Select Page

সাপলুডু: ক্ষমতা অপরাধের উৎস নাকি ক্ষমতাবানের অস্ত্র!

সাপলুডু:  ক্ষমতা অপরাধের উৎস নাকি ক্ষমতাবানের অস্ত্র!

সিনেমা তখন শেষ! একদম হতাশ হয়ে ফিরছিলাম! কলাকুশলীদের নাম স্ক্রোল করে যাচ্ছিলো আমি মাথা নিচু করে বের হতে যাচ্ছিলাম! আর তখনই সদ্য উচ্চপদ পাওয়া আরমান সাহেবের প্রেস ব্রিফিং-এর মাঝে ফোন! অপর পাশ থেকে কে জানি বলছে “কি মনে করেছিস, খেলা শেষ”! আমি থমকে গেলাম এই ভেবে যে টিকেট কি এখনিই আরো একটা কিনবো কিনা! পরে মনে হলো হুশ হুশ একসাথে দুই সিনেমা বানানো যায় নাকি ?

যাই হোক বলছিলাম “সাপলুডু” নামক এক সিনেমা নিয়ে কিঞ্চিত নিজের ভাবের একাংশ, চলুন চলে যাই সম্পূর্ণ ভাব প্রকাশে! আর হ্যা আগেই বলে নিচ্ছি খারাপ-ভালো যাই প্রকাশ করতে চাচ্চি তা সম্পূর্ণ আমার নিজের একান্ত চিন্তা-চেতনা। এ নিয়ে কেউ কাদা ছোড়াছুঁড়ি করবেন না, করলেও শুধু কাদা মাইরেন সাথে ঢিল মাইরেন না! তো খেলা শুরু করা যাক।

সবার আগে আমি আমার বৃদ্ধাঙ্গুলি নিচের দিকে ধাবিত করবো একটাই কারণে! যা এই সিনেমার মার্কেটিং কিংবা প্রচার প্রচারণা দলের আঁতে-ঘা লাগতে পারে। জ্বী হ্যা আপনাদের বিজ্ঞাপনী কৌশল যথেষ্ট হতাশাজনক ছিলো! এতো আগে যে সিনেমার নাম শুনেছি তার ছিলো না কোনো ইউটিউব ব্রান্ডি না ছিলো কোনো ফেইজবুক ব্রান্ডি! বলা চলে অনলাইন ব্রান্ডিং ছিলো বেশ হতাশাজনক! এমনকি নগরীর ব্যস্ত কিছু জায়গায় পর্যন্ত এই সিনেমার ‘আসিতেছে’ টাইপ পোষ্টার দেখি নাই (কাজের সুবাধে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেবেড়ানো হয়)। যদিও শেষের দিকে দু একটা প্রোমো ভিডিও প্রোমো দেখেছিলাম। খেয়াল করে দেখবেন শাকিব খান যে সিনেমাই বানাক না কেনো সেই সিনেমার মার্কেটিং হয় খুব জোরেসোরে! আপনারা চাইলেই টিভি চ্যানেল গুলোতে পপ আপ স্ক্রিণ কিংবা এল শেইপ মুভেবল পোষ্টার দিয়ে মার্কেটিং করতে পারতেন যা বেশ এফেক্টিভ! যাই হোক করলে হয়তো এতো কিছু লিখা লাগতো না, তো খেলার প্রথম ভাগে যাওয়া যাক!

পরিচালনা এবং বাদবাকি?
➖➖➖➖➖➖➖➖➖
জনাব দোদুল সাহেব শুনেছিলাম বেশ ছোট বেলা থেকেই মিডিয়াতে আছেন, তাঁর পরিচালিত বেশ কয়েকটি নাটক দেখা হয়েছে, উল্লেখ করলে বলা যায় ‘সংসার’ নাটকটি বেশ লেগেছিলো। তো এবার প্রথমারের মতো সিনেমা নির্মাণে তাঁকে দেখে আগ্রহের কমতি ছিলো না। যদি বলি চরিত্র নির্ধারণের কথা তাহলে দোদুল সাহেব পাবেন ১১/১০। আমাদের দেশে প্রচলিত আছে সিনিয়ার অভিনেতা মানেই একঘেয়েমি যা বলতে গেলে একদম ভুল প্রমাণিত করেছেন এই নির্মাতা। সচরাচর সব সিনেমায় হিরোর এন্টি মারমার কাটকাট হয়ে থাকে তবে এই সিনেমায় নির্মাতা হিরোর একদম সাদামাটা এন্ট্রি দিলেও লাইম লাইটে থাকা বাকি কলাকুশলীদের এন্ট্রি দিয়েছেন অসাধারণ এবং যা নিঃসন্দেহ প্রশংসা পাওয়ার দাবি রাখেন। এরপরে আসা যাক আবহসঙ্গীতের ধাপে, সেখানেও দেখা মিললো প্রতিভার ছড়াছড়ি। মোটকথা সিনেমার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আবহসঙ্গীত আপনাকে বিরক্ত তো করবেই না বরং কানকে বেশ আরাম প্রদান করবে। বিশেষ করে ‘শতাব্দী ওয়াদুদের’ এন্ট্রি মিউজিক বেশ শ্রুতিমধুর ছিলো। সঙ্গীতের কথা যখন আসলো তখন আরো একটু বলি, কোনো ফিল্মের গান মানে যাকে আমরা সিনেমার গান এবং বেশি ঢাকঢোল পেটানো গানকে আইটেম সং বলে থাকি। সিনেমার গান হিসেব করলে তিনটা (আরো থাকতে পারে মনে নেই) তাঁর মাঝে একটা আইটেম সং যার প্লেসমেন্ট দেখে আমি বেশ মুগ্ধ, গল্পের ছন্দে ছন্দে আইটেম সং’এর কারসাজি বাহ! অসাধারণ বললে কম হবে। তথাকথিত আইটেম সং থেকে এই গানের মাঝে বেশ চাকচিক্য পেলাম, সেট নির্মাণ বেশ সময় নিয়ে করা হয়েছে বুঝাই যায়। লাষ্ট টিকাটুলির মোড় গানে এমন চাকচিক্যতা পেয়েছিলাম। এছাড়া হৃদয়ের খানের “কিছু স্বপ্ন” গানটি বেশ শ্রুতিমধুর ছিলো। সব মিলিয়ে সিনেমার প্রতিটি গানের প্লেসমেন্ট বেশ ভালোই ছিলো। এবার চলে আসি কালার গ্রেডিং ধাপে, যেহেতু থ্রিলার কাম একশ্যান ফিল্ম সেহেতু কিছু কিছু জায়গায় ভালো মানের একশ্যান ক্যাম ইউজ করলে বেশ জমতো যদিও ইউজ না করাতে তেমন আন-ইজি লাগেনি তবে করলে ভালো হতো। কিছু কিছু জায়গায় কালার গ্রেডিং খুব বেশি চোখে লাগলেও অন্য দিকে ডার্ক শট গুলোতে কালার গ্রেডিং তেমন থ্রিলিং ভাব আনতে পারে নি! তবে রেগুলার শট গুলোর কালার গ্রেডিং বেশ বাণিজ্যিক ধারার বলা চলে। সব মিলিয়ে কালার গ্রেডিং চোখের প্রশান্তি আনতে সক্ষম থাকবে। এছাড়া বাংলাদেশের কিছু অজানা লোকেশন গুলো তিনি যেভাবে তুলে ধরেছেন তা যেকোনো মানুষের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিবে এদেশেও ভালো লোকেশন আছে। অন্য দিকে সিনেমার স্ক্রিপ্ট বেশ শক্ত ছিলো, এই স্ক্রিপ্ট আপনাকে শেষ অবধি বসিয়ে রাখবে যেমনটা আমি ছিলাম। ডায়লগের ক্ষেত্রে তেমন ক্যাচি কোনো কিছু না থাকলেও, প্রতিটা অভিনেতা অভিনেত্রী নিজের বেশ সাবলীলতা প্রকাশ করেছেন। আর নিঃসন্দেহে বলা যায় এই স্বাধীণতা খোদ নির্মাতাই দিয়েছেন। তো সব মিলিয়ে পরিচালনা এবং বাদবাকি বেশ ভালো বলা চলে, এবার পরের খেলায় যাওয়া যাক।

অভিনয়সংক্ষেপ?
➖➖➖➖➖➖➖
⭕শতাব্দী ওয়াদুদ
খুব বেশি শক্তিশালী অভিনেতা, যারা গেরিলা এবং ঢাকা এট্যাক দেখেছেন তারা হয়তো জানেন উনি পজেটিভ কিংবা নেগেটিভ দু’ক্ষেত্রেই সেরা। খুব বেশি হলে ২-৩মিনিট স্ক্রিণে থেকেছেন আর এতো অল্প সময়ে নিজের জাত আপনার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে যাবেন নিশ্চিত থাকেন। তাঁর লুক, এক্সপ্রেশন, গেটআপ একদম বেশি দারুণ ছিলো। এছাড়া তাঁর এন্ট্রি দেখে আপনি বেশ অবাকই হবেন।

⭕সালাউদ্দিন লাভলু
যারা এখনো “লাল সবুজ” সিনেমাটি দেখেন নি তাঁরা জলদি দেখে ফেলুন এবং এরপরেই ‘সাপলুডু’ দেখতে যাবেন এটা আমার অনুরোধ। কারণ যারা উনার অভিনয় দেখেন নি তারা প্রথমে ভাবতেই পারেন এ কে কিংবা ইনি কেনো! যদিও মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধান ভুলেই যাবেন কার অভিনয় দেখছেন। মজার বিষয় ছিলো একদম ফরমাল অভিনয়ের মাঝে টুক করেই সিরাজগঞ্জের ভাষা ঢুকিয়ে দেওয়া, যা দিয়েছিলো বেশ বিনোদন। লাভলু সাহেব যদি নিয়মিত এ ধরণের চরিত্রে অভিনয় করতেন তাহলে না কতোই ভালো হতো। একজন পুলিশ হুট করেই রোমান্টিক স্বামী আবার হুট করেই নিজের প্রেজেন্টেশনে মনোযোগী আবার হুট করেই সহাস্যমুখ দিয়ে সবাইকে হাসানো বাহ বেশ উপভোগ করেছি।

⭕বিদ্যা সিনহা সাহা মীম
লাবণ্যময়ী মেয়ে লাবণ্য ছড়াবে এটাই স্বাভাবিক। আমি সব সময় একটা জিনিষ খেয়াল করেছি, মীম সব সময় পরিমিত হারে মেকআপ ব্যবহার করে, যা ক্যামেরায় দেখতে বেশ দারুণ লাগে। যদিও আমি উনাকে সরাসরি দেখেছি, উনি এতো সুন্দর যা বলে বুঝানো যাবে না। আফসোস একটাই উনাকে এখনো কেউ আহামরিভাবে কাজে লাগাতে পারেনি। আশা করছি মীমের ক্যারিয়ারে খুব ধামাকা কিছু যুক্ত হবে অতিশীঘ্রই। যদিও এই ফিল্মে তেমনভাবে কিছু দেখাতে পারে নি, কোনোরকম চলনসই আর কি।

⭕আরিফিন শুভ
সত্যি বলতে আমি শাকিব খানের চাইতে বেশি সিনেমা দেখেছি আরিফিন শুভর। অনেক বেশি ডেডিকেটেড এই লোকটা। তবে তেতো হলেও সত্য উনার স্টেনবাই লুক গুলো এখনো অপরিপক্ব। আপনি নিজেই খেয়াল করবেন যখন শুভ নৌকায় দাঁড়িয়ে ছিলো আর বাম পাশ থেকে ড্রোনশট নেওয়া হয় তখন তাঁর দাঁড়ানো বেশ বেমানান ছিলো। একজন অভিজ্ঞ মডেলের থেকে এমন দাঁড়ানোর স্টাইল দেখে বেশ হতাশ আমি। তবে তাঁর অভিনয়ে বলা চলে বেশ উন্নতি’ই হয়েছে। তবে এটাও সত্যি উনার নিজেকে আরো তৈরি করা বাকি, সত্যি বলতে উনার মাঝে অনেক প্রতিভা আছে যা আস্তে আস্তে আমাদের সামনে চলে আসবে। আমার দেখা তাঁর সেরা অভিনয় ছিলো নিয়তি এবং ঢাকা এ্যাটাকে তবে শুনেছি আহারে সিনেমায় বেশ করেছেন।

⭕জাহিদ হাসান
শক্তিমান অভিনেতার অপর নাম “জাহিদ হাসান”। এই ফিল্মের প্রাণ ভোমরা বলা চলে। প্রথম থেকে শেষ করা অবধি নিজের দ্যুতি ছড়িয়ে গিয়েছেন। পুরো সিনেমা জুড়ে ছিলো না কোনো ওভার এক্টিং ছিলো না কোনো অযাচিত এক্সপ্রেশন, যদিও এই শব্দ গুলো উনার সাথে একদমই বেমানান। হলফ করে বলা যায় এ বছর মেরিল হোক কিংবা জাতীয় চলচ্চিত্র হোক যেকোনো একটা পুরস্কার তিনি পাচ্ছেন।

✔সব মিলিয়ে সকলের অভিনয় ছিলো চোখের প্রশান্তি, এছাড়া তারিক আনাম খান, সুষমা সরকার, মারজুক রাসেল, রুনা খান সকলেই ছিলেন নিজের জায়গায় সেরা। তবে রুনা খান এবং মারজুক রাসেল’কে আরো কিছুক্ষণ স্ক্রীনে দেখা গেলে বেশ লাগতো।

কাহিনীসংক্ষেপ?
➖➖➖➖➖➖
জনাব এনায়েত সাহেব বাংলাদেশের দুর্গম এক এলাকার এমপি, সৎভাবে কাজ করার জন্য তাঁর বেশ সুনাম। কিন্তু ইদানিং তাঁর এলাকাতে বেশ কিছু অপ্রত্যাশিত ঘটনার কারণেই সকলের কথার তোপের মুখে পরেছেন। উপর মহল থেকেও বেশ চাপ আসছে, সব মিলিয়ে এনায়েত সাহেব বেশ চিন্তিত। ঘটনার শুরু এক ফটোগ্রাফার নিখোঁজ হবার পর থেকেই, কাকতালীয় ভাবে সে ফটোগ্রাফার ছিলেন তাঁরই ইউনিভার্সিটির ফ্রেন্ড। এছাড়া কিছু বিচ্ছিন্ন হত্যা কান্ড যা আবার তাঁরই এলাকার রেশ ধরে আগাচ্ছে! তবে কি আসলেই এসকল খেলার উৎস এনায়েত সাহেব!!! নাকি তাঁরই ইশারায় সকল কার্যসিদ্ধি করছে অন্য কোনো খেলোয়াড়!! এ খেলার শেষ কি কিংবা কি বা এর ফলাফল তা জানতে অবশ্যই চলে যেতে হবে নির্ধারিত ৪২টি সিনেমা হলে।

যদিও ফিল্ম থেকে শেখার কোনো কিছু আশা করতে হয় না তাও আমার মনে হয় নিচের বিষয় গুলো আপনাদের সাথে মিলে যাবে।

▪ছোট ছোট অবহেলা গুলোই একটা সময় অতি আপনজনকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে গড়ে তোলে।

▪কাউকে অতি আপন না ভেবে ভালোবাসায় সীমাবদ্ধতা রাখুন, কে জানে গতকালের আপনজনই আজকের শত্রু।

▪অন্যায় শব্দের সাথে জড়িত যদি আপনার বাবাও হয়ে থাকে তবে তাঁকেও পরিত্যাগ করুন।

▪পৃথিবীর সবথেকে বাজে শব্দ যেমন ভালোবাসা তেমনি সবচেয়ে ভালো শব্দ গুলোর মাঝে ভালোবাসাটাই অন্যতম।

?আমার সব কথা শেষে একটা কথাই বলতে চাই “সাপলুডু” হলে গিয়ে দেখার মতো সিনেমা। একে আপনি কমার্শিয়াল তকমা না দিলেও ফিল্মটি মননশীল সিনেমা, ক্রিয়েটিভ সিনেমা। এমন সিনেমাকে সাপোর্ট দেওয়া আমাদের দায়িত্ব, অন্তত সিনেমা হল গুলোকে বাঁচানোর জন্যে হলেও! আর পরিচালকের নিকট আকুল আবেদন থাকলো, এটা যেহেতু আপনার প্রথম সিনেমা সেহেতু ভালো-খারাপ সকল মন্তব্যই পাবেন এবং এটাই স্বাভাবিক। তবে আপনার এমন অভূতপূর্ব চেষ্টা যাতে অব্যাহত থাকে এটাই চাওয়া। শুভ কামনা রইল।


মন্তব্য করুন