Select Page

সেইসব বিস্মৃত হাসিমুখ

সেইসব বিস্মৃত হাসিমুখ

লেখার নিমন্ত্রণ কখনো নিমন্ত্রকের গুণে বিশেষ হয়ে ওঠে। কখনো কখনো এর বিষয়বস্তুর গুণে তা অনন্য হয়ে যায়। নাহলে এই পত্রিকার পাতায় প্রথমবারের মতো হাজির হওয়ার জন্য চলচ্চিত্র বিষয়ক কোনো রচনা আমার জন্য সেরা বাছাই নাও হতে পারত। কিন্তু হয়েছে। বিলীয়মান কারখানার শিল্পীদের বিষয়ে রচনা নিজগুণে বড় হাতছানি। বিশেষত তাদের নিয়ে যারা খোদ সচলকালেও ছিলেন অতিশয় মুস্কিলের এক বর্গ। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে কৌতুকাভিনেতা।

দিলদার, রবিউল, এটিএম শামসুজ্জামান ও টেলি সামাদ

সাহিত্যের দাপ্তরিক ভাষায় যতই ‘কৌতুকাভিনেতা’ বলা হোক, সাধারণ কথ্যভাষাতে এদের পরিচয় ছিল কমেডিয়ান বা ভাঁড় হিসেবে। স্বাধীনতার আগে থেকেই, আরও নিবিড়ভাবে তদন্ত করে বললে, নিম্ন ৭০’র দশক থেকে সুপ্রতিষ্ঠিতভাবে, বাণিজ্যসফল বা বাণিজ্যপ্রবণ ছায়াছবিগুলোতে কৌতুকাভিনেতার দাবি ও প্রচলন দুই-ই ব্যাপক হারে ছিল। একজন অন্তত শক্তিমান এবং/বা জনপ্রিয় কৌতুকাভিনেতা প্রায় সব ব্যবসাকারী ছবিরই বৈশিষ্ট্য ছিল। প্রায়শই, নায়ক বা প্রটাগনিস্ট চরিত্রের নিকটজন বা সমর্থক হিসেবে এরা এসেছেন। কিছু বিরল ক্ষেত্রে কৌতুকাভিনেতাকে পাওয়া যায় খলের সমান্তরালে, তার অনুগত হিসেবে। খান জয়নুল, আনিস, রবিউল, টেলিসামাদ, এ টি এম শামসুজ্জামান, আশীষ কুমার লোহ, দিলদার প্রমুখ অনেক নাম এই কাতারে আসবে। কিছু পরের প্রজন্ম চিনেছেন আফজাল শরীফকে। খুব বেশি নাম এই পর্বকাল থেকে নেওয়া যে যায় না সেটার কারণ আসলে চলচ্চিত্রের ধারণাগত কারিগরি বদলের মধ্যেই। কৌতুকাভিনেতাদের গুরুত্ব দিয়ে স্ক্রিপ্টে রাখার কাজই কমে গেছে। কিংবা, তাদের চরিত্রগুলোর ধার-ভার কমে গেছিল। আবার, অভিনেতাদের শৈলী নিয়ে আলাপ উঠতেই পারে।

চরিত্রের ভার কিংবা ধার, আর অভিনেতাদের শৈলী প্রসঙ্গে তর্ক লম্বা হতে পারে। কিন্তু এই মীমাংসা অপেক্ষাকৃত সহজ হবে যে কৌতুকাভিনেতার সাংস্কৃতিক বা মর্যাদাগত মূল্য চিরকালই ঊণ থেকে গেছে। সেই পরিস্থিতিটার একটা গুরুতর উদাহরণ পাওয়া যায় যখন ‘কমলা রকেট’ ছায়াছবির জন্য মোশাররফ করিমকে ‘কৌতুক অভিনেতা’ হিসেবে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দেওয়া হয় এবং তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। পুরস্কার প্রদানকারীদের কাণ্ডজ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন করা অতীব জরুরি, বিশেষত ছায়াছবিটির সারবস্তু বিবেচনা করলে। কৌতুকাভিনেতাদের যে চাকরিবিধি বাংলাদেশের ছায়াছবিতে আগের বছরগুলো থেকে এসেছিল, তার বিচারে কোনোভাবেই মোশাররফ করিম কৌতুক চরিত্রে অভিনয় করেননি। তবে বাংলাদেশে যেসব প্রতিষ্ঠান সংস্কৃতি-সাহিত্য-শিল্প নিয়ে পর্যালোচনা করেন, তাদের কাছে চিন্তাশীল লোকজন অনেক দিন ধরেই আর কাণ্ডজ্ঞান আশাও করেন না। মোশাররফ করিম পুরস্কারটি প্রত্যাখ্যান করে খুবই দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন বলে আমি মনে করি। তবে ‘সিরিয়াস’ বনাম ‘কৌতুক’ বা ‘নায়ক’ বনাম ‘নায়কের বিশ্বস্ত কমেডিয়ান অনুচর’ এই বিভাজনের গল্পরেখা নিয়ে আমার বিশেষ আগ্রহ-আস্থা নেই। প্রসঙ্গটির গুরুত্ব বিবেচনা করে আমার ‘সাহিত্যবোধ’ আমি বলতে ছাড়লাম না আরকি!

মোশাররফ করিম একভাবে চিত্তাকর্ষক উদাহরণ। কারণ তার অভিনয় দক্ষতা অমিত হলেও, টেলিভিশনে তিনি বছরের পর বছর আসলে কোনো না কোনোভাবে ‘কৌতুকাভিনেতা’ হিসেবে পরিসীমিত হয়ে ছিলেন। বরং, চলচ্চিত্রেই তিনি তার অভিনয় দক্ষতার প্রমাণ রাখবার বিস্তর সুযোগ পেয়েছেন। বিষয়টা ভাববার মতো, আয়রনিক। লক্ষণীয় যে, আমাদের তালিকাতে যে নামগুলো এলো তার প্রায় সবগুলোই চলচ্চিত্রের নাম, কেবল আফজাল শরীফ এর ব্যতিক্রম। তিনি টিভিতে জনপ্রিয়তার সূত্র ধরে চলচ্চিত্রের কাজে গিয়েছিলেন। বাকিদের ক্ষেত্রে তা নয়। এই বাস্তবতাটা খোদ মাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্রের বয়স আর টেলিভিশনের বয়সের সঙ্গে সম্পর্কিত। টেলিভিশন যেকালে একটা মাধ্যম হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, ততদিনে বাকিরা চলচ্চিত্রের প্রতিষ্ঠিত তারকা। অধিকাংশই টেলিভিশনে কখনো কাজ করেননি। বা করলেও নগণ্য। এখানেও ব্যতিক্রম আছেন একজন এ টি এম শামসুজ্জামান। তিনি টেলিভিশনে দোর্দণ্ড প্রতাপে কাজ করেছেন। এমনকি মধ্যবিত্তের যে প্রজন্ম তেমন একটা প্রেক্ষাগৃহে যাননি কখনো, তারা একে আনকোরা চেনার সুযোগ পেয়েছেন মুখ্যত টেলিভিশনে। টেলিভিশনে জনাব শামসুজ্জামানের কৌতুকাভিনয় দক্ষতারই বহুবিধ প্রয়োগ করার সুযোগ নিয়েছেন নির্মাতারা। চাইলে কেউ আশীষ কুমারের নামও সংযোজন করতে পারবেন; তবে তিনিও চলচ্চিত্র কাঁপানোর পরের ধাপে টেলিভিশনে আসেননি।

দারুণ প্রতিভাবান এই অভিনেতা (এ টি এম) অবশ্য কেবল চলচ্চিত্রের মধ্যেও স্বতন্ত্র কারণে উল্লেখের দাবিদার থাকেন। কৌতুকাভিনেতা এবং খল অভিনেতা হিসেবে যুগল-মুকুট ধারণের কৃতিত্ব খুব কম অভিনেতার রয়েছে। তিনি সেখানে প্রায় অনন্য। এটা বলবার সময়ে দুজন অভিনেতাকে স্মরণে আনছি। একজন অবশ্যই মুম্বাই কারখানার উৎপল দত্ত। তবে উৎপল দত্তের বেলায় বিষয়টা ঠিক শামসুজ্জামানের মতো নয়। শামসুজ্জামানের প্রধানত খল হিসেবে আবির্ভাব আর প্রধান কৌতুকাভিনেতা হিসেবে আবির্ভাব প্রায়শই ভিন্ন প্রকল্পের বা ছায়াছবির ছিল। আরও গবেষণা করলে সম্ভবত এই প্রস্তাবটা দেওয়া যেত যে, এ টি এম খল হিসেবে দুর্দান্ত সফল হওয়ার পর কৌতুকের কাজগুলো কম পেতেন বা নিতেন। পক্ষান্তরে, উৎপলের অনেকগুলো খল চরিত্রই মৃদুখলত্বের ওপর দাঁড়ানো এবং সেখানে কৌতুকগিরি তার খলত্বের সঙ্গে মেশানোই থাকত; প্রায়শই পারিবারিক পরিমণ্ডলের গল্পে। তবে ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবিতে তার কৌতুকদক্ষতাকে নির্মাতা তীব্রভাবে খলগিরিতে প্রয়োগ করিয়েছিলেন। অন্য উদাহরণ হচ্ছেন ডিপজল। তার অভিনয় বা চলচ্চিত্রীয় ব্যক্তিত্ব নিয়ে বিস্তর বিশ্লেষণ জনজবানে আছে। আমি আজ উল্লেখ করব প্রথমত এটা যে, নৃশংস খল হিসেবে ডিপজল অভিনয়-যাত্রার/অ্যাক্টিং-লাইনের গুরুতর রদবদল করেছেন। উপরন্তু, তিনি খুবই অসচরাচর কিছু সংলাপ ও ভঙ্গি/এট্যিটুড খল চরিত্রে সংযোগ ঘটিয়েছিলেন। সেই হিসেবে তার দ্বারা রূপায়িত খল চরিত্রগুলোর একটা কমিক্যাল বৈশিষ্ট্য বেশ সহজেই পাঠ করা যায়। যেহেতু তার অভিনীত ছবিগুলোর বেশ বড় একটা অংশের তিনি নিজেই প্রযোজক, কখনো কখনো প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে স্ক্রিপ্টকার/সংলাপ-রচয়িতা, তাই নির্মাণীয় কৃতিত্ব/ অকৃতিত্বের সিংহভাগও তারই পাওনা।

খুব কম আলাপের মধ্যেও চলচ্চিত্রের কৌতুকাভিনেতাদের নিয়ে যে আলাপটা কখনো চোখে বা কানে পড়েনি আমার, তা হচ্ছে যৌন পরিসরের দেনদরবারে এদের ভূমিকা। বাস্তবে কৌতুকাভিনেতা প্রায় ব্যতিক্রমহীনভাবে পুরুষ, আর যৌন-উদ্ভাসক চরিত্রগুলো ব্যতিক্রমহীনভাবেই নারী (ছিলেন); সেখানে পুরুষ-কৌতুকাভিনেতাদের যৌন-পরিসরীয় ভূমিকা নিয়ে আলাপ তোলা বেশ খাপছাড়া লাগতে পারে। কিন্তু, একটু শান্তভাবে মনোযোগ দিলে সেই প্রবণতাটা ছায়াছবির ইতিহাসে দেখা সম্ভব। ‘ভালমানুষ’ নায়ক, যার কি না একটা হেটারোসেক্সুয়াল চুমু দিতে গেলেও নির্মাতাদের বাগানের দুইটা বাতাসে-চঞ্চল ফুল দেখাতে হয়, কিছুতেই যৌনতার দায়/ভার যখন গ্রহণ করবেন না, তখন পুরুষজাতির বেজায় চেপে-রাখা-যৌনেচ্ছার একটা পর্দারূপী অবতার হিসেবে এসব কৌতুকাভিনেতার জব ডেস্ক্রিপশন নির্ধারিত হয়েছিল। দিলদারের জীবনে এটা হয়তো দৃষ্টান্তমূলকভাবে বেশি ছিল, তবে অন্য অনেকেরই কাছাকাছি কর্মকাণ্ড করতে হয়েছে। যে নায়িকার উরুপানে ‘চরিত্রবান’ নায়ক কিছুতেই ‘ভালোমতো’ তাকাবেন না, সেই নায়িকারই সখীর উরু বা কোমরপানে নায়কের ‘সখা’ কৌতুকাভিনেতা এমনভাবে তাকাবেন যে দর্শকও (অন্তত পুরুষ দর্শক) না বুঝে থাকতে পারবেন না যে ‘কী দেখা হচ্ছে’ ও ‘কীভাবে’। এরকম কাজ আশীষ কুমারকেও করতে হয়েছে (ছবির নাম এখন পুনরাবিষ্কার করা কঠিন)। আবার রবিউল তার সহশিল্পী নারীর সঙ্গে ঠোঁট দিচ্ছেন ‘ও ছুঁড়ি তোর গাছের পাকা জাম্বুরা ফল কে খাবে’ (সহশিল্পী বা ছায়াছবি এখন পুনরাবিষ্কার অসম্ভব)। বাস্তবে এখানে ‘জাম্বুরা’র উপমার গুণ ও রুচি নিয়ে সারা দিন আপনারা তর্ক করতে পারেন; কিন্তু এটা ছায়াছবির জন্য তখন অবধারিত ছিল, এবং সেটা কিছুতেই ‘চরিত্রবান’ নায়ক ‘সুশীলা’ নায়িকার সঙ্গে (তখন) করতেন না। এই কাজগুলো তখন রবিউল সাহেবদের জন্যই নির্ধারিত ছিল। ফলত, প্রায় অযৌন নায়কের সঙ্গে এই চরিত্রগুলোর সম্পর্ক অত্যাবশ্যক সহগের।

ইরটিক ইঙ্গিতবাহী কাজকর্মে এরা না থাকলে নায়করা আলু বা মুলার মতো ভেজিটেবল থাকেন বা থাকতেন এই অনুভূতি-রাজ্যে। যেমনটা আগেই বলেছি, দিলদার এই বিশেষ ভূমিকায় সম্ভবত সবচেয়ে দায়িত্বশীল হিসেবে ছিলেন। উত্তরকালে নায়করা খোদ এসব কাজের জন্য মনোনীত হলেন, তাই নায়িকারাও। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে ইরটিসিজমের রাজদণ্ড, বলা চলে, কৌতুকাভিনেতারা ঐতিহাসিকভাবেই হারালেন। ঠিক এই কারণেই উত্তরকালে কৌতুকময় চরিত্রের অবলোপ বা গুরুত্বহানি হতে শুরু করেছে সেটা আমার বক্তব্য বা থিসিস নয়। কিন্তু রূপান্তরটাকে আঙুল তুলে দেখানোতে বাধা পাই না কোনো।

আজীবন কৌতুকাভিনেতা হিসেবে বিরাজমান অভিনেতাদের কেন্দ্রীয় চরিত্র বানিয়ে ছায়াছবি হয়েছে। কলকাতায় ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে, কিংবা মুম্বাইতে মেহমুদকে নিয়ে। সেসব ছবির কিছু ব্যবসাসফল, কিছু মর্মান্তিক লোকসান করেছে। বাংলাদেশেই তুলনামূলকভাবে উদাহরণ কম পাওয়ার কথা। এমনকি সাবেক কালের কথাই হচ্ছে। তবে একটা বা দুটো ব্যবসাসফল ছবি থাকলেই সাংস্কৃতিক মর্যাদার প্রশ্নে এই অভিনেতাদের উল্লম্ফন ঘটে যায় না। এই কাজগুলো পর্দায় যতটা চঞ্চল যতটা কৌতুকাশ্রয়ী (বা অন্তত তৎপর), পর্দার বাইরে চলচ্চিত্র বা শিল্পচর্চার ইতিহাসে ততটাই মর্মস্পর্শী। এই মুহূর্তে গোটা আলাপটাই আরও নিরর্থক যখন বড় পর্দার অস্তিত্বই আসলে আর নেই। নেই সেসব মিলনায়তন যেখানে নানান রুচির সংঘর্ষের মধ্যেও, নানান শ্রেণির মানুষের অভ্যন্তরীণ লড়াই সত্ত্বেও, প্রেক্ষাগৃহের পর্দা ছিল তুলনামূলকভাবে সর্বজনীন। সর্বজনীন পর্দার বিলুপ্তি একটা গভীর রাজনৈতিক প্রসঙ্গ, বিষাদেরও; আর কদিন পরেই বিস্মৃতিরও প্রসঙ্গ হবে তা। ঠিক যেমন এই হাসিমুখ অভিনেতারা!

*লেখাটি দেশ রূপান্তর পত্রিকার চতুর্থ প্রতিবার্ষিকী সংখ্যায় প্রকাশিত


About The Author

মানস চৌধুরী

লেখক, শিক্ষক ও নৃবিজ্ঞানী

Leave a reply