Select Page

স্মার্ট চলচ্চিত্র হয়ে-ওঠার সকল উপকরণই মজুত রেখেছিল ‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’

স্মার্ট চলচ্চিত্র হয়ে-ওঠার সকল উপকরণই মজুত রেখেছিল ‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’

‘শনিবারের বিকেল’ ছবিটা নিয়ে সরকার তরফে বেহুদা কচলাকচলির কারণে ‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’ নিয়ে অপেক্ষাটার গুরুত্ব একদম স্বতন্ত্র মাত্রা ধারণ করেছিল। সেই অর্থে এটার জন্য আসলে মোচড়ামুচড়িজনিত অপেক্ষা করাই লাগেনি। মুক্তিও পেয়েছে চরকিতে, ফলে ‘শনিবারের বিকেল’ ছবিটার মতো চোরাই পথে দেখা লাগেনি আমার। জাস্ট চরকিতে কিছু বিকাশ টাকা ভরেই দেখা গেছে। আকিরা কুরোসাওয়ার বইয়ের নাম নিয়ে কাউকে কাউকে ভুগতে দেখেছি। এটা নিছক নাম-অধিগ্রহণ মাত্র। দুশ্চিন্তার কিছু নেই!

ছবির শব্দ-নকশা/সাউন্ড ডিজাইন সুন্দর। ভিজুয়াল ডিজাইনও অতি চমৎকার। একটা নিয়ন্ত্রিত গতিতে ছবিটা বিকশিত হতে থাকে। গল্প বলার এই গতিতে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ক্রমাগত দক্ষ ও অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। মনে হয় না এর জন্য আলাদা করে আর তাঁর বিশেষ সতর্ক থাকা লাগে। কাস্টিংয়ে আলাদা করে আগাম-ভাবনা দেবার দরকারই পড়েনি। অবভিয়াস চয়েস তিশা ছাড়াও ফারুকী নিজে যে অভিনয় করছেন তা দর্শকেরা আগে থেকেই জানতেন। ডিপজলকে পরিচালক অভিনয়ে নিয়েছেন এই তথ্যও পরিচালক সাড়ম্বরে সাইবার জগতে জানিয়েছিলেন। আর জনা দুয়েক বাদে কারও তেমন কোনো কাজ ছিলও না।

মধ্যবিত্ত দম্পতিদের জন্য প্রায়শই একটা সেন্টিমেন্টাল বিষয়বস্তুকে আশ্রয় করে এই ছায়াছবি। ব্যস্ত ও জননন্দিত দম্পতির প্রথম বাচ্চা নেবার পরিকল্পনাকে ঘিরে এই ছবি। এই যাত্রাপথের উত্থান-পতন ও আচমকা বিপদে পড়ে-যাওয়া, নিগ্রহ ইত্যাদির উপর দাঁড়ানো এই ছবিটা নানানভাবে নানান দর্শককে সংমিশ্রণ/এনগেইজ করেন। আন্দাজ করা যায়, পিতামাতা হতে-থাকা, সম্প্রতি হয়ে-পড়া, হবার পথে চেষ্টারত দম্পতিরা আরও আরও সাবজেক্টিভ ও আবেগপ্রবণভাবেই এই ছবির সাথে যুক্ত হতে পারবেন।

অভিনেতা ফারুকী দর্শকদের জন্য নতুন; সম্ভবত ওঁর নির্দেশনায় কাজ-করা অভিনেতাদের জন্য নতুন নন। পর্দার বাইরের চালচলন/ম্যানারিজম ফারুকীর বিশেষ বদলাতে হয়নি। বাস্তবে এটা ‘সামথিং লাইক হিম’ই হবার ছিল। বাস্তবের তুলনায় তাঁর গলফ টুপিটি ছায়াছবিতে কম পরেছেন। ধরে নেয়া যায়, তাঁর নতুনপ্রাপ্ত চুলগুলো এই ছবির উপলক্ষেই মাথায় এসেছে। অন্য অনেকের তুলনায় তিনি খোলাবাজার থেকে চুল গ্রহণে সংযম দেখিয়েছেন সেটাও সত্য। অনেকেই পয়সা খরচ করে চুল লাগানোর সময় উৎসাহের চোটে কপালের অর্ধেক পর্যন্ত খেয়ে দেন। তিনি তা করেননি। হয়তো কয়েকটা পাকা চুল তাঁর দাঁড়িগোঁফের সাথে অধিক মানানসই হতো।

ফারহান/ফারুকীর অভিনয় মোটের উপর ভাল। শূন্য দৃষ্টি, বিহ্বলতা, ব্যাকুলতা ইত্যাদি মুহূর্তে আমার তাঁকে অনবদ্যই লেগেছে। ডিপজলের অভিনয় কী হবে তার বিষয়ে ডিপজল গত ৩ দশকে দর্শকদের স্পষ্ট বুঝিয়ে রেখেছেন। বস্তুত এই ছবি দেখার আগে আমি সবচেয়ে আগ্রহী ছিলাম ডিপজলকে দেখতে। তিথি/তিশা বরাবরের মতোই। তিশার মতোই। আর এই ছবিতে তাঁর আসলে তিশা থাকতে কোনো অসুবিধাই হয়নি – হাইপিচ, মনোটোনাস, খুনসুটি মুডের অভিনয়। এটা ‘সামথিং লাইক হার’ হবারই কাজ। তিথির সংস্কারপন্থী ও বদমেজাজী মা হিসাবে ডলি জহুর চমৎকার। হতে পারে এই ছবির সবচাইতে বিশ্বাসযোগ্য চরিত্র তিনি। তিথির বিপদে বন্ধু হিসাবে আবির্ভূত পুরান ‘মিত্র’ মন্ত্রীপুত্রের চরিত্রে ইরেশ যাকের ভাল। অল্পকাল অংশগ্রহণ তাঁর। কিন্তু দ্বিধা, মহত্ত্ব, গুণ্ডা শিল্পপতির চাপে থাকা নেগোশিয়েটর হিসাবে তিনি গোছানো অভিনয় করেছেন। ডিপজলের পুত্রের চরিত্রটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সকল অর্থেই। ক্রোধজনিত উত্তেজনা সৃষ্টি করার কারিগর হিসাবে, আবার গল্পের মোড় ঘুরিয়ে দেবার কারক হিসাবে। এই চরিত্রে যিনি করেছেন (শরাফ হোসেন জীবন কি?) তাঁকে এই কাজটিতে অনেক উত্তেজিত দেখিয়েছে। তাঁর লাউডনেস, অস্থিরতা আসলে ক্রূরতা প্রকাশের থেকে কমিক্যাল লেগেছে বেশি।

ডিপজলপুত্রের এই চরিত্রটির এই বিপথে গমনের ক্ষেত্রে অবশ্য পরিচালকের কিছু দায় থাকছে বোধহয়। শিল্পপতির বাড়িতে বিবাহজনিত আতশবাজির কারণে সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর কষ্ট বিবেচনা করে ব্যাকুল স্বামী চ্যালেঞ্জ করতে যান। সেখানে ছাদে যে উৎসবমুখরতা দেখানো হচ্ছে, নাচগান হৈহুল্লোড় ইত্যাদি, সেটার নির্মাণ এত কাঁচা যে সেখানকার মুখ্যমানব হিসাবে পুত্রটির চরিত্র কমিক্যাল হয়ে যাবার কারণ এটাই হতে পারে। বাস্তবে ডিপজল পরিচালনা করেন বা প্রযোজনা করেন এমন যে কোনো ছবির ‘বড়লোকের ছাদপার্টি’ এর থেকে পাকাপোক্ত হয়ে থাকে। এই চরিত্রটি নিজের প্রতি যাই করুন, আমার মনে হয় না দর্শকের প্রতি সুবিচার করেছেন।

ছবিটা মৃদু বেদনার আভাসময়, উৎকণ্ঠা ও নিগৃহীত হবার ভোঁতা অনুভূতি বহন করার একটা স্মার্ট চলচ্চিত্র হয়ে-ওঠার সকল উপকরণই মজুত রেখেছিল। আমার বিবেচনায় সামান্য কিছু জিনিস বাদ আর কিছু জিনিস সংযোজন দরকার ছিল। শুরুতেই বেলুনের দৃশ্যটার প্রতি পরিচালকের মায়া থাকতে পারে। দর্শকের তৈরি হওয়া কঠিন। বিশেষত বাচিক অভিনয়ের হাল বিবেচনা করলে। ডিপজলের ছাদটা নির্মাতা দেখেছেন ঠিক আছে, আমাদের ওখানকার ‘উৎসব’ না-দেখানোই স্মার্ট হতো। ডিপজলের ছেলেটাকে একজন কম তাফালিংয়ের মাজাওয়ালা শীতল ক্রূর দেখা গল্পের দাবি ছিল। আর শূন্য দৃষ্টির ফারহানকে আমাদের আরেকটু সময় নিয়ে দেখালে ভাল হতো। আমাদের হৃদয়ে বাবা হবার প্রাক্কালে তাঁর নিগ্রহটির মজবুত বনিয়াদের জন্য পাশের স্ত্রী ও তিনি — আরও খানিকটা নৈঃশব্দ্য, আরও খানিকটা জড়তা, অন্তর্গত অভিনয় সংযোজন হয়তো দারুণ হতো।

১৩ ডিসেম্বর ২০২৩। আদাবর, সকাল ১১:৪০


About The Author

মানস চৌধুরী

লেখক, শিক্ষক ও নৃবিজ্ঞানী

Leave a reply