Select Page

সুপার হিরো : সুপার প্রয়াস!

সুপার হিরো : সুপার প্রয়াস!

সুপার হিরো
পরিচালনা : আশিকুর রহমান
অভিনয়ে : শাকিব খান, শবনম বুবলি, তারিক আনাম খান, সাদেক বাচ্চু, মার্গারেট জি রোলিং, মাহমুদুল ইসলাম মিঠু, টাইগার রবি, পীরজাদা হারুন, সাইফুল আকবর সাদি ও সালমান আরিফ।
রেটিং : ৩/ ৫

‘জ্বালাও পোড়াও চিরশত্রুর ঘাটিতে, লাল সবুজের পতাকা ওড়াও পৃথিবীর এই মানচিত্রে। কেউ রেহাই পাবেনা, যতই হোক সেয়ানা। এটা বাঘের সীমানা, থাবা মিস হবে না। সুপার হিরো..ওওওও সুপার হিরো!’ আশিকুর রহমানের ‘সুপার হিরো’ ছবির গল্পের শুরুটা বেশ গতি সমৃদ্ধ এই গানের মধ্য দিয়ে।

‘সুপার হিরো’ শব্দদয় মাথায় এলেই আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে অলৌকিক শক্তির অধিকারী সুপারম্যান, স্পাইডারম্যানদের কথা। কিন্তু ওরা তো কল্পনার দুনিয়ার হিরো। দেশের শত্রুদের নিজ মাতৃভূমি থেকে উচ্ছেদের জন্য যারা জীবনপণ বাজি রাখে, তারাই তো সত্যিকারের সুপার হিরো। এমন ভাবনা থেকেই ৩০ বছর সফলতার সঙ্গে চলচ্চিত্র প্রযোজনা করা হার্টবিট প্রডাকশনের নতুন ছবি ‘সুপার হিরো’ এবারের ঈদে মুক্তি পেয়েছে।

সব ছবির পরিচালক নামকরণের সার্থকতা পর্দায় প্রমাণ করতে পারেন না। তবে আশিকুর রহমান এ ছবির প্রথম দৃশ্য থেকেই স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছেন, বাংলার মায়ের দামাল ছেলেরা, যারা দেশের জন্য অকাতরে নিজেদের জীবন বিলিয়ে দিতে পিছপা হন না, তাদের নিয়েই এ ছবি।

‘সুপার হিরো’ ছবির প্রথম দৃশ্য দেখেই বুঝে গেলাম অ্যাকশন আর থ্রিলারের রোলার কোস্টার রাইডে চড়তে হবে ২ ঘন্টা ২৭ মিনিট। যদিও স্পেশাল ফোর্স কমান্ডার অফিসার ইকবাল মাহমুদ সামি’র (শাকিব খান) সাদামাটা আগমনে কিছুটা ধাক্কা খেয়েছি। সুপারস্টার নায়কদের আমরা বরাবর নায়কের বেশেই দেখতে ভালোবাসি, যা এখানে পাইনি। তবে সান্ত্বনা দেই নিজেকে, নির্মাতা হয়তো নায়কের ওপর গল্প না সাজিয়ে গল্পকে দিন শেষে নায়ক করতে চাইছেন। বিষয়টি প্রশংসনীয়। তার চেয়েও বেশি প্রশংসনীয় চেনা সুপারস্টারকে অচেনা কিংবা নতুন এক বেশভূষায় আমাদের সামনে উপস্থাপন করতে পেরেছেন তিনি।

বলতে দ্বিধা নেই, ভারতের বাংলা ছবিতে শাকিব খানের লুক পরিবর্তন হলেও দেশের খুব কম ছবিতেই নির্মাতারা শাকিব খানের লুক কিংবা ভিন্ন ধরনের চরিত্রে তাকে দিয়ে অভিনয় করানো নিয়ে ভেবেছেন। আশিকুর রহমান এ ক্ষেত্রে সফল। স্পেশাল ফোর্স অফিসারের পোশাকে শাকিব খানকে লেগেছে দুর্দান্ত।

‘সুপার হিরো’ ছবির গল্পের সীমানা বাংলাদেশ থেকে একটা সময় অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমায়। অতঃপর আবারো ফিরে আসে বাংলাদেশে। এর মাঝেই গল্পের ভাঁজে ভাঁজে একে একে যুক্ত হন কে এম খলিল (তারিক আনাম খান), এনালিসা (মার্গারেট রোলিং), সীমা (শবনম বুবলি), সামির বাবা (সাদেক বাচ্চু), জুনায়েদ (টাইগার রবি) সহ আরো অনেকে। খুব সোজাসাপ্টাভাবে বললে, স্পেশাল ফোর্স কমান্ডার অফিসারদের নিয়ে এর আগে ‘ঢাকা অ্যাটাক’-এর মত ছবি হলেও একের পর এক টুইস্ট ও আরো অনেক থ্রিল বিবেচনায় ‘সুপার হিরো’র মত ছবি বাংলাদেশে এর আগে হয়নি।

শাকিব খানের ছবিতে অন্যরা সাধারণত গুরুত্ব পান কম। এ ছবিতে যা হয়নি। এ বিষয়টি নির্মাতাদের সাহসী উদ্যোগই বলবো। দেলোয়ার হোসেন দিলের সময়োপযোগী গল্পের ভাবনা বিবেচনায় শতভাগ সফল ‘সুপার হিরো’। তবে চিত্রনাট্য সাজাতে গিয়ে বরাবরের মত এবারও তালগোল পাকিয়ে ফেলেছেন আশিকুর রহমান। থ্রিলার গল্পে টুইস্ট থাকবেই। তবে চিত্রনাট্য আরো সহজ-সরল হতে পারতো। নায়িকা শবনম বুবলির চরিত্র আরো সহজবোধ্য হতে পারতো। সামির সঙ্গে তার বাবার (সাদেক বাচ্চু) রসায়ন ক্লিশে না হয়ে আরো হৃদয়গ্রাহী হতে পারতো।

বিদেশের মাটিতে ছিনতাইকারী থাকতেই পারে। তবে বাংলাদেশি পিটারকে (সালমান আরিফ) অস্ট্রেলিয়ার ছিনতাইকারী না দেখিয়ে অন্য কোনো চরিত্রেও দেখানো যেত। পিটারের বাংলাদেশের প্রতি টান কিংবা রাজের (সাইফুল আকবর সাদি) গল্পগুলো আরো আকর্ষণীয় হতে পারতো। নায়িকার প্রতি নায়কের এবং পরবর্তীতে নায়কের প্রতি নায়িকার প্রেমে পড়ার কারণগুলো আরো যৌক্তিক হতে পারতো। প্রেমের গল্পগুলো এ ছবির অন্যতম মাইনাস পয়েন্ট। সারা বিশ্বে ‘সুপার হিরো’ নিয়ে নির্মিত ছবিগুলোতে সুপার ভিলেনরাও সমান ক্ষমতার অধিকারী কিংবা কিছু ক্ষেত্রে বেশি ক্ষমতা ধারণ করে। আশিকুর রহমান যেহেতু রক্ত মাংসে গড়া ‘সুপার হিরো’ দেখিয়েছেন, তার বিপরীতে অসীম ক্ষমতাধর কোনো ‘সুপার ভিলেন’কে প্রত্যাশা করেছিলাম। পাইনি।

যদিও চিত্রগ্রাহক হিসেবে আশিকুর রহমানের কাজ বরাবরই প্রশংসনীয়। এবারও তিনি নিজের মেধা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে সফল হয়েছেন। অ্যাকশন দৃশ্যগুলোতে (বিশেষ করে শেষ ক্লাইমেক্সে) ক্যামেরার কাজ ছিল ভীষণ নান্দনিক। ড্রোন ক্যামেরায় ধারণ করা কিছু দৃশ্য ছিল চোখ ধাঁধাঁনো। এসব কারণ বিবেচনায় কারিগরি দিক দিয়ে আশিকুর রহমানের চলচ্চিত্র থেকে আমাদের প্রত্যাশা থাকে বেশি। কিন্তু নির্মাতা আমাদের আশা-ভরসায় বেশ কিছু দৃশ্যেই এবার পানি ঢেলে দিয়েছেন। বেশ কিছু ভুল এড়িয়ে যেতে চাইলেও কিছু ভুল ছিল অমার্জনীয়। বিশেষ করে নায়কের প্রথম দৃশ্যেই কিছু ভুল ছিল, যা সম্পাদক (অনয় সোহাগ) সংশোধন করতে পারতেন। ক্রোমার কাজে ভয়াবহ রকমের দুর্বলতা ছিল ছবি জুড়ে।

সীমার (বুবলি) জন্মদিনের অনুষ্ঠান তো কার্টুন ছবিকেও হার মানিয়েছে। এই জন্মদিনের অনুষ্ঠানের জন্য আবার ঢাকার বেইলি রোডের সুইস থেকে সুদূর সিডনিতে কেক নিয়ে যাওয়া হয়েছে! শুধু কি তাই? শাকিব খানের অস্ট্রেলিয়ায় পা রাখার প্রথম দুটি দৃশ্য, পার্টিতে বারান্দায় শাকিব খানকে বুবলির দেখা হওয়ার দৃশ্য, গাড়িতে শাকিব-বুবলির দৃশ্য (যেখানে বুবলি প্রশ্ন করেন, সত্যি না হয় বুঝলাম কিন্তু সুন্দরটা কি), অস্ট্রেলিয়া থেকে ঢাকায় বাবার কাছে শাকিব খানের ফোন কল করার দৃশ্যসহ আরো বেশ কিছু দৃশ্যে ক্রোমার কাজ ছিল একই সাথে নিম্নমানের ও অসহনীয়। বোমা অপসারণের দৃশ্যে বোমা বিস্ফোরণ কিংবা মিসাইল প্রক্ষেপণের দৃশ্যগুলো আরো বাস্তবিক, শৈল্পিক হতে পারতো। বাজেটের সীমাবদ্ধতা নয়, এ ধরনের ছবির জন্য পোস্ট প্রডাকশনে যে পর্যাপ্ত সময় দেয়া হয়নি, তা পর্দায় ধরা পড়েছে।

তাছাড়া এ ছবিতে বড় ধরনের আরো বেশ কিছু অসঙ্গতি হজম করা কষ্টকর ছিল। অস্ট্রেলিয়া আসা মাত্রই ঢাকায় বাবার সাথে ফোনে কথা বলা অবস্থায় শাকিব খান ছিনতাইকারীর শিকার হন। ছিনতাইকারী শাকিব খানের মুঠোফোন নিয়ে পালিয়ে যান। এরপর ধাওয়া এবং অতঃপর মুঠোফোন ফিরে পাওয়া। অনেকটা সময় খরচ হয়েছে এখানে। অথচ এই পুরোটা সময় বাবা সাদেক বাচ্চু ফোনের অপরপ্রান্তেই অপেক্ষারত ছিলেন! এ দৃশ্যে বুবলির উত্তপ্ত হবার গল্পটিও আরোপিত মনে হয়েছে। ছিনতাইকারী পিটার যখন গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যে আলেক বোগানের কথা বলে, তখন আবহে হাস্যরসের সুর বাজে। এ বিষয়টিও ছিল শ্রুতিকটু।

এনালিসা সীমাকে বলেন, সামি আর তোমার নাম একই। শুধু দুটি অক্ষর আগে-পরে। তাই কি? সীমা আর সামির নামের পার্থক্য তো কার-এ। অক্ষরে নয়। সংলাপ রচয়িতা এ বিষয়গুলোতে আরো যত্নশীল হতে পারতেন। বিরতির দৃশ্যে নায়ককে দেখতে পেলে এবং আরেকটু চমক থাকলে ভালো হতো। বোমা অপসারণে ব্যর্থ হবার পর উত্তেজনাকর একটি দৃশ্যের ঠিক পরপরই সাদেক বাচ্চুর সংলাপ (যে মাংসের ভাঁজে ভাঁজে রক্ত পাওয়া যায়, সেটিই টাটকা গরুর মাংস) গল্পের গতিকে খর্ব করেছে। ছবির শেষ দিকে কোনো রকম সাহায্য না নিয়ে নায়কের খল চরিত্রের বাড়িতে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল হাস্যকর। তাছাড়া শেষ ক্লাইমেক্সে খল চরিত্র যখন জাহাজের ভেতরে ঢুকে মিসাইল প্রক্ষেপণ করতে গেলেন, তিনি কেন ভেতর থেকে দরজা আটকে দিলেন না? এই খল চরিত্রের পরিণতিও খুব সহজভাবে দেখানো হয়েছে। নায়িকা এ দৃশ্যে ‘নায়ক’ হয়ে গেলেন। তিনিই বোতাম টিপে সমূহ দুর্ঘটনা থেকে দেশবাসীকে রক্ষা করলেন। তিনিই খল চরিত্রকে গুলি করলেন। এ সময় নায়কের বলিষ্ঠ ভূমিকাও দেখতে চেয়েছিলাম। অথচ তাকে জুনায়েদের (টাইগার রবি) সঙ্গে অ্যাকশন দৃশ্যেই লম্বা সময় ব্যস্ত রাখা হয়েছে।

স্পেশাল ফোর্স কমান্ড সেন্টার থেকে একবার বলা হয়েছে হাতে তিন মিনিট সময় আছে। কিন্তু দুই মিনিট পরও ঘড়ি সেই তিন মিনিটেই আটকে ছিল। ঘড়িতে চিত্রনাট্যকারের ব্যাটারির যোগান দেয়ার প্রয়োজন ছিল! জাহাজ থেকে নায়ক এবং নায়িকার বেরিয়ে পড়ার দৃশ্যগুলো বিষদভাবে দেখতে পেলে আরো জমে যেত। ‘সুপার হিরো’ ছবির প্রথম ভাগের চিত্রনাট্য অনেক বেশি আকর্ষণীয় হবার সুযোগ ছিল। আদতে যা হয়নি। বিরতির পর অবশ্য একের পর এক টুইস্ট দর্শককে আসনে বসিয়ে রাখতে বাধ্য করেছে। এ ধরনের গল্পে বেগের সাথে আবেগের সম্মিলন করা গেলে সোনায় সোহাগা হতো। তবে ‘সুপার হিরো’তে মানবপ্রেম কিংবা দেশপ্রেমের বিষয়গুলো বিচ্ছিনভাবে এসেছে। ফুলগুলো ছিল ঠিকই, তবে দক্ষভাবে মালা গাঁথাটা হয়নি। আর এরজন্য চিত্রনাট্যকার ও সংলাপ রচয়িতাই দায়ী।

তবে এত সব আক্ষেপের পাশে ‘সুপার হিরো’ নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে আমার উচ্ছ্বাস-ও কম নয়। এ ছবিতে খল চরিত্রের মৃত্যু ছিল গল্পের প্রথম টার্নিং পয়েন্ট। আয়োজনের দিক দিয়ে প্রযোজক-পরিচালকের সদিচ্ছার কমতি ছিল না। অস্ট্রেলিয়ার মনোরম লোকেশনে বাংলাদেশের ছবি দেখাটা ছিল চোখের জন্য ভীষণভাবে স্বস্তিদায়ক। সত্যিকারের অস্ত্র (পরিচালকের ভাষ্য অনুযায়ী) থেকে হেলিকপ্টার কোনো কিছুর কমতি ছিল না এ ছবিতে। শেষ ক্লাইমেক্সে ১৬ তলা পরিত্যক্ত জাহাজে অ্যাকশন দৃশ্য ধারণ ছিল ছবির বাড়তি পাওনা। বলা যায় সেরা দৃশ্য। কারণ এ দৃশ্যে অ্যাকশন কোরিওগ্রাফি ছিল অসাধারণ। এর বাইরে এ ছবিতে একটি ‘ছুরি যুদ্ধ’ দেখানো হয়েছে, দুটি বন্দুক যুদ্ধ, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার দৃশ্য, শেষ ক্লাইমেক্সে জাহাজে বোমা বিস্ফোরণের দৃশ্য রয়েছে-এক কথায় প্রতিটি দৃশ্যই বেশ যত্নের সাথে ধারণ করা হয়েছে।

বলা বাহুল্য, পুরো ছবি জুড়েই আবহ সংগীত এবং সিজি’র কাজ ছিল আন্তর্জাতিক মাপের। রঙের বিন্যাস কিছু দৃশ্যে ভালো লাগেনি। তবে এ ছবির অন্যতম বড় সীমাবদ্ধতা: গানের ব্যবহার। উপমহাদেশে গান ছাড়া চলচ্চিত্র আমরা ভাবতেই পারি না। তবে ‘সুপার হিরো’ ছবিতে প্রতিটি গান ছিল অপ্রত্যাশিত অতিথির মত। একটি চলচ্চিত্রে গানের সংযোজন হয় কাহিনিকে আরো জীবন্ত, হৃদয়গ্রাহী করার জন্য। ‘সুপার হিরো’তে হয়েছে উল্টোটি। শ্রুতিমধুর এবং দৃষ্টিনন্দন গানগুলোও বিরক্তির উদ্রেক করেছে কাহিনির গতি খর্ব করার কারণে। এ ছবিটি সংগীত বিহীন হতে পারতো অথবা একান্তই গান যুক্ত করতে চাইলে প্রতিটি গানের আগে যুক্তি সহকারে মুহূর্ত তৈরি করা যেত।

এ ছবিতে গান রয়েছে মোট ৫টি। শিরোনাম গানের প্রতি মুগ্ধতার কথা আগেই বলেছি। তবে শুনতে ভালো লেগেছে রবিউল ইসলাম জীবনের লেখা, আকাশ সেন ও তৃষা চ্যাটার্জীর গাওয়া ‘তোমাকে আপন করে’ গানটি। এ গানে শাকিব খানকে দেখে আরো একবার গর্ব হয়েছে যে, তিনি আমাদের দেশের নায়ক। তার অভিব্যক্তি ছিল লা-জওয়াব! তবে বুবলির সমালোচিত সেই পোশাকটির ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবার যত্নশীল হওয়া উচিত ছিল। আইটেম গান ‘সোনা বন্ধু’ আমজনতার জন্য তৈরি। তবে এ গানটি না থাকলেও গল্পে কোনো ব্যতয় ঘটতো না। সুদীপ কুমার দীপের লেখা নাভেদ পারভেজের সুর ও প্রতীক হাসান-শাওরিনের গাওয়া ‘বুম বুম’ গানটি দেখতে ও শুনতে কোনোটিই ভালো লাগেনি। এ গানের সুরে আবছাভাবে বলিউডের ‘রেইস’ ছবির ‘খা’ব দেখে’, ‘তা রা রাম পাম’ ছবির ‘আব তো ফরেভার’ এবং বিশেষ করে ‘কি এন্ড কা’ ছবির ‘হাই হিল’ গানের প্রভাব লক্ষ্য করেছি। নকল না হলেও ঐ তিন গানের অনুপ্রেরণায় যে ‘বুম বুম’ গানটি নির্মিত তা বোঝা যায়। তাছাড়া এ গানের নৃত্য পরিচালনা এবং বুবলির সাজ-পোশাক ও শাকিব খানের মেরুণ রংয়ের গেঞ্জিতে তাকে দেখতে ভালো লাগেনি। সুদীপ কুমার দীপের লেখা, আলী আকরাম শুভর লেখা, কনা ও ইমরানের গাওয়া ‘এক পলকে’ গানটিতে বলিউডের ‘কাভি খুশি কাভি গাম’ ছবির ‘ইউ আর মাই সোনিয়া’ গানের প্রভাব ছিল সুস্পষ্ট। তবে এ গানের লোকেশন, কোরিওগ্রাফি এবং শাকিব খানের লুক ও পোশাক ছিল দুর্দান্ত।

অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে ‘সুপার হিরো’ ছবিতে শাকিব খান একাই নায়কোচিত হবার সুযোগ পাননি। কাহিনিতে তারিক আনাম খান এবং শবনম বুবলিও গুরুত্ব পেয়েছেন বেশ। তবে শাকিব খানই তার অভিনয়, অ্যাকশন, নাচের দক্ষতার কারণে পূর্ণ নাম্বার পাবার যোগ্যতা রাখেন। এ ছবিতে তাকে সম্পূর্ণ নতুন গেটআপে, ভিন্ন ধরনের চরিত্রে এবং অসাধারণ অ্যাকশন দৃশ্যে দেখতে পারাটা ছিল তার ভক্তদের জন্য আশীর্বাদ। নিজ অভিনয় গুণে শাকিব খান চরিত্রের প্রতি সৎ ছিলেন পুরোটা সময় জুড়ে। অনেক ছবিতেই শাকিব খানকে পাঁচ মিশালী অভিব্যক্তি দিতে হয়। হাস্যরস থেকে অতি অভিনয়ের মেলো ড্রামা, বড় বড় বুলি আওড়ানো-একজন নায়ককে প্রায়ই ফর্মূলার ঘোরাটোপে বন্দী করে রাখা হয়। তবে ‘সুপার হিরো’ ছবিতে নির্মাতা প্রায় ভুলিয়ে দিয়েছেন শাকিব খানকে। এ ছবিতে তিনি স্পেশাল ফোর্স কমান্ডার অফিসার ইকবাল মাহমুদ সামি হয়েই ছিলেন। দরদ দিয়ে তার চরিত্রটি লেখা হলে, সংলাপ আরো বেশি ক্ষুরধার হলে তার চরিত্রটি অন্য উচ্চতায় পৌঁছে যেতে পারতো। তবে সার্বিকভাবে এবারের ঈদে শাকিব খানের তিন ছবির মধ্যে একমাত্র এ ছবিতেই তার অভিনয় ছিল হাততালি দেবার মত। যদিও বুবলির সঙ্গে এ ছবিতে তার জুটি ছিল বেমানান। নায়িকার সঙ্গে তার কোনো রসায়নই তৈরি হয়নি।

শবনম বুবলি এ ছবিতে যথেষ্ট অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছেন। তার চরিত্রের বেশ কিছু বাঁক ছিল। যা দর্শককে কখনো বিস্মিত, কখনো চমকে দিয়েছে। তবে গল্প ভাবনায় বুবলির চরিত্রটি আকর্ষণীয় হলেও তার ‘সীমা’ চরিত্রটি দর্শকদের বেশ দ্বিধান্বিত করেছে। বিশেষ করে শেষ ক্লাইমেক্সে মূল খল চরিত্রের সামনে তার নিজের পরিচয় প্রকাশের গল্পটি অবিশ্বাস্য ঠেকেছে। ছবিতে তার প্রথম দৃশ্য থেকে বেশ কিছু দৃশ্যেই সাদামাটা সংলাপ ও অপ্রয়োজনীয় দৃশ্যের কারণে ‘সীমা’ চরিত্রটি গল্পে উত্তাপ ছড়াতে পারেনি। বিশেষ করে শাকিব খানের কাছ থেকে ল্যাপটপ চাইবার দৃশ্য থেকে বুবলির সাজ ও পোশাক তার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মানানসই মনে হয়নি। আরোপিত মনে হয়েছে। তবে অ্যাকশনে বুবলি অন্য অনেক নায়িকার চেয়ে ভালো করেছেন। অভিব্যক্তিতে আরো উত্তরণের ক্ষেত্র থাকলেও সংলাপ প্রক্ষেপণ, উচ্চারণ ও সাবলীল অভিনয়ের দিক দিয়ে বুবলি বেশ ভালো।

তারিক আনাম খান শক্তিশালী অভিনেতা। কোনো সন্দেহ নেই। ‘সুপার হিরো’ ছবিতে মিসাইল বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানীর চরিত্রে তাকে নির্বাচন করার জন্য পরিচালক বিশেষ ধন্যবাদ পাবেন। তার গেটআপ, অভিনয়-সবকিছুতেই ছিল চমক। তবে এ ক্ষেত্রেও আমি বলবো, তারিক আনাম খানের চরিত্র নিয়ে চিত্রনাট্যকার ও সংলাপ রচয়িতার আরো অনেক বেশি খেলবার সুযোগ ছিল। ব্যক্তিগতভাবে এমন অভিনেতাকে আমি নিয়মিত চলচ্চিত্রে দেখতে চাই।

টাইগার রবির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। তার ‘ম্যঁও ম্যঁও’ মুদ্রাদোষ বিরক্তির উদ্রেক করলেও অ্যাকশন ও অভিনয়ে পূর্ণ নাম্বার পাবেন তিনি। সংক্ষিপ্ত হলেও তার চরিত্রটিতে আরো অনেক বেশি রং ছড়াবার ক্ষেত্র ছিল। তবে টাইগার রবি অভিনেতা হিসেবে তার চরিত্রের প্রতি আন্তরিক ছিলেন। তাকে কেন চলচ্চিত্রে নিয়মিত ব্যবহার করা হচ্ছে না, প্রশ্ন থেকেই যায়।

মার্গারেট জি রোলিং আইটেম গানের গন্ডি ছাড়িয়ে এ ছবিতে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন। দু-একটি দৃশ্যে সুঅভিনয় করেছেন। তবে তার ভয়েস মড্যুলেশন ও অভিব্যক্তি নিয়ে আরো কাজ করতে হবে। মাহমুদুল ইসলাম মিঠু (বড় দা মিঠু), পীরজাদা হারুন এ ছবিতে অভিনয় করার সুযোগ পাননি। সাইফুল আকবর সাদি ও সালমান আরিফ নতুন হিসেবে চোখে পড়েছেন। সাদেক বাচ্চুর চরিত্রটি ছিল এ ছবির সবচাইতে দুর্বলতম চরিত্র। শাকিব খানের সঙ্গে তার প্রথম দৃশ্যেই বুঝে গিয়েছে ছবিতে তার পরিণতি কি হবে? গল্পের গতি বার বার খর্ব এবং দীর্ঘকায় করেছে এ চরিত্রটি। অথচ এ চরিত্রটিই সঠিকভাবে লেখা হলে অনেক বেশি আবেগ এবং বোধের জায়গাগুলো বাস্তবিক হতে পারতো।

সার্বিকভাবে এবারের ঈদে ‘সুপার হিরো’ নিঃসন্দেহে দেশীয় চলচ্চিত্র হিসেবে একটি ভিন্ন প্রয়াস। আশিকুর রহমান ও প্রযোজক হার্টবিটকে ধন্যবাদ শাকিব খানকে নিয়ে ভিন্ন ধারার একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য। তবে ভবিষ্যতে এ ধারার ছবি করার আগে যুৎসই গল্প, চমকের বুননে ঠাসা ক্ষুরধার চিত্রনাট্য ও সংলাপ এবং বাজেট বিবেচনায় রেখে পোস্ট প্রোডাকশনে পর্যাপ্ত সময় ও মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন। চাইলেই দেশের নির্মাতারা আন্তর্জাতিক মাপের চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে পারেন। সেই মেধার ইঙ্গিত আমরা পেয়েছি। এবার মেধার স্ফূরণ দেখবার অপেক্ষায়…!

*রিভিউটি সংক্ষেপে সমকাল ২৮ জুন সংখ্যায় প্রকাশিত।


Leave a reply