Select Page

সোহেল চৌধুরী অধ্যায়

সোহেল চৌধুরী অধ্যায়

সোহেল চৌধুরী আমাদের চলচ্চিত্রের অন্যতম সেরা সুদর্শন নায়ক। নব্বই দশকের প্রতিভাবান নায়কদের মধ্যে সোহেল ছিল একজন। ঢাকার বনেদি পরিবারের সন্তান। জন্ম ঢাকায় ১৯৬৩ সালের ১৯ অক্টোবর। তাঁর লুকেও সে ধরনের ছাপ আছে। ১৯৮৪ সালে এফডিসিকেন্দ্রিক ‘নতুন মুখের সন্ধানে’ কার্যক্রমের মাধ্যমে অন্যান্যদের সাথে উঠে আসে সোহেল চৌধুরী ও দিতি। পরে দিতির সাথে তার বিয়েও হয়।

বোহেমিয়ান বৈশিষ্ট্য ছিল সোহেলের। মন যা চাইত তাই করত। ঢালিউডের সোনালি দিনের বিখ্যাত পত্রিকা ‘চিত্রালী’-তে সোহেলকে ব্যতিক্রমী ছবিতে দেখা গিয়েছিল। নিজের মোটর বাইক নিজে ঠিক করছিল এমন ছবিতে দেখে অনেকেই অবাক হয়েছিল।

সোহেল চৌধুরী-র ক্যারিয়ারে ছবির সংখ্যা ৩০। উল্লেখযোগ্য ছবিগুলো হলো – পর্বত, খুনের বদলা, লক্ষীবধূ, হীরামতি, আমার ভালোবাসা, প্রেমের প্রতিদান, কালিয়া, প্রতিশোধের আগুন, হিংসার আগুন, চিরদিনের সাথী, অবরোধ, দাঙ্গা ফ্যাসাদ, প্রেমের দাবি, প্রিয়শত্রু, ভাইবন্ধু, দোষী, লেডি ইন্সপেক্টর, পাপী শত্রু, আজকের হাঙ্গামা, বিরহ ব্যথা, জুলি, মহান বন্ধু ইত্যাদি।

তৎকালীন নামকরা অভিনেত্রী অঞ্জু ঘোষের স্বামী পরিচালক এফ কবির চৌধুরী-র ‘পর্বত’ ছবিতে দিতির সাথে জুটি বাঁধে সোহেল চৌধুরী। আমজাদ হোসেন পরিচালিত ‘হীরামতি’ ছবিতে অভিনয় করতে গিয়ে দুজনের প্রেম হয় এবং বিয়ে করে তারা। তাদের ঘরে দুটি ছেলেমেয়ে লামিয়া ও দীপ্ত চৌধুরী। লামিয়া দেখতে মায়ের মতো আর দীপ্ত বাবার মতো।

সোহেল চৌধুরী-দিতি জুটি ঢালিউডের অন্যতম সেরা দর্শকনন্দিত জুটি। তাদের জনপ্রিয়তা ছিল বিপুল। এ জুটির বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের মধ্যে ‘প্রিয়শত্রু, ভাইবন্ধু, খুনের বদলা, পাপী শত্রু, হিংসার আগুন, লেডি ইন্সপেক্টর, লেডি স্মাগলার, প্রেমের প্রতিদান’ এগুলো জনপ্রিয়।

বাণিজ্যিক ছবির মধ্যে তার ‘হীরামতি, হিংসার আগুন, প্রতিশোধের আগুন, লক্ষীবধূ, প্রিয়শত্রু, প্রেমের প্রতিদান, জুলি’ এগুলো উল্লেখযোগ্য। ‘হীরামতি’ ছবির যোগী চরিত্রে আমজাদ হোসেন সোহেলকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করেছিলেন। ‘যোগী ভিক্ষা লয় না’ গানটিতে লুকটি বোঝা যায়। ‘হিংসার আগুন’-এ গর্জিয়াস কস্টিউমে তাকে দেখা গেছে। দিতির সাথে তাঁর সংসারে হুমায়ুন ফরীদির ষড়যন্ত্র শুরু হয়। পরে অরুণার সাথেও তাঁর বিয়ে হয়। অভিনয়ের দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছবিটি। ‘প্রতিশোধের আগুন’ ছবিতে সোহেলের লিপে একটা গান খুবই জনপ্রিয়। গানটি সমসাময়িক দেশের বাস্তবতা তুলে ধরে এবং নায়ক সোহেল তার থেকে মুক্তি কামনা করে-
‘একটা শুধু প্রশ্ন আমার
দেয় না রে কেউ জবাব,
এই বাংলা থেকে কবে যাবে
গরিব দুখীর অভাব’
‘প্রিয়শত্রু’ ছবিটি অন্যান্য ছবিগুলোর থেকে এগিয়ে থাকবে কারণ নেগেটিভ রোলে ছিল সোহেল। টলিউডি নায়ক প্রসেনজিৎ ছিল দিতির নায়ক। দেখার মতো বিষয় হচ্ছে ছবিতে সোহেল চৌধুরীর স্মার্টনেস ও অভিনয় প্রসেনজিৎ থেকে বেটার ছিল এমনকি তখন যে ঢালিউড টলিউডের থেকে বেটার পজিশনে ছিল এ ছবিটি তার একটা উদাহরণ।

সোহেল চৌধুরী বাণিজ্যিকের পাশাপাশি অফট্র্যাক ছবিতেও কাজ করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বিষবৃক্ষ’ উপন্যাস অবলম্বনে চাষী নজরুল ইসলাম নির্মিত ‘বিরহ ব্যথা’ ছবিতে অভিনয় করেছিল। এ ছবিতে তাঁর মৃত্যুদৃশ্যের অভিনয় অসাধারণ ছিল। চাষী নজরুলের ‘লেডি স্মাগলার’ ছবিতেও ছবিতেও ববিতার নায়ক ছিল। এ ছবির শুট হয়েছিল ফিলিপাইনে। সোহেলের পারফরম্যান্সে পরিচালক খুব খুশি ছিলেন।

সোহেলের নায়িকা দিতি-র পাশাপাশি আরো ছিল শবনম, অরুণা বিশ্বাস, প্রিয়া, মুক্তি এবং আরো কজন। কিংবদন্তি শবনমের মতো মোস্ট সিনিয়র অভিনেত্রীর সাথে ‘জুলি’ ছবিতে অভিনয় করেছিল। এটা ছিল তখনকার ব্যতিক্রমী ঘটনা। কিংবদন্তি অভিনেত্রী আনোয়ারা-র মেয়ে মুক্তি-র সাথে অভিনয় করেছে ‘আমার ভালোবাসা’ ছবিতে। বিরহ ব্যথা-তে ছিল চম্পা-র বিপরীতে।

সোহেল চৌধুরী-র ছবিতে তার কস্টিউম সিলেকশন থাকত গর্জিয়াস। দেশীয় ছবির স্টাইলিশ বা ফ্যাশনেবল নায়কদের কথা বলা হলে তার মধ্যে সোহেলও আসবে। ‘হিংসার আগুন’ ছবিটি এক্ষেত্রে অনেক বড় উদাহরণ।

সোহেল চৌধুরী-র ছবির গানের মধ্যে জনপ্রিয় কিছু গান-

আমি হৃদয় চিরিয়া দেখাব একদিন মরিয়াও প্রমাণ করিব – হীরামতি
যোগী ভিক্ষা লয় না রে – হীরামতি
স্বর্ণালী সঙ্গিনী গো – হিংসার আগুন
এই ঘর সংসার পায়ে দলে – হিংসার আগুন
যদি কোনোদিন দেখি নেই তুমি সাথে – প্রেমের প্রতিদান
দেব না দিতে ফাঁকা মাঠে গোল – প্রেমের দাবি
তোমায় দেখিনি কদিন কেমন আছো বলো – জুলি
কখনো যদি আমি হারিয়ে যাই – লক্ষীবধূ
এতদিন খুঁজেছি যারে পেয়ে গেছি আজ আমি তারে – প্রিয়শত্রু
আমি তুমি ছাড়া কিছু ভাবতে পারি না – আমার ভালোবাসা
একটা শুধু প্রশ্ন আমার – প্রতিশোধের আগুন
ও জুলি কি করে বলি – জুলি
আজকে আমি তোমার কথা শুনব – প্রতিশোধের আগুন
কেউ বলে বলুক পাগল – মহান বন্ধু

১৯৯৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর ঢাকার বনানীর ট্রাম্পস ক্লাবে রাত ২টায় আততায়ীর সামনাসামনি গুলিতে খুন হয় সোহেল চৌধুরী। চারবন্ধুসহ ক্লাবে ঘুরতে গিয়েছিল সেখানেই তাদের উপর গুলিবর্ষণ হয়। সোহেলের এক বন্ধুও খুন হয়। গুলিবিদ্ধ হবার সাথে সাথেই সোহেল মাটিতে পড়ে যায়। হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার তাঁকে মৃত ঘোষণা করে। তার মৃত্যুর পরদিন দেশে সরগরম অবস্থা ছিল মিডিয়াতে। পরদিনই আটক করা হয়েছিল তৎকালীন ধণাঢ্য ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাই-কে। যদিও সেটা শেয়ার কেলেঙ্কারির বিষয় বলে হিসেবে দেখানো হয়েছিল। তারপরেও আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সাথে সোহেল হত্যার সম্পর্ক ছিল এরকম সমালোচনা হয়েছিল। পাশাপাশি তাঁর হত্যার বিষয়ে ক্যাবল ব্যবসার আধিপত্য বিস্তার নিয়ে তৈরি সমস্যার কথাও কথিত আছে। সোহেল হত্যার বিচার আজও হয়নি।

সোহেল চৌধুরী অকালপ্রয়াত প্রতিভাবান ঢালিউডি নায়ক। যে নায়কদের খুব দরকার ছিল একটা প্রজন্মকে সুস্থ বাণিজ্যিক ছবির জন্য তৈরি করতে সে ছিল তাদের একজন। সোহেল চৌধুরী দেশের চলচ্চিত্রে অবশ্যই একটি স্মরণীয় নাম হয়ে থাকবে।


Leave a reply