Select Page

স্বাধীন বাংলাদেশে ‘ববিতা’ এক উজ্জ্বল অধ্যায়

স্বাধীন বাংলাদেশে ‘ববিতা’ এক উজ্জ্বল অধ্যায়

স্বাধীন বাংলাদেশে ‘ববিতা’ নাম যেন একটি উজ্জ্বলতম অধ্যায়। সত্তরের দশকে একের পর এক কালজয়ী সিনেমায় অভিনয় করে হয়ে উঠেন অন্যতম জনপ্রিয় ও আস্থাভাজন নায়িকা

ষাটের দশকের শেষ ভাগ, কিংবদন্তি জহির রায়হান প্রযোজিত ‘সংসার’ ছবির মাধ্যমে আবির্ভাব ঘটে এক কিশোরীর; পরবর্তীতে সেই কিশোরী অভিনয়, সৌন্দর্যতা, স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য থেকে আর্ন্তজাতিক পরিচিতি সর্ব গুণান্বিতে হয়ে উঠেন এক অনন্যা।

গানের খাতায় স্বরলিপি লিখে যিনি হয়ে যান তরুণদের স্বপ্ননায়িকা, তরুণীদের আইকন। কখনো গ্রামের দস্যি মেয়ে, কখনো শহরের আধুনিকা কিংবা উপন্যাসের চরিত্র, বীরাঙ্গনা হয়ে অনবদ্য অভিনয়ে দর্শকদের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন। একের পর এক পুরস্কার জয়ে খ্যাত হন ‘পুরস্কার কন্যা’ হয়ে,যার স্থান বাংলা চলচ্চিত্রের নায়িকাদের মধ্যে প্রথম সারিতে, তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম সেরা জনপ্রিয় নায়িকা ‘ববিতা’।

আসল নাম ফরিদা আক্তার পপি। নায়িকা হিসেবে প্রথম ছবি ‘শেষ পর্যন্ত’। আগের ছবিতে যার মেয়ে হয়েছিলেন,এই ছবিতে তিনিই নায়ক। তখনকার সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়ক রাজ্জাকের বিপরীতে অভিষেক ঘটে সেলুলয়েডের পর্দায় নাম হয় ববিতা। সেই থেকে যাত্রা, যেটা চলেছিল নিরবধি। এই জুটির জনপ্রিয় সিনেমা ‘টাকা আনা পাই’তে আহ্লাদী মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করে বেশ নজর কাড়েন, এরপর ‘স্বরলিপি’ ছবির জনপ্রিয়তা তাকে শক্ত ভিত করে চলচ্চিত্রের আঙ্গিনায়।

স্বাধীন বাংলাদেশে ‘ববিতা’ নাম যেন একটি উজ্জ্বলতম অধ্যায়। সত্তরের দশকে একের পর এক কালজয়ী সিনেমায় অভিনয় করে হয়ে উঠেন অন্যতম জনপ্রিয় ও আস্থাভাজন নায়িকা। সৌন্দর্যে যেমন হয়ে উঠেন স্বপ্নকন্যা, তেমন অভিনয়ে। একেক ছবিতে তিনি হাজির হতে থাকেন ভিন্নরূপে, প্রত্যেক ছবিতে যেন ভিন্ন সত্তার ববিতা। এটাই তো অভিনয়ের আসল গুণ। মুক্তিযুদ্ধের ছবি ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’র বীরাঙ্গনা থেকে ‘পিচ ঢালা পথ’-এর আধুনিকা মেয়ে সব চরিত্রেই নিজেকে ছাড়িয়ে গেছেন।

শুধুমাত্র সত্তরের দশকেই তিনি যেসব ছবিতে অভিনয় করেছেন,তাতেই তিনি নিঃসন্দেহে অন্যান্য নায়িকাদের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠবেন। এই দশকেই রয়েছে আবার তোরা মানুষ হ, আলোর মিছিল, লাঠিয়াল, বাঁদী থেকে বেগম, সূর্যগ্রহণ, নয়ন মনি, অনন্ত প্রেম, বসুন্ধরা, ডুমুরের ফুল, গোলাপী এখন ট্রেনে, সুন্দরী,কসাই, এখনই সময়ের মতো কালজয়ী ছবি। এই দশকের আরো কিছু জনপ্রিয় ছবি রয়েছে তাঁর বর্ণিল ক্যারিয়ারে এর মধ্যে অন্যতম এক মুঠো ভাত, কী যে করি, সোহাগ, ফকির মজনু শাহ, বন্দিনী, জিঞ্জির। সেই সময়ের তরুণীরা ফ্যাশন সচেতনতায় ববিতাকে অনুসরণ করতেন। ভারতীয় উপমহাদেশের কিংবদন্তী চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘অশনী সংকেত’ ছবিতে অভিনয় করে আর্ন্তজাতিক অঙ্গনেও নিজেকে সমৃদ্ধ করেন।

এরপর আশির দশক, বাণিজ্যিক ছবির নায়িকা হিসেবে নিজেকে করেছেন পরিক্ষীত। এই দশকে যেমন অভিনয় করেছেন দূরদেশ, মিস লংকা, প্রেমিক, অর্পণ, অবুঝ হৃদয়, নাগপূর্নিমার মতো জনপ্রিয় বাণিজ্যিক ছবিতে, তেমন কাজ করেছেন জন্ম থেকে জ্বলছি, দহন, রামের সুমতি, বিরাজ বউয়ের মতো সাহিত্য ও ভিন্নধারার ছবিতে। তবে ভক্তরা উনার প্রতি একটু হতাশই ছিলেন, নিজের ক্যারিয়ারের চিন্তা করে বহু ছবিতে কাজ করে যান, অভিযোগ উঠেছিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না সেই সত্তর দশকের ববিতাকে। তবে বাণিজ্যিক দিক দিয়ে বেশ সফলই ছিলেন।

দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে নায়িকা হিসেবে সফল হবার পর নব্বই দশকে দর্শকদের সামনে আসেন চরিত্রাভিনেত্রী হয়ে। সেই থেকে অভিনয় করছেন পদ্মা মেঘনা যমুনা, গোলাপী এখন ঢাকায়, মায়ের অধিকার, জীবন সংসার, প্রাণের চেয়ে প্রিয়, রাগী, ধর থেকে হাছন রাজা, চার সতীনের ঘর, কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি, অবুঝ বউ, খোদার পরে মা, পুত্র এখন পয়সাওয়ালা পর্যন্ত। তবে নায়িকা হিসেবে তিনি যতটা সফল হয়েছিলেন, চরিত্রাভিনেত্রী হয়ে অতটা মুগ্ধতা ছড়াননি। অভিনয়ের বাইরেও চলচ্চিত্র প্রযোজনা করেন; এর মধ্যে অন্যতম লেডি স্মাগলার, পোকামাকড়ের ঘর বসতি।

বাংলা চলচ্চিত্রে ববিতা অভিনীত জনপ্রিয় গানের সংখ্যা বিশাল। গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে, ফুলের কানে ভ্রমর এসে, এই পৃথিবীর পড়ে, থেকে চুপি চুপি বলো কেউ, আমি আছি থাকবো, তুমি আমার জীবনসহ বহু জনপ্রিয় গান রয়েছে তাঁর এই ক্যারিয়ারে। নায়ক জাফর ইকবাল তাকে অবুঝ হৃদয় দিয়ে ভালোবেসে গেয়েছিলেন ‘সুখে থেকো ও আমার নন্দিনী’, মিঞা ভাই ফারুকের কাছে তিনি নয়নের মনি, নায়ক রাজ রাজ্জাক তাঁর রুপে মুগ্ধ হয়ে  ‘ও চোখে চোখ পড়েছে যখনি’ গান গেয়ে ঠোঁটে অনন্ত প্রেমের চিহ্ন এঁকে দেন। পাকিস্তানি নায়ক ফয়সাল  গেয়ে উঠেন ‘চুরি করেছো আমার মনটা,হায়রে হায় মিস লংকা’।

বর্ণিল ক্যারিয়ারে একবার হ্যাটট্টিকসহ মোট সাতবার জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেন, জাতীয় পুরস্কারের ইতিহাসে তিনিই প্রথম হ্যাটট্টিককৃত অভিনয়শিল্পী। এ ছাড়া বাচসাস পুরস্কার সহ ভারতেও একাধিক পুরস্কার অর্জন করেন। পুরস্কার জয়ে ধারাবাহিকতা রাখার জন্য খেতাব পান পুরস্কার কন্যার। সম্প্রতি পেয়েছেন আজীবন সম্মাননা।

ব্যক্তিজীবনে ১৯৮২ সালে বিয়ে করেন, এর কয়েক বছর পরেই স্বামীর অকালপ্রয়াণ ঘটে, সংসারে রয়েছে একটি পুত্র সন্তান। আরেক অকালপ্রয়াত চিরসবুজ নায়ক জাফর ইকবাল তাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু রাজি হননি। বাংলা চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় দুই নায়িকা সুচন্দা, চম্পার আপন বোন তিনি, জনপ্রিয় চিত্রনায়ক রিয়াজ ও সম্পর্কে ভাই হন। ব্যক্তিজীবনে অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে তিনি আজ সফল, ভবিষ্যৎ জীবনেও তাঁর হাসি মলিন থাকুক, চলচ্চিত্র জগতে তিনি এখন অনিয়মিত,ফিরে এসে নিজেকে আরো নন্দিত করবেন এটাই প্রত্যাশা।

১৯৫৫ সালের আজকের এইদিনে যশোরে জন্মগ্রহণ করা বাংলা চলচ্চিত্রে আমার সবচেয়ে প্রিয় অভিনেত্রী।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

চলচ্চিত্র ও নাটক বিষয়ক লেখক

মন্তব্য করুন