সুপারহিট নায়কের গল্প
যারা সুনির্দিষ্ট কোনো তারকাকে নিয়ে দিনরাত ব্যস্ত থাকে, দু’একজন নায়ক-নায়িকা ছাড়া আর কারো খোঁজ রাখে না তারা কি একজন ওয়াসিম-কে চেনে? তারা কি জানে এই ওয়াসিম একসময়ে সুপার ডুপার হিট নায়ক ছিল। তারা কি জানে বাপদাদার আমলে এই ওয়াসিমের ছবি দেখার জন্যই ভিড় লেগে যেত!
ওয়াসিম
মূলনাম মেসবাহ উদ্দিন আহমেদ।
জন্ম ২৩ মার্চ ১৯৫০, চাঁদপুরে।
ইতিহাসে স্নাতকোত্তর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
১৯৬৪ সালে বডি বিল্ডিং-এ ‘মিস্টার ইস্ট পাকিস্তান’ নির্বাচিত হন এমনকি ‘মিস্টার ঢাকা’-ও নির্বাচিত হন। তখনকার দিনে এসব খেতাবে তিনি পরিচিতি পেয়ে যান দ্রুত।
তাঁর স্ত্রী রোজী আফসারীর ছোটবোন। এক ছেলে এক মেয়ে ছিল তাঁর। মেয়েটি মানারাত ইন্টাররন্যাশনাল স্কুলের পাঁচতলা থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করে।
স্কুলে শেকসপীয়রের ‘হ্যামলেট’ নাটক দেখে নিজেকে নায়ক মনে করতেন। নায়ক হবার স্বপ্ন দেখতে দেখতে খুব অপ্রত্যাশিতভাবেই চলচ্চিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব পান। পরিচালক এসএম শফি-র হাত ধরে ‘রাতের পর দিন’ ছবিতে প্রথম অভিনয় করেন।
উল্লেখযোগ্য ছবি :
রাতের পর দিন, কে আসল কে নকল, দি রেইন, দোস্ত দুশমন, ডাকু মনসুর, জিঘাংসা, ডার্লিং, দুশমন, দুই রাজকুমার, মিস লোলিতা, ঈমান, নাদিরা, বেদ্বীন, বিনি সুতার মালা, প্রাণসজনী, মানসী, জানোয়ার, রাজদুলারী, রাজকন্যা, লাল মেমসাহেব, আসামী হাজির, মহেশখালীর বাঁকে, রাজমহল, বারুদ, গুনাহগার, শীষনাগ, লুটেরা, বুলবুল-এ-বাগদাদ, মোকাবেলা, ওমর শরীফ, আবেহায়াত, পদ্মাবতী, বানজারান, ধন দৌলত, প্রিন্সেস টিনা খান, নরম গরম, জিপসী সর্দার, রাজিয়া সুলতানা, ধর্ম আমার মা, শিরি ফরহাদ, ডাকু ও দরবেশ, দিদার, প্রতিবাদ, মরণ পণ, ছলনা, দিনকাল, ভালোবাসা ভালোবাসা।
ওয়াসিমের অভিনীত ‘দি রেইন’ ছবিটি তৎকালীন সময়ে ৪৬টি দেশে মুক্তি পায় অফিসিয়ালি। এটা তখনকার দিনে তাক লাগানো ঘটনা ছিল। এ ছবি মুক্তির পর হলিউডে যাবার সুযোগ হয় তাঁর। দেখা হয় বিখ্যাত অভিনেত্রী অড্রে হেপবার্নের সাথে। সেখানে অভিনয়েরও প্রস্তাব পান কিন্তু দেশের চলচ্চিত্রকেই গুরুত্ব দেন তিনি এবং সফল হন।
ওয়াসিমের জুটিগুলোর মধ্যে প্রথমদিকের সবচেয়ে জনপ্রিয় জুটি ছিল ওয়াসিম-অলিভিয়া জুটি। অলিভিয়ার সাথে তাঁর সুপারহিট কিছু ছবি আছে। ‘দি রেইন’ তো ইতিহাস তাঁদের জুটির। অঞ্জু ঘোষের আগমনের পর ওয়াসিম-অঞ্জু জুটির চাহিদা বাড়তে থাকে এবং এ জুটির দাপটে অলিভিয়ার সাথে তাঁর কাজ কমে যায়। এ দুটি জুটি বাদে শাবানা, রোজিনাদের সাথে জুটি ছিল।
ওয়াসিমের ছবির জনপ্রিয় কিছু গান :
চুমকি চলেছে একা পথে – দোস্ত দুশমন
এই বৃষ্টিভেজা রাতে চলে যেও না – নরম গরম
পরদেশী মেঘ রে – দি রেইন
পাখির বাসার মতো দুটি চোখ তোমার – জিঘাংসা
মনটা যদি খোলা যেত – চন্দন দ্বীপের রাজকন্যা
আমি তোমারই প্রেমভিখারী – চন্দন দ্বীপের রাজকন্যা
আমি তো আজ ভুলে গেছি সবই – দি রেইন
কথা কেন যে বলিস না – বেদ্বীন
ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে – প্রাণসজনী
কি জাদু করিলা পিরিতি শিখাইলা – প্রাণসজনী
কত রঙ্গ জানোরে মানুষ – প্রাণসজনী
আমি চিরকাল প্রেমের কাঙ্গাল – প্রিন্সেস টিনা খান
এই মন তোমাকে দিলাম – মানসী
চন্দ্র তারার নিচে – রাজকন্যা
ওরে মনচোরা – সওদাগর
হীরার চেয়ে দামি – তুফান
ওগো বিদেশিনী তোমার চেরি ফুল দাও – লাল মেমসাহেব
চিরদিন কাছে থেকো বন্ধু – লাল মেমসাহেব
হাজার বছর ধরে তুমি আছো অন্তরে – মরণ পণ
অনেকদিন পর প্রিয় মানুষটিকে কাছে পেয়েছে অঞ্জু ঘোষ। বৃষ্টিভেজা দিনে রোমান্টিক হয়ে উঠেছে তার মন। যেতে দেবে না আজ তাকে। তাই সুরে সুরে গাইছে ‘এই বৃষ্টি ভেজা রাতে চলে যেও না।’ চুমকি খুব একরোখা তাকে প্রেম নিবেদন করতে তাই রাস্তায় একজনের সাইকেল নিয়ে পিছু করে ঘোড়ার গাড়ি চালানো চুমকিকে। তারপর কোনোমতে গাড়িতে উঠে চুমকিকে প্রেম নিবেদন করছেন ওয়াসিম ‘চুমকি চলেছে একা পথে’ গাইতে গাইতে। চুমকি ছিল শাবানা। অলিভিয়া মেঘকে ডাকছে মনের মানুষটিকে ছায়া দেবার জন্য। মেঘও হাজির। অলিভিয়া গাইছে ওয়াসিমের জন্য ‘আয়রে মেঘ আয়রে।’ রোজিনা নিজের ভালোবাসা নিবেদন করছে মধুর কিছু কথামালায়-‘এই মন তোমাকে দিলাম/তুমি চোখের আড়াল হও/কাছে কিবা দূরে রও/মনে রেখো আমিও ছিলাম।’ জবা চৌধুরীকে জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেনের উপমায় ভালোবাসা নিবেদন করছেন ওয়াসিম-‘পাখির বাসার মতো দুটি চোখ তোমার/ঠিক যেন নাটোরের বনলতা সেন।’ এভাবে গানগুলো কালজয়ী হয়ে আছে।
ওয়াসিম সেকালের সুদর্শন, তুমুল জনপ্রিয় নায়ক ছিল। বিশেষ এ প্রজন্ম যারা তখনকার নায়কদের নিয়ে সুযোগ পেলে ট্রল করে, ছোট করে তারা যদি তাদের মা-বাবার কাছেও জানতে চায় দেখা যাবে তাদের মা-বাবার প্রিয় নায়কের তালিকায় ওয়াসিমকে পাওয়া যাবে। সত্তর-আশির দশকে ওয়াসিমই ছিলেন হার্টথ্রব। তিনি একজন শিক্ষিত মানুষও। তাঁর ইংলিশ অ্যাকসেন্ট যদি কেউ শোনে প্রশংসা করবে এতটা চমৎকার।
যাদের অবদানে দেশের চলচ্চিত্রের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে তাঁদেরকে না জানলে চলবে না। আমাদের চলচ্চিত্র বিষয়ক আলোচনার টেবিলটা যেন ওয়াসিমও পায় আর এ প্রজন্মের কাছেও তাঁর কর্ম পৌঁছে যায় এটাই প্রত্যাশা থাকবে।