Select Page

স্মৃতিচারণে সুভাষ দত্ত/ আমার চলচ্চিত্র, আমার দৃষ্টিভঙ্গি

স্মৃতিচারণে সুভাষ দত্ত/ আমার চলচ্চিত্র, আমার দৃষ্টিভঙ্গি

[পোস্টার আঁকা থেকে চিত্রনাট্য, অভিনয় থেকে পরিচালনা— চলচ্চিত্রের একজন সব্যসাচী যা বোঝায়, তা-ই সুভাষ দত্ত। বানিয়েছে অনেক সফল ও কালোত্তীর্ণ সিনেমা। তার এ স্মৃতিচারণে ষাট-সত্তর দশকের ঢাকাই চলচ্চিত্রের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা পাওয়া যায়। স্মৃতিচারণটি বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ প্রকাশিত একটি বই থেকে নেয়া]

চলচ্চিত্র নির্মাণে আমি সত্যজিৎ, ডিসিকা ও চ্যাপলিনের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছি। তাদের কাছ থেকে আমি শিখেছি, একটি গল্প রান করিয়ে পরবর্তী পর্যায়ে কী হবে সেটি সাসপেন্সের মধ্যে রেখে দিতে হবে। দর্শক যদি আগে ধরে ফেলে কী হবে তবে কিন্তু পরিচালক নাট্যকার ব্যর্থ। দর্শক যেটা প্রত্যাশা করবে সেটা হবে না। অবশ্য হাসির দৃশ্যের ক্ষেত্রে আলাদা কথা। সেক্ষেত্রে দর্শকদের আগে থেকেই বুঝিয়ে দিতে হবে যে হাসির দৃশ্য আসছে।

অনেকেই হয়তো লক্ষ্য করেছেন আমার ছবিতে প্রতিবন্ধী জীবন বারবার এসেছে। বিনিময়-এর নায়িকা বোবা, ডুমুরের ফুল-এর লাডুর একটি হাত খোঁড়া, আয়না ও অবশিষ্ট-এর আয়নাপর্বের নায়িকার কুশ্রী অবস্থা কিংবা আকাঙ্ক্ষার তরুণী বধূটি অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় পথে এক প্রতিবন্ধীকে দেখে অনাগত শিশুর শারীরিক অবস্থা নিয়ে শঙ্কিত। তবে প্রতিবন্ধী জীবন আমার চলচ্চিত্রে বারবার এলেও হুবহু একই রকম নয়। আমি সবসময় নতুন মাত্রা যোগ করার চেষ্টা করেছি। আমার আরেকটি প্রিয় বিষয়, দাম্পত্য জীবনের সমস্যা। এই বিষয়টির বহুমাত্রিক ব্যবহার আমার ছবিতে দেখা যাবে। আর কারণ হচ্ছে, খুব কাছ থেকে আমি বিভিন্ন মানুষের দাম্পত্য জীবন লক্ষ্য করেছি। যেমন, আবির্ভাব ছবিতে একটি বন্ধ্যা নারীর যে আকৃতি তা আমার এক মাসিমার জীবনের প্রতিফলন।

ষাট দশকের চলচ্চিত্র প্রসঙ্গে অনেকে বলে থাকেন যে, এ দশকের শুরুতে সৃজনশীল বাংলা চলচ্চিত্রের যে ধারা সূচনা হয় সেটি ব্যাহত করে এদেশের নির্মিত উর্দু ছবি। একথাটির সঙ্গে আমি একমত নই। এটা আমি বিশ্বাস করি না। কারণ তখন পাকিস্তান মানে কি ছিল ওয়েস্ট পাকিস্তানে যদি আমাদের ছবি ব্যবসা করে আর আমাদের শিল্পীরা যদি পপুলার হয় তাহলে একে খারাপ বলব কেন? ওখানকার নির্মাতা ও শিল্পীরাও তো এটা চাইতো যে, এখানে ওদের ছবি বাজার পাক, জনপ্রিয় হোক। আসলে তখন একটি প্রতিযোগিতা ছিল। শুরুতে তো আমরা ভারতের হিন্দি ও বাংলা ছবির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেছি। ১৯৬৫ সালের পাক ভারত যুদ্ধের পর ভারতীয় ছবি এদেশে আসা বন্ধ হয়। উর্দু ছবির ক্ষেত্রে আমার একটা নীতি ছিল আর সেটি হচ্ছে আমি এদেশে নির্মিত উর্দু ছবিতে অভিনয় করব, তবে কোনো উর্দু ছবি নির্মাণ করব না। আমার এই নীতি বজায় রাখার ব্যাপারে আমি ছিলাম দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বহু অফার এসেছে বহু টাকার প্রলোভন কোনোদিন আমি নীতিচ্যুত হইনি।

ষাট দর্শকের সেরা নায়ক রহমান। ওর একটা নিজস্ব স্টাইল ছিল চলাফেরা তাকানো, ডায়ালগ ডেলিভারিতে। তবে শুরুতে ও উত্তম কুমারকে নকল করতো। আর আমি যে রহমানকে ওই কথা বলতাম, তাঁর কারণ হচ্ছে তখনকার নামি অভিনেতা আলাউদ্দিনের একটি কথা, যেটি তিনি আমার উদ্দেশ্যে বলেছিলেন। ব্যাপারটি একটু বিস্তারিত বলতে হয়। উর্দু ছবিতে অভিনয়ের সূত্রে শুধু এখানে নয় তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানেও আমার জনপ্রিয়তা সৃষ্টি হয়েছিল। সেখানকার নামি অভিনেতারাও মোহাম্মদ আলী, আলাউদ্দিন, তালিশ আমার গুণমুগ্ধ ছিলেন। চ্যারিটি ক্রিকেট খেলা অনুষ্ঠিত হলেই সেখানকার তারকা অভিনেতারা উদ্যোক্তাদের কাছে আমার কথা বলতো। তো এমনি একটি খেলায় অংশ নেয়ার জন্যে একবার পাকিস্তানে গেছি। লাহোর থেকে মারিতে যাচ্ছি ট্রেনে। ট্রেনের কামরায় তখনকার সময়ের পাকিস্তানের নামি অভিনেতারা। গল্পগুজবে মেতে উঠেছে সবাই। তো এক পর্যায়ে আলাউদ্দিন যিনি বোম্বের মেলাসহ বহু হিন্দি ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি এক পর্যায়ে বলেন, তাঁর সুভাষ হামি তুমার তালাশ দেখা। ইউ আর নট অনলি কমেডিয়ান, ইউ আর গুড আর্টিস্ট শুনে মনটা ভরে গেল। আলাউদ্দিনের মতো নামি অভিনেতা সবার সামনে আমার অভিনয়ের প্রশংসা করেছেন। ভীষণ রোমাঞ্চিত হলাম। আমি তখন বললাম, আলাউদ্দিন সাহাব হাম যো দিন সামজেদে আপকা তারা অ্যাকটিং কারণা শিখা তাব হাম সামজেঙ্গে হাম অ্যাকটিং কিয়া। তখন আলাউদ্দিন একটি সুন্দর কথা বললেন। তিনি বললেন দেখো সুভাষ, কোয়ি আর্টিস্ট কিসিকা বারবার হো নাহি সাকতা। আপনা আপনা রং ঢালকি ও খাতাম যাতা হ্যায়। আর কোয়ি কিসিকো বারবার হো সাকতা হ্যায়, ও খোদাই খাতাম হো যায়ে গা। আলাউদ্দিনের এই কথাটি আমার মনে দাগ কেটেছিল। আমিও তাই রহমানকে অভিনয়ে নিজস্ব স্টাইল অর্জনের জন্য তাগিদ দিতাম। আর যখন রহমান নিজস্বতা দেখাতে পারলো অভিনয়ে সেদিন থেকে সে আরো জনপ্রিয় হলো। রহমান ছাড়া ষাট দশকে এদেশে আরো যারা নায়ক ছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে আজিম, হাসান ইমাম, খলিল, আনোয়ার হোসেন, গোলাম মুস্তফা, রাজ্জাক, মান্নান, জাভেদ। তবে এদের কেউ কেউ পরে চরিত্রাভিনয়ে ঝুঁকে পড়েন। ষাট দশকের সেরা নায়িকা শবনম। আসল নাম নন্দিতা বসাক। ডাকনাম ঝর্ণা। শবনম এহতেশাম সাহেবের আবিষ্কার। শবনম নামটা তারই দেয়া। প্রথমে ছোটখাটো চরিত্রে সে অভিনয় করে। এরপর নায়িকা হয় এহতেশাম সাহেবের ভাই মুস্তাফিজ পরিচালিত হারানো সুর ছবিতে। এ ছবিতে আমিও অভিনয় করেছিলাম। ছবিটি দারুণভাবে ব্যবসা সফল হয়। রজতজয়ন্তী মানে ২৫ সপ্তাহ একনাগাড়ে চলে এ ছবিটি যা এদেশের চলচ্চিত্রে প্রথম। শবনম ভাগ্যবতী এক নায়িকা। দর্শকরা সাদরে গ্রহণ করেছিল ওকে। অবশ্য ওর গুণও ছিল। নাচতে পারতো। ভালো ফিগার ছিল। ছিল সুন্দর দুটো চোখ। অভিনয়েও সে দর্শকদের মুগ্ধ করেছিল।

শবনমের পাশাপাশি কবরীর নামও আসতে পারে। কেননা উর্দু ছবিতে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাওয়ায় শবনম ব্যস্ত হয়ে পড়ে পশ্চিম পাকিস্তানে। স্বামী রবিন ঘোষসহ সেখানেই রয়ে যায়। ফলে ষাট দশকের শেষার্ধ থেকে কবরী এদেশের এক নম্বর নায়িকায় পরিণত হয়। কবরীকে যখন নিয়ে এলাম ফিল্ম লাইনে তখনই আমি বুঝতে পারছিলাম ও ভালো করবে। কেননা ওর সামনের দুটো দাঁত ছিল বড়, তাঁর পরেরটা ছোট তাঁর পরেরটা বড়। এমনটি যাদের থাকে তারা খুব ভাগ্যবর্তী হয়। আমার স্টাডি করা আছে। যেমন সুবর্ণা মুস্তফা, শ্রাবস্তী, শ্রীদেবী এদের সামনের দাঁত দুটো বড়। কবরীর সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হচ্ছে হাসি। লোকে বলতো লাখ টাকার হাসি। সত্যি কথা বলতে কী মেয়েদের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হচ্ছে তাঁর হাসি ও চোখ। গায়ের রং কিছু না। হাইটটাও কিছু না। সুন্দর হাসি ও সুন্দর চোখের জন্যেই কবরী দর্শকদের মন জয় করেছিল।

শবনম-কবরী ছাড়াও ষাট দশকের অন্য নায়িকারা হচ্ছেন সুমিতা, সুলতানা জামান, রওশন আরা, নাসিমা, শাবানা, পাপিয়া বা কবিতা, রোজিনা। এদের মধ্যে রোজী, শর্মিলী এবং আনোয়ারা পরে চরিত্রাভিনেত্রীতে পরিণত হয়।

ষাট দশকের পরিচালকদের সারিতে প্রথমে রাখব এহতেশাম, জহির রায়হান ও কাজী জহিরকে। এদেশের চলচ্চিত্র শিল্পে এহতেশামের বিরাট অবদান রয়েছে এ কথা আমি আগেই বলেছি। শুধু বাণিজ্য সফল নানা ছবিই নয়, নতুন নায়ক-নায়িকা, অভিনেতা-অভিনেত্রী ও কলাকুশলীদেরও তিনি ব্রেক দিয়েছেন। তিনি আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। ভালোবাসতেন। আজ তিনি নেই, কিন্তু তাঁর কথা এখনো আমার মনে পড়ে। জহির রায়হান বাণিজ্য সফল পরিচালক নন। তবে নান্দনিক দিক থেকে তাঁর যে অবদান তা অবশ্যই স্মরণীয়। বাণিজ্য সফল এক পরিচালক কাজী জহির। তবে তাঁর একটি ব্যধি ছিল। তিনি প্রচুর নেগেটিভ নষ্ট করতেন। ভীষণ খুঁতখুঁত ছিলেন। ডাবিংয়েও তাঁকে সহজে সন্তুষ্ট করতে পারতেন না কেউ। চরিত্রাভিনেতাদের মধ্যে প্রথমেই আমি বলব ইনাম আহমেদের কথা। মুখ ও মুখোশ থেকে তিনি শক্তিমত্তার পরিচয় দেন। তবে ষাট দশকের চরিত্রভিনেতা হিসেবে গোলাম মুস্তফা ও আনোয়ার হোসেনের দাপটটাও লক্ষ্য করা গেছে। তারাই বোধ হয় বেশি এগিয়ে গিয়েছিলেন। আর যাদের কথা এই মুহূর্তে মনে পড়েছে তারা হলেন কাজী খালেদ, সিরাজ, রাজ আহমেদ, রাজ, মেসবাহ, মেহফুজ, নারায়ণ চক্রবর্তী, বেবী ইসলাম, তেজেন চক্রবর্তী, জাভেদ রহিম, আলতাফ, আব্দুল মতিন, শওকত আকবার।

চরিত্রাভিনেত্রীদের মধ্যে রোজী, শর্মিলী, সুমিতা, রানী সরকার, আনোয়ারা, রওশন জামিল এদের কথাই প্রথমে বলবো। এরা প্রত্যেকেই দক্ষ অভিনেত্রী। কেউ কেউ তো নায়িকা হিসেবেও পারদর্শিতার পরিচয় রেখেছেন, জনপ্রিয়ও হয়েছেন। এছাড়া তন্দ্রা, নাজনীন, বিলকিস বারী, মালতী, মায়া হাজারিকা, রহিমা খাতুন, রানী আকরাম তারাও দর্শক হৃদয়ে আসন করে নিয়েছিলেন।

কৌতুক অভিনেতাদের কথা আর কী বলবো? আমি নিজেই তো সেই সময়ে কৌতুক অভিনেতা হিসেবে ছিলাম তৎকালীন পাকিস্তানের দুটি খণ্ডেই। এছাড়া সাইফুদ্দিন, রবিউল, খান জয়নুল, আশীষ কুমার লৌহ, জলিল, হাসমত এরাও দর্শকদের হাস্যকৌতুকের যোগান দিতে বেশ তৎপর ছিলেন এবং পারঙ্গমও।

ক্যামেরাম্যানদের মধ্যে সাধন রায়, আফজাল হোসেন চৌধুরী, কিউ এম জামান ও বেবী জামানকে বেশি গুরুত্ব দেব। কেননা, এরা ছিলেন পাইওনিয়ার এবং দক্ষ। তারপরই বলবো আরো কয়েকজনের কথা তারা হলেন, এম এ সামাদ, অরুণ রায়, আব্দুল লতিফ বাচ্চু এবং খান আরিফুর রহমান।

একটি ছবিতে সম্পাদকের গুরুত্বও কম নয়। কেননা, সম্পাদকের টেবিলেই ছবিটি দ্বিতীয়বার নির্মিত হয়। ষাট দশকের উল্লেখযোগ্য সম্পাদকের মধ্যে ছিলেন বশীর আহমেদ, নজরুল ইসলাম, নুরুন নবী, দেবনাত মজুমদার, আমিনুল ইসলাম মিন্টু, কাজী আব্দুর রহিম, ইসমাইল তালুকদার মন্টু।

কাহিনীকার, চিত্রনাট্যকার, সংলাপকার খুবই কম ছিল। সৈয়দ শামসুল হক ছিলেন দক্ষ স্ক্রিপ্ট রাইটার। তাঁর একটি ব্যধি রয়েছে। স্থিরতা নেই। তিনি একটি ছবিও নির্মাণ করেছিলেন। তবে মনোযোগ দিয়ে কাজ করলে একেবারে ফাটাফাটি অবস্থা। এর প্রমাণ তিনি বারবার রেখেছেন। এছাড়া আমজাদ হোসেন, আশীষ কুমার লৌহ, সুরুর বাঙালিও স্ক্রিপ্ট রাইটার হিসেবে তখন নাম করেছিলেন।

সুভাষ দত্ত পরিচালিত প্রথম ছবি ‘সুতরাং’, এ ছবির নায়কও ছিলেন তিনি, বিপরীতে অভিনয় করেন কবরী

ষাট দশকের স্মরণীয় গানের স্রষ্টাদের মধ্যে আমি বলব সৈয়দ শামসুল হক, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, কে জি মোস্তফার কথা। সত্যি তারা চমৎকার গান লিখতেন। সৈয়দ হকের অনেক সাধের ময়না আমার, গাজী মাজহারুল আনোয়ারের আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল, আবু হেনার তুমি যে আমার কবিতা এখনো কি শোনা যায় না?

সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে সেই সময় বিশেষভাবে নাম করেছিলেন রবিন ঘোষ এবং সত্য সাহা। আলতাফ মাহমুদ, খান আতা, খন্দকার নুরুল আলম, ধীর আলী মিয়া এবং সুবল দাসও ছিলেন জনপ্রিয়। গায়ক-গায়িকা হিসেবে ষাট দশকে অনেকেরই দাপট ছিল। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে কয়েকজনের কথা, আব্দুল আলীম, মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার, মোহাম্মদ খুরশীদ আলম, বশীর আহমেদ, সৈয়দ আব্দুল হাদী, মাহমুদুন্নবী, খন্দকার ফারুক আহমেদ, লায়লা আর্জুমান আরা বেগম, ফেরদৌসী রহমান, মাহবুবা রহমান, শাহনাজ রহমতউল্লাহ, সাবিনা ইয়াসমিন। এরা গানে গানে দর্শকদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিলেন।

সেই সময়ে ১৯৬৫ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। এ ধরনের উৎসব এদেশে প্রথম, আর এই উৎসবে আমিও পুরস্কৃত হই।

শুধু ঘটনা নয়, দুর্ঘটনাও ঘটেছিল ষাট দশকে। আর এই দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিলেন রহমান ও আনোয়ার হোসেন। বোধ হয় ১৯৬৩ সালে মসউদ আহমেদ চৌধুরীর প্রীতি না জানে রীতি ছবির আউটডোর শুটিংয়ের জন্য ইউনিট নিয়ে সিলেটে গিয়েছিল। আমারও এ ছবিতে থাকার সম্ভাবনা ছিল। আমাকে অফার দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আমি চেয়েছিলাম দুই হাজার টাকা। তখনকার দিনে দুই হাজার টাকা কিন্তু কম নয়। প্রযোজক এ টাকা দিতে অস্বীকার করায় আমার আর সিলেট যাওয়া হয়নি। আমার পরিবর্তে এরা রানুকে নিয়ে গিয়েছিল। তো সিলেট প্রীতি না জানে রীতি’র শুটিং করতে গিয়ে এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় পা হারায় রহমান। আমি শুনেছি শুটিং প্যাকআপ হবার পরে রহমান হোটেলে ফিরছিল। শাহজালাল নাকি শাহ পরাণের মাজারের কাছ দিয়ে গাড়ি যাচ্ছিল। রহমান বসেছিল ড্রাইভারের পাশে একটা পা বাইরে রেখে। গাড়ির অন্যরা বলছিল আমরা সবাই এ সময় সালাম করি আর আপনি গাড়ির বাইরে পা রেখেছেন। রহমান কথাটিকে গুরুত্ব না দিয়ে বলেছিল ধুর কী হবে। একটা ট্রাক আসছিল বিপরীত দিক থেকে। সেই ট্রাকের সঙ্গে গাড়ির একটু ধাক্কা লাগে। গাড়ি বা অন্য কারোই কিছু হয়নি। কিন্তু এতে রহমানের একটি পা কাটা যায়। সিলেটে তাৎক্ষণিকভাবে চিকিৎসা হয় পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজেও চিকিৎসা চলে। তারপর লন্ডন থেকে রহমান কৃত্রিম পা লাগিয়ে আসে। রহমান কিন্তু এ ঘটনায় ভেঙে পড়েনি। নতুন উদ্যমে কাজে ঝাপিয়ে পড়ে। পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। মিলন ওর প্রথম ছবি। এ ছবিতে পশ্চিম পাকিস্তানের নায়িকা দিবা বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করেছিল। আমিও অভিনয় করেছিলাম এ ছবিতে।

দ্বিতীয় দুর্ঘটনায় আনোয়ার হোসেন তাঁর নাক হারান। এটাও রোড এক্সিডেন্টে। আনোয়ার হোসেনের নাকটি খুবই সুন্দর ছিল। ওর নবাব সিরাজউদ্দোলা ছবিটি দেখলেই তা বোঝা যাবে। ওর এখনকার নাকটি প্লাস্টিক সার্জারির অবদান।

কয়েকজনের বিয়ের কথাও মনে পড়েছে। ১৯৬৫ সালে বিয়ে হয় শবনম ও রবিন ঘোষের। এ হলো প্রেমের বিয়ে। আমরা সবাই আনন্দ করেছিলাম এ বিয়েতে। তারপর জহির বিয়ে করে সুচন্দাকে। তখন কিন্তু ওর ঘরে স্ত্রী, সুমিতা। জহির ও সুচন্দার বিয়ে সেই সময়ে আলোচিত হয়েছিল।

সুজাতা আর আজিমের বিয়েটিও বেশ নাটকীয় ছিল। ওরা যেহেতু ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ছিল সেহেতু বহু কাঠখড় পুড়িয়েই বিয়ে হয়েছিল ওদের। নীরবে নিভৃতে। আর হ্যাঁ এটাও প্রেমের বিয়ে। সেই সময়ে সবাইকে জানান দিয়ে বেশ জাঁকজমকের সঙ্গে বিয়ে করেছিল নাদিম। এহতেশাম সাহেবের মেয়েকে। চলচ্চিত্র জগতের আমরা সবাই নাদিমের বিয়েতে যোগ দিয়েছিলাম।

ষাট দশকের অনেকেই এদেশের চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগ বলে আখ্যায়িত করে। আমি স্বর্ণ বা রৌপ্য যুগ বলব না। আমার কথা হচ্ছে ষাট দশক ছিল এদেশের চলচ্চিত্রের প্রিলিমিনারি স্টেজ। তখন আমরা একটি সিঁড়ির ধাপে উঠেছিলাম। সিঁড়ির একটি ধাপে উঠার পরে মানুষ কী চিন্তা করে? ভাবে আরো আরো উপরে উঠব। আরো এগিয়ে যাব। কিন্তু ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের একটি প্রচণ্ড ধাক্কা দেয়। ফলে সমাজ-রাষ্ট্র-চারদিকে একটি অস্থিরতা। এই অস্থিরতার ঢেউ চলচ্চিত্র শিল্পকে আঘাত করে। তাই সামনের দিকে যতটুকু আমাদের অগ্রসর হওয়া উচিত ছিল ততটুকু হতে পারিনি।

ষাট দশক সম্পর্কে একটি কথা বললে অনেকে হয়তো বিরূপ হবেন, কিন্তু আমি বলবো, সেই সময়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নির্মিত সত্যজিৎ রায়-মৃনাল সেন- ঋত্বিক ঘটক-তপন সিংহ-সবই বাদ দিলাম শুধু উত্তম-সুচিত্রা অভিনীত ছবিগুলোই যদি ধরি, সেই মাপের ছবি কি আমরা তৈরি করতে পেরেছি? আর সেই মাপের অভিনয়? উত্তমের অভিনয় ছিল খুবই সহজ-সরল। মনে হয় যেন অভিনয় করছে না। আর আজ এই ২০০৪ সালে এসে মনে হয় সবাই যেন অভিনয় করছে। আসলে অভিনয় কী? যে কোনো চরিত্রকে যথাযথভাবে রূপায়ন বা চরিত্রায়নের নামই অভিনয়। সেই অভিনয় কি আমরা এখন দেখছি?

ষাট দশক তো আমাদের জীবনে ফিরে আসবে না, সেই সময়ের ছবিগুলোকে যদি রক্ষা করা যেত। অনেক ছবিই নষ্ট হয়ে গেছে। গত বছর ফিল্ম আর্কাইভে গিয়ে দেখেছিলাম ছবি রক্ষা করার সঠিক ব্যবস্থা নেই। নিজস্ব জেনারেটর নেই। অযত্ন-অবহেলায় ছবির প্রিন্টগুলো ক্যান বন্দি অবস্থায় পড়ে আছে। আমাদের ছবিগুলো যদি রক্ষিত হতো তবে সেই ছবির মাঝে বেঁচে থাকত ষাট দশক।


মন্তব্য করুন