতে না পারে, এ বিষয়ে তাকেই সবচেয়ে বেশি সচেতন হতে হয়।

ছোটপর্দার আস্থাভাজন পরিচালক হিমেল আশরাফের প্রতি যে প্রত্যাশা ছিল তা পূরণের ধারেকাছেও ঘেঁষেনি ছবিটি। বরং তড়িঘড়ি করে বানানো একটা অসম্পূর্ণ সিনেমা হয়ে রইল ‘প্রিয়তমা’।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

লেখক ও সাংবাদিক

১ টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন