সুপার হিরো : সময়োপযোগী গল্প, তাড়াহুড়ো নির্মাণ
নাম: সুপার হিরো
ধরন: এ্যাকশন থ্রিলার
পরিচালক: আশিকুর রহমান
কাস্ট: শাকিব খান (সামি; স্পেশাল ফোর্স কমান্ডার অফ বাংলাদেশ), শবনম বুবলি (সীমা; অস্ট্রেলিয়ান এ্যামবেসি অফিসার), তারিক আনাম খান (কে.এম খলিল; সাইন্টিষ্ট), মার্গারেট জি. রোলিং (এনালিসা; কে.এম খলিলের স্ত্রী), টাইগার রবি (জুনায়েদ; সাইকো কনট্রেক্ট কিলার), বড়দা মিঠু (মহাপরিচালক, স্পেশাল ফোর্স অফ বাংলাদেশ), সাদেক বাচ্চু (সামির বাবা), সাইফুল আকবর সাদি (রাজ; কনট্যাক্ট ডিলার), সালমান আরিফ (পিটার) প্রমুখ।
প্রযোজনা:- হার্ট বিট প্রডাকশন
ভাষা: বাংলা
♦ নামকরণ: দেশের শত্রুরা যখন নিজ মাতৃভূমিকে ধ্বংস করার জন্য মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, যখন এদের মোকাবিলা কথা এক হিরো পক্ষে সম্ভব হয় না, ঠিক তখনই দরকার সুপার হিরো-র। এরা কল্পনার কোনো সুপার হিরো নয়, এরা সত্যিকারের সুপার হিরো যারা দেশকে বাঁচাতে প্রাণপণ লড়ে যায়।
নামকরণ হিসেবে সুপারহিরো একদম যথার্থ। কনসেপ্ট অনুযায়ী একদম পারফেক্ট নাম।
♦ কা.চি.স (কাহিনী+ চিত্রনাট্য+ সংলাপ):
ছবিতে সুপার হিরো বলতে তাদের বোঝানো হয়েছে, যারা দেশকে বাঁচাতে অকুতোভয় লড়ে যায়। কারো পরোয়া করে না। যিনি কন্সেপ্ট টি তৈরী করেছেন শুরুতেই তার প্রশংসা করতেই হয়। এ ধরনের কন্সেপ্ট একদম সময়উপযোগী। বলিউডে এর আগে এই টাইপের হাজার হাজার মুভি থাকলেও আমাদের দেশে এক “ঢাকা এ্যাটাক” ছাড়া মনে রাখার মতো তেমন কোনো মুভি তৈরী হয়নি।
কিন্তু, ছবির গল্পটা যতটা সুন্দর, স্ক্রিণপ্লে টা ততটা যুতসই হয়নি। ছবির ২য় অংশ একদম ঠিকঠাক; পুরোটাই সাসপেন্সে ঠাসা ছিল। কাহিনীতে একের পর এক টুইস্ট আসছিল এবং সেগুলো রিভিল হচ্ছিল। কিন্তু প্রথম অংশটা অনেক বেশি স্লো এবং লেন্থি মনে হয়েছে। আরেকটু শর্টকার্ট করা যেতো কিংবা আরেকটু যত্নসহকারে ওই অংশটুকু সাজানো যেতো। এছাড়াও বেশকিছু প্লটহোল আছে স্ক্রিনপ্লে তে। সেগুলো বলে আমি কোনো স্পয়লার দিতে চাচ্ছি না। একটু যত্নের ছাপ থাকলে এগুলো সহজেই ঠিক করা যেতো।
তবে ছবির ডায়লগগুলো ভালো ছিল। কমার্শিয়াল মুভিতে যা হওয়া উচিত, যেমন পাঞ্চলাইন থাকা উচিত তার সবই রাখা হয়েছে। “এদেশ (বাংলাদেশ) আর আগের মতো নেই। এটা বাঘের সীমানা; থাবা মিস হবে না” এমন অনেক জোশ পাঞ্চলাইন রয়েছে ছবিতে।
এ অংশ পাবে ১০০ তে ৫০।
♦ টিমওয়ার্ক: প্রথমেই বলতে হয় মেইন লিডে থাকা শাকিব খানের কথা। স্পেশাল কমান্ডারের চরিত্রে তার অভিনয় একদম ঠিক ঠাক ছিল। তাকে বেশ ঠান্ডা স্বভাবের এবং প্রখর বুদ্ধিসম্পন্ন দেখানো হয়েছে। এ্যাকশন সিনগুলোয় বেশ ভালো কাজ করেছেন তিনি। বস্তুত, তার এ্যাকশন নিয়ে আমি অতটা আশা করিনি, কিন্তু সে অনুপাতে তিনি অনেক ভালো করেছেন। সম্ভবত, এবারই প্রথম তাকে পুরোদস্তর এ্যাকশন সিক্যুয়েন্সে ভরা কোনো মুভিতে দেখতে পেলাম। তবে ছবিতে তার লুক ধরে রাখতে না পারাটা অনেক বেশি পীড়াদায়ক লেগেছে। এক সিনে দেখা গেলো বিয়ার্ড সেইপ, আবার তার পরের সিনের দেখলাম প্রায় ক্লিন সেভ; এই খুতগুলো তার ঠিক করা উচিত। এক্ষেত্রে তার প্রফেশনাল হওয়া উচিত।
শবনম বুবলি তার অভিনয়ের জন্য পূর্বের কাজগুলোয় সমালোচিত হলেও এছবিতে তিনি বেশ ভালো উন্নতি করেছেন। তার চরিত্রের কিছু শেড ছিল। এ্যকশন সিনগুলো মোটামুটি হয়েছে, পাস মার্কস পাওয়ার মতো। তার ভয়েস মড্যুলেশন বেশ ভালো। এক্সপ্রেশনে একটু দূর্বলতা ছিল। ভবিষ্যৎ এই দূর্বলতা কাটিয়ে উঠবেন আশা করি।
তারিক আনাম খান দূর্দান্ত এ্যাকটিং করেছেন এছবিতে। তিনি একজন ভালো অভিনেতা এটা আমরা সবাই জানি। তিনি জাস্ট আরেকবার প্রমাণ করলেন তিনি কেমন পারেন। টুইস্টে ভরা ছিল তার চরিত্রটি।
মার্গারেট জি.রোলিং এর এ্যাকটিং মোটামুটি লেগেছে আমার কাছে। তার ডাবিং এ অনেক প্রব্লেম আছে। এগুলোর প্রতি যত্নবান হওয়া উচিত। তবে তার ক্যারেক্টার ট্রান্সফরমেশন টা ছিল একদম দেখার মতো। হলভর্তি দর্শক শুধু হা করে দেখেছে এটি। ডাবিং এর প্রব্লেমের কারণে তার ডায়লগ ডেলিভারিও দূর্বল লেগেছে।
ছবিতে টাইগার রবির আবির্ভাব ছবির ২য় অংশে। তার এন্ট্রি টাও দূর্দান্ত ছিল। তার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ এবং সাথে ভারি কণ্ঠ, একদম মানানসই। বলা যায়, ছবিতে তার আবির্ভাবের পর থেকে গল্প গতি পেয়ে যায় এবং ফাস্ট মুভমেন্ট করতে থাকে।
সাদেক বাচ্চুর ক্যারেক্টার টা ছোট হলেও গুরুত্ব কম ছিল না। গল্পে তিনি একজন প্রাক্তন পুলিশ অফিসার এবং একজন বাবা হিসেবে অভিনয় করেছেন। অভিনয়ও বেশ ভালো ছিল।
ছবিতে শাকিব খান, সাদেক বাচ্চু, টাইগার রবির মতো অভিজ্ঞদের পাশাপাশি বেশ কিছু ডেব্যুটেন্ট এ্যক্টরদের দেখা গেছে, তার মধ্যে সাইফুল আকবর সাদি এবং সালমান আরিফ ছিলেন অন্যতম যাদের অভিনয় ভালো লেগেছে। এছাড়া বড়দা মিঠুর ক্যারেক্টারে স্পেস কম ছিল, তেমন কিছু দেখানোর মতো সুযোগ ছিল না।
এ অংশ পাবে ১০০ তে ৬০।
♦ কারিগরি: টিম সুপার হিরোকে নিয়ে আমার যেমন সন্তুষ্টি রয়েছে তেমনি অসন্তুষ্টিও রয়েছে। মিলেমিশে সবগুলোই বলা যাক।
আশিকুর রহমানের সিনেমাটোগ্রাফি মানেই ওয়ার্ল্ড ক্লাস! আবারো তিনি প্রমাণ করলেন। বাংলাদেশের সেরা ৫ সিনেমাটোগ্রাফারের তালিকা করলে তিনি সেখানে অবশ্যই জায়গা পাবেন।
এ্যাকশন সিক্যুয়েন্সগুলোয় ক্যামেরার কাজ অনেক সুন্দর ছিল। ড্রোন ক্যামেরায় যে শর্টগুলো নেওয়া হয়েছে সেগুলোও দারুণ ছিল। ছবির লোকেশন ভালো ছিল। তবে একটি জায়গায় ডামি লোকেশন ব্যবহার করাটা অনেক বেশি দৃষ্টিকটু লেগেছে। রিয়েলিস্টিক ভাবের অভাব ছিল।
ছবির এডিটিং এককথায় বললে খারাপ হয়েছে। এতো সুন্দর সিনেমাটোগ্রাফির কাজটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাজে এডিটিং এর কারণে। শাকিব খানের এন্ট্রি র সময় কিংবা এ্যাকশন সিনগুলোতে কিছু সিলি মিস্টেইক করা হয়েছে এডিটিং এ, যেগুলো চাইলেই ঠিক করা যেতো। কিছু শর্টের ডামি ক্যামেরায় ধরা পড়েছে। এসব কাজে একটু যত্নবান হলে আরো সুন্দর হতো।
‘বুম বুম’ বাদে ছবির বাকি গানগুলোর কোরিওগ্রাফি মোটামুটি হয়েছে। ‘বুম বুম’ গানের কোরিওগ্রাফি তেমন ভালো হয়নি। গানের তুলনায় নাচ অতিসাধারণ হয়ে গিয়েছে। VFX এর কাজও বেশ দূর্বল ছিল। কালার শেড এবং গ্রেডিং কিছু অংশে একদম দূর্বল ছিল, আবার কিছু অংশে বেশ ভালো ছিল। ফাইট সিনের কোরিওগ্রাফিও ভালো হয়েছে।
এ অংশ পাবে ১০০ তে ৩৫।
♦ বিনোদন: পুরো ছবিটি শ্যুট করা হয়েছে অস্ট্রেলিয়া এবং বাংলাদেশে। লোকেশন গুলো বেশ ভালো ছিল। বিশেষ করে ক্লাইম্যাক্স সিনে যে পরিত্যক্ত ১৬ তলা জাহাজটি দেখানো হয়েছে সেখানকার শ্যুট, এবং এ্যকশন কোরিওগ্রাফি বেশ ভালো ছিল। এছাড়া ছোট একটি নাইফ ফাইট দেখানো হয়েছে, কিছু চেইজ সিন দেখানো হয়েছে, সেগুলোও উপভোগ করার মতো; খুব বেশি অতিরঞ্জিত করে দেখানো হয়নি, বেশ স্মার্টলি দেখানো হয়েছে। ছবিতে মোট দুইটি গানফাইট সিন আছে; এগুলো কোরিওগ্রাফিও বেশ ভালো হয়েছে। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের কাজ এককথায় চমৎকার হয়েছে। একটু লাউড ছিল, কিন্তু যারা এ্যাকশন লাভার তাদের কাছে খারাপ লাগবে না। ছবিতে কমেডি সিন প্রায় নেই বললেই চলে। ছবির ২য় অংশ পুরোটাই সাসপেন্স-থ্রিলার-এ্যকশনে ভরপুর। তুলনামূলক ১ম অংশ কিছুটা সাদামাটা। অযথাই কিছু কিছু সিন টেনে লম্বা করা হয়েছে। ছবিতে মোট ৪ টি গান রয়েছে; বাট গানগুলো সঠিক জায়গায় বসেনি। গল্পের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময়ই হঠাৎ করেই একেকটি গানের আবির্ভাব হয় এবং মনে হচ্ছিল গানগুলো গল্পের পেস বা গতি কমিয়ে দিচ্ছে। সবমিলিয়ে বলা যায় বিনোদনের জন্য পুরোপুরি না হলেও পর্যাপ্ত উপাদান আছে “সুপার হিরো” তে।
এ অংশ পাবে ১০০ তে ৬০।
♦ ব্যক্তিগত: ব্যক্তিগতভাবে আমি আশিকুর রহমানের ডিরেকশনের বড় একজন ফ্যান। কিন্তু কোনো অন্ধভক্ত নই। সেই ‘মুসাফির’ থেকেই তার মেকিংয়ের প্রতি এক আলাদা টান ছিল। এবারও সেই চিন্তাতেই দেখলাম। ‘মুসাফির’ এর বাজেটে সমস্যা ছিল। মেকিং দেখে বোঝাই যাচ্ছিল স্টোরিলাইন ভালো হওয়া সত্ত্বেও লো বাজেটের কারণে চোখধাধানো কিছু পাইনি। “সুপার হিরো” বেশ ভালো বাজেটে নির্মাণ করা হয়েছে। ছবির কনসেপ্টও ভালো ছিল; কিন্তু স্ক্রিণপ্লে টা মোটেও ভালো হয়নি। এ্যকশন সিনগুলো দিয়ে সেগুলো পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। সবমিলিয়ে আমার কাছে চলনসই লেগেছে, কিন্তু পুরোপুরি সন্তোষজনক নয়।
রেটিং:- ২.৫/৫
♦ ছবিটি কেন দেখবেন: শাকিব ফ্যানদের জন্য এটি ঈদের বড় উপহার। অনেক নোংরা পলিটিক্স পার হয়ে এরপর ছবিটি মুক্তি পেয়েছে। তাদের জন্য মাস্টওয়াচ। যারা আশিকুর রহমানের পূর্ববর্তী ছবি “মুসাফির (২০১৬)” দেখেছেন এবং ভালো লেগেছে, তাদের “সুপার হিরো” মোটামুটি ভালো লাগবে। যারা “ঢাকা অ্যাটাক” দেখেছেন এবং ঐ কনসেপ্টের মুভিপাগল, তারা এটা একবার দেখে ফেলতে পারেন। যারা এ্যকশন-থ্রিলার মুভি পছন্দ করেন তারাও দেখতে পারেন; এছবির এ্যকশন সিনগুলো অন্য ৫/১০ টা বাংলা ছবির তুলনায় অনেক বেশি ফাস্ট (fast) ছিল।
“এটা বাঘের সীমানা,
থাবা মিস হবে না।”