সুপার হিরো : খান সাহেবের খোলস মুক্তি
নিন্দুকেরা যত ট্রল করুক না কেন ঢাকাই চলচ্চিত্রে শাকিব খান মানেই অনেক বড় একটা বাজার, হল ভর্তি দর্শক আর প্রোডিউসারের মুখে হাসি এবং এই বাজারটাকে পুঁজি করে খান সাহেব নিজের স্থুল ব্রান্ডিং কম করেন নাই। যেমন ‘গড ইজ ওয়ান; লাইফ ইজ ওয়ান; নাম্বার ওয়ান শাকিব খান’ আবার ‘হিরো দ্যা সুপার স্টার’ কিংবা ‘কিং খান’ ইত্যাবদি ইত্যাাদি।
‘সুপার হিরো’ নামটা শুনে মনে হয়েছিল কিং খান এবার বুঝি সুপারম্যা ন হয়ে মনের খায়েশ মেটাবেন অথবা গরীবের রাজা ‘রবিন হুড’। তবে ট্রেলার দেখে খানিকটা ধাক্কা খেয়েছিলাম কিন্তু শাকিব খান তার স্টারডমে এতটা ছাড় দিয়ে শুধু চরিত্রের প্রয়োজনে একটা সাধারণ চরিত্র হয়ে উঠবেন এটি শুরুতে বিশ্বাস করতে পারিনি। সাধুবাদ, খান সাহেবের বোধোদয় হওয়ার জন্যে আর পরিচালক আশিকুর রহমানকে— খান সাহেবকে নিজের খোলস থেকে বের করে আনার জন্যো।
এবার কাহিনি প্রসঙ্গে আসা যাক। ‘সুপার হিরো’র সবচেয়ে ভালো দিক গল্পের শক্ত গাঁথুনি। সাসপেন্স থ্রিলারধর্মী চলচ্চিত্রের সার্থকতা অনেকাংশে নির্ভর করে গতির পরিমিত ব্যা বহারের মাধ্যমে দর্শকদের চোখ পর্দায় সদাজাগ্রত রাখা এবং এই মানদণ্ডে আশিকুর রহমান নিঃসন্দেহে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। গল্প বলার ধরনটাও ছিল তার নিজস্ব স্টাইলে, যেমনটা বলেছেন ‘মুসাফির’-এ।
সব মিলিয়ে, কিছু ছোটখাট ত্রুটি ছাড়া ‘সুপার হিরো’ একটি সার্থক বাণিজ্যিক মিক্স।
কাহিনির পাশাপাশি ‘সুপার হিরো’র আরেকটি সফল জায়গা হচ্ছে চরিত্রায়ন। চরিত্রগুলো গিরগিটির মতো রং বদলেছে় ক্ষণে ক্ষণে। গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রগুলোর মধ্যেট স্ট্রেইট চরিত্র ছিল শাকিব খানের ও টাইগার রবির। বাকি সবগুলো চরিত্রই ছিল দেখার মতো। বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য। সবচেয়ে সম্ভাবনাময় চরিত্রটি ছিল বুবলির চরিত্র। কারণ অ্যাকশনধর্মী চলচ্চিত্রগুলোতে নায়িকার চরিত্রটি অনেক বেশি টাইপড আর বোরিং হয়ে যাচ্ছিল দিন কি দিন। গল্পকাররা ঠিক বুঝতে পারছিলেন না কোথায় ফিট করবেন নায়িকাকে।
‘নবাব’ সিনেমায় শুভশ্রী, ‘ঢাকা অ্যা টাক’-এ মাহি, ‘পাষাণ’-এ মিম একে একে সবাই পা দিয়েছেন হাস্যককর সাংবাদিক চরিত্রে। যেন অ্যাকশন সিনেমার নায়িকা মানেই সাংবাদিক হয়ে পুলিশ নায়কের সাথে প্রেম করতে হবে। নারী পার্শ্বচরিত্রে অভিনেত্রী সিন্ডি রোলিংও দেখার মতন ছিল। তবে সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন চরিত্র ছিল তারিক আনাম খানের।
বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন শাকিব খান, শবনম বুবলি, তারিক আনাম খান, সাদেক বাচ্চু, টাইগার রবি, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন অভিনেত্রী সিন্ডি রোলিং প্রমুখ। তবে অভিনয় প্রসঙ্গে বলতে গেলে বলতে হবে মূল চরিত্রগুলো যতটা কাঁপিয়ে অভিনয় করছে পার্শ্বচরিত্রগুলো ততটাই দূর্বল ছিল।
সবচেয়ে দুঃখজনক ছিল সাদেক বাচ্চুর মতো পাকা একজন অভিনেতার এমন আলগা অভিনয়। পজেটিভ কমেডি চরিত্রে নিজেকে কোনভাবেই খাপ খাওয়াতে পারছিলেন না তিনি। অস্ট্রেলিয়ার পুলিশ অফিসার, অস্ট্রেলিয়ান অ্যাম্বাসির বুবলির বস এরা সবাই দূর্বল অভিনয়ের দোষে দুষ্ট।
টাইগার রবি বারবার অতি অভিনয় করেছেন। বুবলির অভিনয় একটু প্যাসিভ। আরেকটু অ্যাকটিভ অভিনয় করলে ভালো হবে বলে মনে হচ্ছে। শাকিব খান অভিনয়ে স্বতঃস্ফূর্ত ছিলেন তবে তার ফিগার চরিত্রের সাথে যাচ্ছিল না। তার চরিত্রটায় একজন পেশিবহুল নায়কের বেশি প্রয়োজন ছিল। বিশেষ করে টাইগার রবির পেশিবহুল বাহুর সাথে খান সাহেবের মেদযুক্ত শরীর যাচ্ছিল না। তাছাড়া লাইফ জ্যা কেট ও হ্যা লমেট পরিহিত শরীরে শাকিব খানকে পুরোপুরি ফিট মনে হয়নি।
তবে সিন্ডি রোলিং ও তারিক আনাম খান তাদের চরিত্রে পুরোপুরি ফিট ছিলেন। তারিক আনাম খানের খল অভিনয় নতুন কিছু না। নব্বইয়ের দশকের জনপ্রিয় টিভি নাটক ‘তথাপি’র ‘লাট ভাই’ চরিত্রে অভিনয়ের পর বেশ কিছু সিনেমায় খল চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি কিন্তু খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। তবে ‘সুপার হিরো’তে উনি নিজের জাত চিনিয়েছেন।
নির্মাণ সম্বন্ধে বলতে গেলে বলতে হবে স্বল্প বাজেটে কিভাবে ভালো সিনেমা বানানো যায় তার একটি দৃষ্টান্ত এটি। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায় এই সিনেমার বাজেট নাকি ৩ থেকে ৫ কোটি টাকা কিন্তু এই গল্পে দশ কোটির কমে ভালো কিছু করা কঠিন যার ছাপ সিনেমার পড়তে পড়তে লুকিয়ে ছিল। কালার কারেকশন খুবই বাজে হয়েছে, ক্রোমার কাজ আলগা আলগা মনে হয়েছে, সিকোয়েন্সের কালার কন্টিনিউইটি ছিল না ইত্যাদি।
এখন সিনেমার কিছু গঠনমূলক সমালোচনায় আসা যাক। প্রথম যে জিনিসটায় ধাক্কা খেলাম সেটা হচ্ছে বাবার ছেলের সামনে বিয়ার খাওয়ার কৌতুক সিকুয়েন্সটা। এটা আমার দেশের সংস্কৃতি না। কারণ. এ দেশের কোন বাবা বোধহয় ছেলের সামনে বিয়ার খেয়ে মাতাল হয় না।
সিনেমায় প্রতিরক্ষা বাহিনীতে যারা ছিলেন তাদের অনেকেই বিশেষ করে শাকিব খান ক্লিন সেভ করেনি। তবে আমি যতদূর জানি বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর সবার ক্লিন সেভ করা বাধ্যতামূলক। এমনকি ‘ঢাকা অ্যা টাক’ সিনেমায় আরেফিন শুভ, এবিএম সুমনসহ সবাই ক্লিন সেভড ছিল। শাকিব খানের চুলের কাটও প্রতিরক্ষা বাহিনীর মতো ছিল না।
এমনকি শাকিব খান এর মেকাপে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা ছিল না। বাংলাদেশ থেকে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার পর এক রাতে তার চুল দাড়ি বড় হয়ে উঠে। আবার অস্ট্রেলিয়া থেকে বাংলাদেশে আসার পর একদিনে তার চুল দাড়ি ছোট হয়ে যায়।
শাকিব খান অস্ট্রেলিয়ায় কী জন্য গেলো আর করলো কী! গেল ট্রেনিং করতে কিন্তু ট্রেনিংয়ের নাম গন্ধ নাই, ফিরল বুবলির সাথে প্রেমের ফসল একটা ল্যা পটপ নিয়ে, হাস্যনকর। বাংলাদেশের মিসাইল বিজ্ঞানী অস্ট্রেলিয়া গিয়েছেন আর তার নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশের শিক্ষানবিশ এক প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাকে অনুরোধ করছেন বাংলাদেশের অ্যাম্বাসির কর্মকর্তা। এরকম কাহিনি হলে হাসানোর জন্যা কমেডি সিকুয়েন্স থাকা লাগে না।
একটা সিকুয়েন্সে দেখা যায় শাকিব খান বুবলিকে নিয়ে গাড়ি বদলে পালিয়ে যায়। ছাদহীন খোলামেলা স্পোর্টস কার দিয়ে কেউ পালিয়ে যাবে এই আইডিয়াটা প্রচন্ড রকম হাস্যকর।
হাতকড়া নিয়ে শাকিব খানের গাড়ি থেকে পালায় সিন্ডি। রোলিং তা এক হাতের আলতো ছোঁয়ায় খুলে ফেলে। বাংলাদেশ পুলিশের হাতকড়া কি এতটাই দূর্বল!
ছোটখাটো ভুলগুলোর দিকে নজর দিলে আর বাজেট একটু বাড়াতে পারলে সামনে হয়ত এই গুণী পরিচালক থেকে আরো ভালো কাজ পাবো এই প্রত্যাাশায় আছি।