শেকড়ে টেনে নেয় স্বপ্নডানায়
সবসময় ইট-কাঠের খাঁচায় থাকতে থাকতে মনটা কেমন হাঁপিয়ে ওঠে। মনে হয় যদি সেই গ্রামটাকে আবার একটু ফিরে পেতাম হয়তো বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারতাম। হয়তো কৃত্রিম এই সবকিছু ছেড়ে মাটির সোঁদা গন্ধে নিখাঁদ জীবনযাত্রায় শামিল হতে পারতাম। চাইলেইতো আর সব কিছু পাওয়া যায়না তবে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে মানা নেই। সেই চিরচেনা প্রশান্তিময় গ্রামীণ জীবনের ছোঁয়া পেতে ফের দেখলাম “স্বপ্নডানায় (On The Wings Of Dream)”।
সপ্তাহান্তে বসা হাটে ক্যানভাস করে মলম বিক্রি করা ফজলু (মাহমুদুজ্জামান বাবু) ও তার ছেলে রতন হাট শেষে পুরোনো কাপড়ের দোকান থেকে একটা প্যান্ট কেনে। ফজলুর বউ (রোকেয়া প্রাচী) সেই প্যান্ট ধুতে গিয়ে পকেটে কিছু বিদেশী টাকার নোট পায়। এই টাকাগুলো ভাঙানোর জন্য ফজলু আর তার দোস্ত সিরাজ মেম্বার (ফজলুর রহমান বাবু) নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। টাকাগুলোকে ঘিরে জেগে ওঠা স্বপ্ন আর জীবনে বাস্তবের রূঢ়তার অসাধারণ চিত্রায়ণ এই “স্বপ্নডানায়“।
সদ্য ক্ষেত থেকে কেটে আনা ধানের আঁটির গন্ধ, খড়ের উচুঁ পালা, গরুর গাড়ির ক্যাঁচকোচ শব্দ, বাঁশঝাড়ে বাতাসের ফিসফাস, ডাংগুলি খেলা শেষে ডানপিটে ছেলেদের ডুঁবসাতারে হইচইময় তালগাছঘেরা ঘোলা পানির পুকুর, হ্যারিকেনের আধো আলোয় আলকাতরালেপা কাঠের স্লেটে চক দিয়ে বর্ণ পরিচয়, হাঁসের বিশাল ঝাঁক , খালি পায়ে স্কুলে যাওয়া কিশোর কিশোরির দল , মাঝে মাঝে গজিয়ে ওঠা ছনগাছের ঝোপ ও ঘন সবুজ গাছে আর ঘাসে দুইপাশ ছাওয়া নরম ধুলোর মেঠোপথ, মাটির ঘরের দেয়ালে রান্নার লাকড়ির জন্য গোবর শুকানো, লাল কাঁচের চুড়ি পেয়ে গ্রাম্য ললনার খুশিতে ঝিকমিক করে ওঠা চোখ, ফসল কেটে নেয়া সদ্য ন্যাড়া বিস্তৃত জমি, চেনা অনেক পাখির কিচিরমিচির শব্দ, এই অতিপরিচিত হৃদয়মথিত আবেগগুলো কোথায় যেন লুকিয়ে থাকে কিন্তু প্রাণের গভীরে থেকে যাওয়া সজীব বিষয়গুলি “স্বপ্নডানায়” ভেসে হঠাৎই মন তোলপাড় করে তোলে।
সিনেমার কাস্ট সবার কাছেই ভালো লাগবে। রোকেয়া প্রাচী আমাদের দেশের যে কয়জন অভিনেত্রী আছেন যাদের পারফর্মেন্স অভিনয় নয় বরং বাস্তব মনে হয় তাদের অন্যতম একজন। ফজলুর রহমান বাবু মানুষটাকে আমার পানির মতো মনে হয় মানে উনাকে যে পাত্রে (চরিত্রে) রাখা হবে উনি সেই ভাবেই নিজেকে উপস্থাপন করতে পারবেন। ‘আমি বাংলায় গান গাই’ গানটি দিয়ে সবার কাছেই পরিচিত হওয়া মাহমুদুজ্জ্জামান বাবুও যে ভাল অভিনয় জানেন তা সিনেমাটা দেখেই বোঝা যায়।
হলিউডি মুভিতে হ্যান্স যিমার, অ্যালান সিলভেস্ত্রি, জন পাওয়েল এমন আরো অনেক মিউজিশিয়ানের দামী সব ইন্সট্রুমেন্ট এ করা মিউজিক শুনে মনে দোলা লাগতে পারে তবে দোতারা – বাঁশির সুরের চেয়ে এত আপন আর বোধহয় কিছু লাগেনা যা এই সিনেমায় রয়েছে।
২০০৭ এর শিকাগো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে নতুন পরিচালক ক্যাটাগরীতে গোল্ড হুগো নমিনেশন, ভারতে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে জুরি অ্যাওয়ার্ড, সাংহাই আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ পরিচালক পুরষ্কার পায় “স্বপ্নডানায়”।
ইমপ্রেস টেলিফিল্ম এর ব্যানারে ২০০৭ সালে মুক্তি প্রাপ্ত গোলাম রব্বানী বিপ্লব পরিচালিত “স্বপ্নডানায়” সিনেমাটির গল্প লিখেছেন আনিসুল হক। মিউজিক করেছেন বাপ্পা মজুমদার। ৮৪ মিনিট এর এই সিনেমাযে আমাদের শেকড় গ্রামে সবাইকে হঠাৎ টেনে নিয়ে যাবে এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।