স্টোরি অফ দ্য বিগেস্ট সুপারস্টার
আজকাল ঢালিউডে তারকা খুব দ্রুত হওয়া যায়। দু’একটি ছবি করলে তারকা বানিয়ে দেয়া হয়। খবর যারা ছাপে তারাও খুব তাড়াতাড়ি তারকা করে দেয়। অতীতে যে তারকারা ছিল তাঁদেরকে খুব সংগ্রাম করে একটা অবস্থানে আসতে হয়েছিল। ঠিক সেই বাস্তবতায় আমাদের চলচ্চিত্রে গর্বিত তারকা ইলিয়াস কাঞ্চন। নামটা শুধুই নাম নয় একটা প্রতিষ্ঠান।
মূলনাম ইদ্রিস আলী। জন্ম ১৯৫৬ সালের ২৪ ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জের অশতিয়াপাড়া গ্রামে। বাবা আব্দুল আলী, মা সরুফা খাতুন। ১৯৭৫ সালে কবি নজরুল কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে কাঞ্চন। ১৯৭৯ সালে জাহানারা-র সাথে কাবিন হয় এবং বিয়ে ১৯৮৩ সালে। ১৯৯৩ সালে ২২ অক্টোবর কাঞ্চনের শুটিং দেখতে যাওয়ার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। জয়, ইমা দুই ছেলেমেয়েকে বড় করতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে ইলিয়াস কাঞ্চনকে। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকত দুজন। শুটিং শেষে বাসায় ফিরলে তারা বলে-‘আম্মুকে কেন নিয়ে আসোনি।’ অনেক করুণ বাস্তবতার মধ্য দিয়ে ছেলেমেয়েদের মানুষ করতে হয়েছে তাঁকে।
নায়করাজ রাজ্জাকের সাথে খুব ছোটবেলায় দেখা হয়েছিল কাঞ্চনের। তখন তাঁর কাছে ছবিতে শিশুশিল্পীর চরিত্রে অভিনয়ের ইচ্ছা প্রকাশ করে। নায়করাজ তাঁকে আশ্বস্ত করেছিলেন। সেবারই তাঁর জীবনে প্রথমবার কোনো ফিল্মস্টারকে বাস্তবে দেখেছিল তিনি ছিলেন রাজ্জাক।
তিনি স্কাউটে কাজ করতেন। পারফর্ম করতেন স্কাউটের ক্যাম্প ফায়ারে। স্কুলে নাটক করেছিল ‘মামা-ভাগ্নে’র ভাগ্নে চরিত্রে। তার ভাগ্নে চরিত্রটি দেখে দর্শক খুব হাততালি দিয়েছিল। ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে পাকবাহিনীর হাতে পড়েছিল কাঞ্চন। তাঁকে দুই গালে চড়ও মারা হয়। ভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিল। স্বাধীনতার পরে ‘বুলবুল ললিতকলা একাডেমী’-তে রবীন্দ্র সঙ্গীত শিখত। বিটিভিতে গানের প্রোগ্রাম করেছিল দুটি।
স্কুলে ‘বাংলার মুক্তি’ নামে নাটক করেছিল। নায়িকার বাবার ভূমিকায় অভিনয় করেছিল। শিক্ষকরাও অভিনয় করেছিল। বন্ধুদের সাথে গঠিত ‘সৃজনসংঘ’ থেকে নাটক করার উদ্যোগ নেয়া হলো। আব্দুল্লাহ আল মামুনের ‘সুবচন নির্বাসনে’ নির্বাচন করা হলো। আলী ইমাম ছিলেন পরিচালক। নাটকে অভিনয় দেখে সুভাষ দত্ত ছবিতে অভিনয়ের অফার দেন। ববিতাকে দেখে বিস্মিত হয়েছিল কাঞ্চন। তার সাথে পর পর ‘বসুন্ধরা, স্বাক্ষী, ভালো মানুষ, সুন্দরী, ডুমুরের ফুল’ ছবিতে কাজ করে। ‘বসুন্ধরা’ ছবির জন্য ‘তেইশ নম্বর তৈলচিত্র’ উপন্যাসটি বাংলাবাজার থেকে কিনে পড়ে ছবিটি করতে রাজি হয়।
‘বসুন্ধরা’ ছবিতে কাজ করার জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে তাকে। আর্ট কলেজে তিনমাস ক্লাস করতে হয়েছে। জাতীয় পুরস্কার প্রত্যাশা করেছিল। জুরি বোর্ড বলেছিল, নতুন ছেলে পুরস্কার দিলে মাথা ভারি হবে। এটা নিয়ে আক্ষেপ রয়ে গেছে কাঞ্চনের।
প্রথম ছবি বসুন্ধরা ১৯৭৭ সালে। পরিচালক ‘বাবা আমার বাবা’ ছবিতে। উল্লেখযোগ্য ছবি : বসুন্ধরা, ডুমুরের ফুল, স্বাক্ষী, সুন্দরী, ভালো মানুষ, চান্দ সুরুজ, পরিণীতা, আদিল, বড়বাড়ির মেয়ে, আপন পর, কুসুমকলি, নিকাহ, বিধাতা, অভিযান, ভেজা চোখ, আপন ঘর, ঘর আমার ঘর, বোনের মতো বোন, শ্বশুরবাড়ি, সম্মান, অপরাধী, শেষ উত্তর, বেদের মেয়ে জোসনা, শেষ উপহার, অচিনদেশের রাজকুমার, আয়না বিবির পালা, নসীব, নালিশ, স্বাধীন, চাঁদকুমারী চাষার ছেলে, সর্পরাণী, রাজার ছেলে, শঙ্খমালা, প্রতিরোধ, মহান বন্ধু, মনের মিলন, দায়ী কে, আসামী গ্রেফতার, সৎ মানুষ, দুর্জয়, শাস্তির বদলে শাস্তি, বদলা নেবো, অপরাজিত নায়ক, আমার দেশ আমার প্রেম, বেঈমানী, প্রেমের প্রতিদান, স্নেহের প্রতিদান, ভাইবন্ধু, প্রেমের দাবি, নয়া তুফান, স্বার্থপর, ভাই কেন আসামী, মনে রেখো পৃথিবী, অচল পয়সা, মেয়ের অধিকার, বিদ্রোহী আসামী, বিদ্রোহী সন্তান, বিদ্রোহী কন্যা, একজন বিদ্রোহী, মুন্না মাস্তান, ভয়ঙ্কর সাতদিন, বেনাম বাদশা, অকৃতজ্ঞ, অবলম্বন, বউ শ্বাশুড়ি, প্রতিশোধের আগুন, অগ্নিস্বাক্ষর, ঘরের সুখ, প্রতারক, খুনী আসামী, মার্ডারের আসামী, চাকর, ভাই, হত্যা, গুন্ডা পুলিশ, বাহরাম বাদশা, রূপনগরের রাজকন্যা, আত্মবিশ্বাস, আত্মপ্রকাশ, আত্মত্যাগ, সহধর্মিণী, স্ত্রীর পাওনা, কসম, অকৃতজ্ঞ সন্তান, বিশ্বাস অবিশ্বাস, রঙিন মালকা বানু, মহাযুদ্ধ, তওবা, রূপের রাণী গানের রাজা, লটারি, ষড়যন্ত্র, পরমা সুন্দরী, মর্যাদা, আজকের শয়তান, আজকের বাদশা, দুখিনী মা, রতন মালা, দুখিনী বধূ ও শয়তান জাদুকর, মায়ের মন, প্রেম যমুনা, কুংফু কন্যা, শমসের, কৈফিয়ত, জিপসি সর্দার, সুখের সন্ধানে, ফুলকুমারী, সিপাহী, বাঘা আকবর, প্রেমকাহিনী, জনি ওস্তাদ, বাবার বাবা, বউ কথা কও, এক দুই তিন, নীতিবান, সহযাত্রী, খুনী, গৌরব, শর্ত, নিষ্পত্তি, মহা গ্যান্জাম, অন্ধবধূ, আইন আদালত, সেই তুফান, রঙিলা, মায়ের ইজ্জত, শিবাগুন্ডা, গোলাপি এখন ঢাকায়, বংশধর, রেশমী চুঁড়ি, সালমা, শাহী কানুন, নির্যাতন, তালুকদার, হাসি, জীবন বাজি, জেল হাজত, দয়াবান, ত্যাগ, প্রেম লড়াই, রক্তের বদলা, বদসুরত, বডিগার্ড, প্রেম প্রতিজ্ঞা, বন্ধন, জন্মদাতা, সুখের ঘরে দুখের আগুন, বাদশা ভাই, স্পর্ধা, গুপ্ত ঘাতক, মা মাটি দেশ, ক্ষমা নেই, বিক্রম, সবার উপরে মা, ভাংচুর, কালপুরুষ, রাঙা বাইদানি, শেষ রক্ষা, অন্ধ ভালোবাসা, ভণ্ড প্রেমিক, রক্তের অধিকার, আদরের সন্তান, দরদী সন্তান, ওরা সাহসী, পেশাদার খুনী, সুন্দরী মিস বাংলাদেশ, আমি এক অমানুষ, গোলাগুলি, মহৎ, পদ্মা আমার জীবন, ইজ্জতের লড়াই, ও আমার ছেলে, ছেলেকার, শাস্তি, বন্ধু তুমি আমার, কে আমি, মায়ের স্বপ্ন, বাবা আমার বাবা, মাটির কসম, এই নিয়ে সংসার, মৃত্যু কত ভয়ঙ্কর, সোহরাব রুস্তম, ঘর ভাঙ্গা ঘর, রাধাকৃষ্ণ, শিকার, তিনকন্যা, গাড়িয়াল ভাই, বাঁশিওয়ালা, সিকান্দার, আবদার, ফাঁসি, কমান্ডার, দয়ামায়া, অবরোধ, নয়া লায়লা নয়া মজনু, বাপবেটা ৪২০, অচেনা, আতঙ্ক, লালু সর্দার, কলমিলতা, আমার আদালত, আদেশ, হুঁশিয়ার, বাল্যশিক্ষা, দংশন, স্বার্থপর, অন্তর জ্বালা, দুর্নীতিবাজ, মোহনা, কাজললতা, দাগী, শান্তি অশান্তি, জুলেখা, ন্যায়যুদ্ধ, বিষকন্যার প্রেম, ইনসাফ, জবরদস্ত, আইন আদালত, পাষাণ, নবাব, পরীস্থান, হাতকড়া, মুজাহিদ, অবাধ্য সন্তান, মোনাফেক, আওয়াজ, শত্রু ধ্বংস, রাজার ভাই বাদশা, জবরদখল, মৃত্যুর মুখে, চেয়ারম্যান, ভালোবাসার শত্রু, বিদ্রোহী পদ্মা, যেখানে তুমি সেখানে আমি, আমি বাঁচতে চাই, আই লাভ ইউ, নিঝুম অরণ্যে, জটিল প্রেম, হঠাৎ দেখা, এপার ওপার, স্বর্গ থেকে নরক, হাজী শরীয়তউল্লাহ, বিজলী।
ইলিয়াস কাঞ্চন সব্যসাচী নায়ক ও অভিনেতা। ক্যারিয়ার শুরুই হয়েছে ববিতা-র মতো তখনকার টপ নায়িকার সাথে এবং সুভাষ দত্তের মতো কিংবদন্তি পরিচালকের সাথে। উদারণস্বরূপ তাঁকে রোমান্টিকে ‘আঁখি মিলন, স্বজন’-এ পাওয়া গেছে, ফ্যামিলি ড্রামায় ‘বন্ধন, অচেনা, শর্ত, আবদার, এই নিয়ে সংসার, অন্ধ ভালোবাসা, সুখের ঘরে দুখের আগুন, শেষ রক্ষা, দরদী সন্তান, চরম আঘাত, ভাইবন্ধু, মহা গ্যান্জাম, তিনকন্যা’-তে দেখা গেছে, ট্র্যাজেডিতে ‘ভেজা চোখ’-এ, অ্যাকশনে ‘বিদ্রোহী সন্তান, বিদ্রোহী আসামী, গুপ্ত ঘাতক, পেশাদার খুনী, সেই তুফান, আমার আদালত, কালপুরুষ, খুনী আসামী, অগ্নিস্বাক্ষর, মুন্না মাস্তান, বাবার বাবা, আজকের শয়তান, আজকের বাদশা’-তে, ফোক-ফ্যান্টাসিতে ‘বেদের মেয়ে জোসনা, রাজার মেয়ে পারুল, আয়না বিবির পালা, গাড়িয়াল ভাই, ঘর ভাঙ্গা ঘর, শাহী কানুন, দুখিনী বধূ ও শয়তান জাদুকর, বাঁশিওয়ালা, রূপনগরের রাজকন্যা’-তে, সাহিত্যভিত্তিক ছবিতে ‘বসুন্ধরা, নিরন্তর, ডুমুরের ফুল, শাস্তি’-তে দেখা গেছে। এভাবে বৈচিত্র্যময় হয়েছে তাঁর ক্যারিয়ার। চরিত্রকে ধারণ করে অসাধারণ অভিনয় করা তাঁর সহজাত গুণ।
ইলিয়াস কাঞ্চন পুরো ঢালিউডে বিশেষ স্থান দখল করে আছে তাঁর সর্বোচ্চ ব্যবসাসফল ছবির রেকর্ডের দিক থেকে। তাঁর অভিনীত ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ ছবিটি ১৯৮৯ সালে মুক্তি পেয়েছিল। টাকার দ্রুত আয়ের দিক থেকে ছবিটি তখন ২০ কোটিরও বেশি আয় করেছিল যার রেকর্ড আজ পর্যন্ত কোনো ছবি ভাঙতে পারেনি। কাঞ্চনের কথামতো এ ছবিকে ঘিরে অনেক ঘটনাও ঘটেছিল যেগুলো রেকর্ডের অংশ। যেমন-
* অন্তঃসত্ত্বা মহিলার বাচ্চা হয়ে গেছে সিনেমাহলে। পেটে বাচ্চা নিয়েই ছবি দেখতে এসেছিল।
* বাচ্চা ছেলে হলে নায়কের নামে, মেয়ে হলে নায়িকার নামে রেখেছে।
* ছবির নামে চুঁড়ি, ফিতা বিক্রি হয়েছে।
* ছবিটা বুকিং হয়েছিল অল্প টাকায় অথচ মুক্তির পর রেকর্ড হয়।
* অঞ্জুর পর পর ১৯টা ছবি ফ্লপ যায়। ছবির গানের টাকা ফেরত নেয়া হয়েছিল। মুক্তির পর ছবির গানের ক্যাসেট বিক্রির পর সেই টাকা দিয়ে বাড়ি বানিয়েছে ক্যাসেট মালিকরা।
* অপ্রত্যাশিত ব্যবসার কারণে অডিও ক্যাসেটের মালিক পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিল।
কাঞ্চনের সাহিত্যভিত্তিক ছবি :
বসুন্ধরা – তেইশ নম্বর তৈলচিত্র (আলাউদ্দিন আল আজাদ)
ডুমুরের ফুল – গলির ধারে ছেলেটি (ড. আশরাফ সিদ্দিকী)
নিরন্তর – জনম জনম (হুমায়ূন আহমেদ)
শাস্তি – শাস্তি (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
হঠাৎ দেখা – হঠাৎ দেখা (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
‘বসুন্ধরা’ ছবির জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রত্যাশা করেছিল কাঞ্চন। ‘শাস্তি’ ছবিতে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্প থেকে চাষী নজরুল ইসলাম নির্মিত ছবিটিতে কাঞ্চন ছিদামের বড়ভাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিল। ‘নিরন্তর’ ছবিতে পতিতা শাবনূরের খদ্দেরের ভূমিকায় অভিনয় করেছে।
চলচ্চিত্রে কাজ করতে গিয়ে স্মরণীয় অনেক ঘটনা ঘটে তার মধ্য থেকে কাঞ্চন বিভিন্ন সময় শেয়ার করেছে কিছু ঘটনা।
* ‘ভেজা চোখ’ ছবিতে মৃত্যুদৃশ্যে ছিল কাঞ্চন। তাজমহলের সামনে মৃত্যু হয় ‘জীবনের গল্প’ গানের পর। কাঞ্চনের বাবা, ভাতিজি চম্পার চোখ বেঁধে নিয়ে যায় তাজমহল দেখাতে নিয়ে গেছে। কিন্তু চোখ খুলে বাবা প্রথম দেখতে পায় ছেলের লাশ। শুটিং করতে গিয়ে তাজমহলে পারমিশন নিতেই তিনদিন গেছে। মার্চ মাসের গ্রীষ্মের খুব গরম ছিল। একটা করে শট দিয়ে স্যালাইন খেতে হত এত গরম ছিল।
* ‘গাড়িয়াল ভাই’ ছবির সময় তার পায়ে সমস্যা হয়েছিল। ডাক্তার পা কেটে ফেলতে হতে পারে বলেছিল। পরিচালক তোজাম্মেল হক বকুল তাকে বলেছিলেন নিজের পায়ে দাঁড়াতে। পেরেছিল দাঁড়াতে।
* মুক্তিযুদ্ধের ছবি ‘কলমিলতা’-য় অভিনয় করেছিল। ছবিতে এক বন্ধু তাকে বলে-‘সকালে কিছু খেয়েছিস?’ কাঞ্চনের সংলাপ ছিল-‘হ্যা, কসম খেয়েছি। যতক্ষণ পর্যন্ত একটা পাকিস্তানি হানাদার না মারব ততক্ষণ ক্ষুধা মিটবে না।’
জুটিপ্রথায় কাঞ্চনের নায়িকা ববিতা, সুচরিতা, অণ্জু ঘোষ, চম্পা, দিতি, মৌসুমী। তাদের বিপরীতে উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে আছে ববিতার সাথে ‘বসুন্ধরা, ডুমুরের ফুল, সুন্দরী, স্বাক্ষী, একজন বিদ্রোহী’, সুচরিতার সাথে ‘আঁখি মিলন, কুসুমকলি, প্রেমের প্রতিদান’, অণ্জুর সাথে ‘বেদের মেয়ে জোসনা, আয়না বিবির পালা, শর্ত, খুনী আসামী, রাজার মেয়ে বেদেনী’, চম্পার সাথে ‘ভেজা চোখ, অচেনা, সহযাত্রী, আবদার, নীতিবান, বিশ্বাস অবিশ্বাস, বন্ধন, ত্যাগ, গোলাপি এখন ঢাকায়’, দিতির সাথে ‘সৎ মানুষ, বেঈমানী, আমার দেশ আমার প্রেম, রূপনগরের রাজকন্যা, ক্ষমা নেই, চরম আঘাত, আত্মবিশ্বাস, অজানা শত্রু, প্রেমের প্রতিদান, অচল পয়সা, চাকর’, মৌসুমীর সাথে ‘শেষ রক্ষা, রাজার ভাই বাদশা, অন্ধ ভালোবাসা, সুখের ঘরে দুখের আগুন, ভাংচুর, আত্মত্যাগ, ভণ্ড প্রেমিক, স্বজন, আদরের সন্তান’ ইত্যাদি। কাঞ্চনের স্বীকারোক্তিতে জানা যায় চম্পার সাথে তাঁর বোঝাপড়া সবচেয়ে ভালো ছিল।
কাঞ্চনের অসংখ্য জনপ্রিয় গান আছে। তার মধ্যে কিছু উল্লেখ করা হলো :
বেদের মেয়ে জোসনা আমায় – বেদের মেয়ে জোসনা
জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প – ভেজা চোখ
প্রিয়া আমার প্রিয়া আজ চিঠি দিয়েছে- ভেজা চোখ
তুই তো কাল চলে যাবি – ভেজা চোখ
পারি না ভুলে যেতে – স্বাক্ষী
রংধনু ছড়িয়ে চেতনার আকাশে – বসুন্ধরা
ঐ ভীরু মন – ভালো মানুষ
কি করে বলিব আমি – সুন্দরী
সবার জীবনে প্রেম আসে – ভাংচুর
এ জীবন তোমাকে দিলাম – আত্মত্যাগ
ভালোবাসা যত বড় – চরম আঘাত
আমার এ গান তোমারই জন্য – আসামী গ্রেফতার
ও রঙিলা মনে যে লাগে এত রং – রঙিলা
কে আমি আমি কার জানি না – প্রতিশোধের আগুন
একটা শুধু প্রশ্ন আমার – প্রতিশোধের আগুন
যে জীবনে তুমি ছিলে না – সুখের ঘরে দুখের আগুন
চুপি চুপি তোমার কাছে আসব গো – মহান বন্ধু
আজ রাত সারারাত জেগে থাকব – নীতিবান
পৃথিবীর যত সুখ – সহযাত্রী
আমার মনের আকাশে আজ জ্বলে শুকতারা – প্রেমের প্রতিদান
তারায় জ্বলে ঝিকিমিকি – গোলাপি এখন ঢাকায়
তুমি এলে সমুখে – ভাইবন্ধু
ভেঙেছে পিঞ্জর – ভাইবন্ধু
বেলী ফুলের মালা পরে – বেপরোয়া
তুমি একটা ধোকাবাজ – গুন্ডা পুলিশ
আমি যে এক গানের পাখি – স্নেহের প্রতিদান
চিরদিন এ দুনিয়ায় – আত্মবিশ্বাস
আমি ভালোবাসার সুখে – বেঈমানী
আজ বড় সুখে দুটি চোখে – বেঈমানী
রূপসী বাংলার এক রূপসী মেয়ে – কমান্ডার
আমার হবে সেই বউ – শেষ রক্ষা
তোমার পথে তুমি যাও – শেষ রক্ষা
আকাশের সূর্যটা আছে যতদিন – দরদী সন্তান
ভালোবাসার সাধ – বাঁচার লড়াই
তুমি যে আমার কে – আমার দেশ আমার প্রেম
কি ভালো লাগে রে – আমার দেশ আমার প্রেম
বিষম পিরিতি – আমার দেশ আমার প্রেম
আমি দূরে চলে গেলে – বদসুরত
তুমি শুধু তুমি – বদসুরত
হাওয়ায় ওড়ে হাওয়ায় ঘোরে – বদসুরত
ধরা পড়েছি আমি এমন মেয়েরই হাতে – বিদ্রোহী কন্যা
ও মেমসাব – সৎ মানুষ
সবার কাছে প্রিয় নিজের জীবন – অচল পয়সা
তুমি আজকে যাও বন্ধু – সহধর্মিণী
সুখের দিনেও আমি তোমার – সহধর্মিণী
আমার মন এত পাগল যে – স্বজন
তোমার সাথে কিছু কথা আছে – অজানা শত্রু
নাই টেলিফোন নাইরে পিয়ন – কুসুমকলি
কেউ কোনোদিন আমারে তো – সুন্দরী
আর যাবো না এমেরিকা – অচেনা
আমি বন্দী কারাগারে – বেদের মেয়ে জোসনা
আমার এ গানখানি – বাল্যশিক্ষা
খোদা তোমার এ দুনিয়ায় – বাল্যশিক্ষা
বড়লোকের বেটি গো – চাকর
সময় হয়েছে ফিরে যাওয়ার – আদরের সন্তান
কেন তারে আমি এত ভালোবাসলাম – গোলাপি এখন ঢাকায়
নিশীথে নির্জনে গোপনে গোপনে – বাঁশিওয়ালা
বাসর বান্ধিলাম – আয়না বিবির পালা
বলো না কোথায় ছিলে – ত্যাগ
ঠিক ঠিক মনে রবে এই দিন তারিখ – ত্যাগ
আকাশকে প্রশ্ন করো – শর্ত
প্রেম কখনো মধুর – মহৎ
ও মানুরে সুন্দর মানু – বসুন্ধরা
আমার গরুর গাড়িতে বউ সাজিয়ে – আঁখি মিলন
প্রেমেরই অনুরাগে – দায়িত্ব
চাক্কু মেরে এই কলিজায় – মহা গ্যাঞ্জাম
আমার জীবন তুমি – অন্ধ ভালোবাসা
কথা বলব না বলেছি – আঁখি মিলন
তুমি সুখে থাকো – ভণ্ড প্রেমিক
ছোট্ট একটি কাগজে – ফাঁসি
যদি প্রেমের আরেক নাম – বডিগার্ড
বন্ধু প্রেম দে – বেনাম বাদশা
একটি কথাই বলি বারেবার – স্নেহের প্রতিদান
ওরে ছোটভাই – বন্ধন
এই মাটি আমার – মা মাটি দেশ
আমরা দুজন চিরসাথী – ভাংচুর
তাঁর ছেলে জয় অভিনয় করেছিল ‘সহধর্মিণী’ ছবিতে। ছবিতে জিনাতের সাথে প্রথমবার বিয়ে হয় কাঞ্চনের এবং তাদের ছেলে থাকে। জিনাতের কোলের বাচ্চাটি ছিল জয়।
পরিচালক হয়ে দুটি ছবি পরিচালনা করেছে কাঞ্চন – বাবা আমার বাবা, মায়ের স্বপ্ন।
অনেক পুরস্কার অর্জন করেছে কাঞ্চন। তার মধ্যে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার – পরিণীতা (১৯৮৬), শাস্তি (২০০৫)। অন্যান্য পুরস্কার – একুশে পদক (২০১৮), বাচসাস পুরস্কার, জিয়া গোল্ড পুরস্কার, শেরে বাংলা স্মৃতি পদক, চলচ্চিত্র দর্শক পুরস্কার, বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ এসোসিয়েশন পুরস্কার, ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নগর পুরস্কার, ভয়েস অফ আমেরিকা পুরস্কার, বাংলাদেশ কালচারাল মুভমেন্ট পুরস্কার, ঢাকা যুব ফাউন্ডেশন পুরস্কার।
২০১৮ সালে ঢালিউডে কাঞ্চন তাঁর ৪০ বছর পূর্তি উৎসব পালন করেছে। উৎসবে উল্লেখযোগ্য পরিচালক ও চলচ্চিত্র শিল্পীরা তাঁদের মতামত দিয়েছে কাঞ্চনকে নিয়ে।
টেলিভিশন প্রোডাকশনেও কাঞ্চন কাজ করেছে। তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটক/টেলিফিল্ম – ঠাণ্ডার কান্ড, অবাণ্ছিত, চারুলতা, লাল গোলাপ, অথচ, তুচ্ছ, নায়ক, নাকফুল, জুয়া, ক্রাইম রোড, সোনালি দিন, আয়না। এর মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে নির্মিত ‘নাকফুল’ টেলিফিল্মটি খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। পাশাপাশি টেলিভিশনে কিছু অনুষ্ঠান উপস্থাপনাও করেছে কাঞ্চন।
চলচ্চিত্র তারকা ইলিয়াস কাঞ্চনের আরেকটি সেরা পরিচয় ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে। তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী জাহানারা কাঞ্চনের সড়ক দুর্ঘটনায় অকালমৃত্যুর পরে এই সামাজিক আন্দোলন শুরু করে কাঞ্চন। কাঞ্চন তখন চলচ্চিত্র ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। পরিচালক, শুভাকাঙ্ক্ষীরা তাঁকে বোঝাতে থাকেন দর্শকের জন্য তাঁকে কাজ করে যেতে হবে কারণ তারা তাঁকে ভালোবাসে পাশাপাশি দেশের অনেক মানুষের জন্য সচেতনতা তৈরি করতে হবে যাতে সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধ হয়। সেই চেতনা থেকেই শুরু তাঁর আন্দোলনের, আজও চলছে, চলবে। আন্দোলন শুরু হয় তাঁর মাধ্যমে ১৯৯৩ সালে। কাঞ্চন এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। অনলাইনে ‘নিরাপদ নিউজ’ নামে তাঁর নিজস্ব ওয়েবসাইটও রয়েছে। সমাজসেবার অংশ হিসেবে তাঁর হাতে আরো প্রতিষ্ঠা হয়েছে ‘জাহানারা স্মৃতি হাই স্কুল, চাঁদপাড়া স্কুল ও কলেজ, জানে জাহান মাদ্রাসা, এসএসসি ট্রেনিং ইন্সটিটিউট।’
এতসব মিলিয়ে একটা সমৃদ্ধ ব্যক্তিত্ব ইলিয়াস কাঞ্চন। তাঁর স্টারডম চলচ্চিত্র, টেলিভিশন ও সামাজিক আন্দোলনের উপর ভিত্তি করে একটা জাতীয় অবদানের সাথে সংশ্লিষ্ট। ব্যক্তি ও কর্মে ইলিয়াস কাঞ্চন একজন বিগেস্ট সুপারস্টার।
বি. দ্র . লেখাটি তৈরি করতে ব্যক্তিগত বিশ্লেষণ বাদে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য নেয়া হয়েছে বুশরা চৌধুরী-র উপস্থাপনায় বিটিভি-র চলচ্চিত্র বিষয়ক অনুষ্ঠান ‘ছায়াগল্প’ অনুষ্ঠান থেকে।