Select Page

হতে পারতো সময়োপযোগী সুনির্মিত ছবি, কিন্তু…

হতে পারতো সময়োপযোগী সুনির্মিত ছবি, কিন্তু…

মনের মতো মানুষ পাইলাম না
ধরন: সোশ্যাল ড্রামা
গল্প ও পরিচালনা: জাকির হোসেন রাজু
প্রযোজনা: দেশ বাংলা মাল্টিমিডিয়া
অভিনয়: শাকিব খান (স্বাধীন), শবনম বুবলি (অর্পিতা), মিশা সওদাগর (সৈয়দ এহসান), ডন (এহসানের ভাই), জাহিদ ইসলাম (এহসানের ভাই), মাসুম বাশার (স্বাধীনের বাবা), সাবেরী আলম (স্বাধীনের মা), সাদেক বাচ্চু (চাচা), ববি (বাড়িওয়ালা), মারুফ খান (স্বাধীনের বন্ধু), আমিন সরকার, নাদের খান, তনামী হক প্রমুখ।
মুক্তি: ১২ আগস্ট, ২০১৯

নামকরণ: প্রি প্রডাকশনের কাজ শেষ করে যখন ছবির নাম ঘোষণা করা হয় তখন থেকেই দর্শক মনে এমন ব্যাকডেটেড নামকরণ নিয়ে বিরূপ ধারণা ছিল। পাশাপাশি নামের দৈর্ঘ্য নিয়েও কিছুটা হতাশা লক্ষ্য করা গেছে। যদিও জাকির হোসেন রাজু অতীতেও এরকম বড় নাম তার ছবিতে ব্যবহার করেছেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ‘ভালোবাসলেই ঘর বাধা যায় না’ কিংবা ‘এর বেশি ভালোবাসা যায় না’। এই তো গেলো পাঁচ শব্দের টাইটেল, যদি তার ক্যারিয়ারে চার অক্ষরের টাইটেলসহ ছবির নাম খুঁজি তবে সেটা ছোটখাটো একটা লিস্ট পাবো। সুতরাং, রাজুর সিনেমায় নামের আকার তেমন কোনো ফ্যাক্ট না।

অতীতে এমন নাম অধিকাংশ ক্ষেত্রে দর্শক গ্রহণ করেছে। ফ্যাক্ট হলো গল্পের সাথে নামটি কতটুকু যায়। হতাশার বিষয়, পুরো সিনেমাটি দেখার পর আমি এরকম গল্প বা থিমের সাথে ‘মনের মতো মানুষ পাইলাম না’ নামের তেমন কোনো মিল পেলাম না। সিনেমার কিছু সাবপ্লটকে যদি মেইনপ্লট হিসেবে বিবেচনা করি তবে হয়তো এই নামের সার্থকতা খুজেঁ পাওয়া যাবে, কিন্তু সেভাবে তো সিনেমাটিকে উপস্থাপন করা হয়নি… তাই নামকরণ যথার্থতা তুলে ধরতে পারে না।

কাহিনী, চিত্রনাট্য ও সংলাপ: এ তিনটি দায়িত্বই সামলিয়েছেন পরিচালক রাজু। টাইটেল গানটিও লিখেছেন! তিনি একজন জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত চিত্রনাট্যকার এবং সংলাপ রচয়িতা, সুতরাং দায়িত্ব যখন তার ঘাড়ে, তখন মানসম্পন্ন কাজ আশা করা-ই যায়।

তবে কঠিন বাস্তবতা হলো, ভালো মৌলিক গল্প বাছাই করতে পারলেও, জাকির হোসেন রাজুর চিত্রনাট্য সাজানোর পারদর্শিতা দিন দিন নিম্নমুখী হচ্ছে, এ সিনেমা তার গতিকে আরো ত্বরান্বিত করলো।

গল্প যে ভালো ছিল এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। ধর্ষণের মতো সমসাময়িক একটি সামাজিক সমস্যাকে তুলে ধরছে এ ছবি। কিন্তু গণ্ডগোল টা ঘটেছে একে উপস্থাপন করতে গিয়ে। এ রকম একটি কনসেপ্টকে চাইলে শৈল্পিকভাবে বক্তব্য সহকারে উপস্থাপন করা যায়, আবার চাইলে কমার্শিয়াল ট্রিটমেন্ট দিয়ে আকর্ষণৗয় উপাদান রেখেও উপস্থাপন করা যায়। কিন্তু যখন এই দুইটিকে একইসাথে উপস্থাপন করতে যাওয়া হয়, তখন এটা বেশ বিপদজনক হয়ে দাঁড়ায় একটা ভালো গল্প নষ্ট হওয়ার জন্য।

জাকির হোসেন রাজু এভাবে একইসাথে দুইভাবে উপস্থাপন করতে গিয়ে গল্পটিকে বিনষ্ট করেছেন, বিপদকে পাশ কাটিয়ে আসতে পারেননি। যার দরুণ ছবির প্রথমার্ধ একঘেয়ে ও বিরক্তিকর, মূল গল্পে ঢুকতে ঢুকতে সিনেমার ত্রিশ মিনিট পার হয়ে যায়।

দ্বিতীয়ার্ধে থাকা টুইস্ট গল্পটিকে কিছুটা জমাট করেছে, কিন্তু কোর্টরুম ড্রামা ভালো না জমায় শেষের দিকে এসে গল্প একদম সমতল হয়ে গিয়েছে। এ ক্ষেত্রে দোষ পড়বে চরিত্র লেখনীর ওপর, যেখানে নেতিবাচক চরিত্রগুলোকে অনেক দূর্বল দেখানো হয়েছে।

সিনেমার সংলাপ সমসাময়িক কিন্তু গতানুগতিক। হল থেকে বের হলে আপনার তেমন কোনো সংলাপ মনে থাকবে না যেটা আপনি ট্রেইলারে পাননি কিন্তু মনে দাগ কেটেছে।

এ অংশ পাবে ১০০ তে ৪০।

অভিনয় ও পরিচালনা: রাজু-শাকিব জুটি এই নিয়ে সপ্তমবারের মতো একত্রে কাজ করলেন। এর আগে তারা বেশ কয়টি নন্দিত ও ব্যবসাসফল ছবি উপহার দিয়েছেন। ছবিতে দীর্ঘসময় পর শাকিব খানকে আন্ডারটোনে অভিনয় করতে দেখলাম। স্বাধীন চরিত্রে তেমন কোনো হিরোইজম নেই, স্বাভাবিক একজন মানুষ। যে বিদেশ থেকে ব্যারিস্টারি পড়ে দেশে ফিরে আসে, পরবর্তীতে দেশের করুণ অবস্থা দেখে মানসিকভাবে হতাশ হয়ে পড়ে। শাকিব এ চরিত্রে কোনোমতে মানিয়ে গেছে। কোনোমতে বলছি, কারণ ইদানিং তার শারীরিক গড়নে একটা বয়সের ছাপ পড়ছে; আর যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে তাতে যতটুকু বুঝলাম, স্বাধীন চরিত্রটি ৩০ বছর বয়সী তরুণের। ব্যারিস্টার স্বাধীন যখন কোর্টের কাজ সামলায় কিংবা ক্ষীপ্ত শাকিব যখন প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে তখন তার অ্যাটিচিউট যতটা মানানসই লাগে, রোম্যান্টিক স্বাধীনকে ততটা মানানসই লাগে না।

এর ওপর সেই একঘেয়ে জুটি শবনম বুবলির সাথে। সংখ্যার বিচারে এখনো এই জুটির ছবি ১০ এর কোটা পার হয়নি, কিন্তু এখনই দর্শকঘৃণার তালিকায় চলে আসে। অথচ অতীতে শাবানা-আলমগীর, রাজ্জাক-কবরী জুটিগুলো শ’খানেক কাজ করে দিয়ে গেছে, এরকম অভিযোগ তখন শোনা যেতো না। এই বিষয় এটা আঙুল দিয়ে দেখায়, জুটি সবসময় দর্শক তৈরী করে দেয়, আপনাআপনি হয় না।

বুবলির রূপ দেওয়া অর্পিতা চরিত্রটি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, ক্ষেত্রবিশেষে স্বাধীন চরিত্রের থেকে গুরুত্ব বেশি। বুবলি সন্তোষজনক অভিনয় করেছেন। প্রেমিক-প্রেমিকার রোম্যান্সে বুবলি যতটা জড়োসড়ো, ইমোশনাল সিক্যুয়েন্সে এর থেকে বেটার।

সিনেমার অন্যতম বড় দূর্বল দিক হলো নেতিবাচক চরিত্রগুলো। মিশা সওদাগর, ডন ও জাহিদ ইসলাম; তিনজনকেই গতানুগতিক ধারায় রাখা হয়েছে। অথচ এই চরিত্রগুলোতে যত সম্ভাবনা ছিল তাতে এদের নিয়ে গল্প আরো জমানো যেতো, ভিলেন যখন শক্তিশালী হয় তখনই তো সিনেমা জমে!

মাসুম বাশার, সাবেরী আলম ও সাদেক বাচ্চুর গুরুত্ব তেমন একটা নেই, তবে তারা ভালো অভিনয় করেছেন। প্রথমার্ধে বাড়ির ভেতরে একটি ভালো ড্রামা সিন আছে, তারা অভিনয়ে দূর্বলতা দেখালে সেই সিন পানসে হয়ে যেতো। এছাড়া অন্যান্য ছোট ছোট চরিত্রে যারা ছিলেন, মোটামুটি চলনসই কাজ করেছেন।

এ অংশ পাবে ১০০ তে ৬৫।

কথা বলা যাক পরিচালনা নিয়ে। ৫৫ বছর বয়সী এই পরিচালক নব্বই দশক থেকে এখন অব্দি কাজ করে চলেছেন; মাঝে অশ্লীলতার জোয়ারে তার সমসাময়িক প্রায় সব পরিচালক গা ভাসিয়ে দিলেও তিনি বিরতি নেন, পরে সে যুগের অবসান ঘটলে আবার নির্মাণে নিয়মিত হন। তাই তিনি ‘নব্বইয়ের পরিচ্ছন্ন নির্মাতা’ হিসেবে বেশ সমাদৃত।

রাজু রোম্যান্টিক ড্রামা জনরার জন্য বেশ খ্যাতিমান হলেও এছবিতে আমি সেই ম্যাজিকটা পাইনি। সবশেষ ‘নিয়তি’তে তার পরিচালনা ভালো লেগেছিল, এরপরের দুই ছবিতে তার নির্মাণের গুণাগুণ আস্তে আস্তে নিম্নমুখী হলো। আর এবারও তিনি সেই নিচের দিকে চলে গেলেন। শাকিব খান, শবনম বুবলির কাছ অভিনয়টা বের করে আনতে পেরেছেন ঠিকই; কিন্তু সব মিলিয়ে চিন্তাভাবনা করলে তিনি গল্পকে সুনিপুণভাবে উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছেন।

কারিগরি: সবথেকে ভালোলাগার দিক হলো এম.এইচ স্বপনের ক্যামেরার কাজ। আহামরি চমকে দেওয়ার মতো কিছু করেননি, তবে যেটুকু ভিন্নতা আনার চেষ্টা করেছেন সেটা ভালোলাগার মতো। সম্পাদনা করেছেন তৌহিদ হোসেন চৌধুরী, মোটামুটি কাজ হয়েছে। কালার গ্রেডিং ভালো। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক দিয়েছেন ইমন সাহা, সেখানেও চলনসই কাজ পেয়েছি।

আর্ট ডিজাইন করেছেন রহমতুল্লাহ বাসু এবং ফরিদ আহমেদ; এফডিসিতে এবার তারা ভালো কিছু সেট বসিয়েছেন। যারা নিয়মিত বাংলা সিনেমা দেখেন তাদের কাছে ততটা রিয়েলিস্টিক ফিল আসবে না, তবে আগের মতো সস্তা রুগ্নদশা দেখতে হয়নি। লাইটিং ভালো। ফাইট ডিরেক্টর ছিলেন ডি.এইচ চুন্নু এবং ভারতের রাজেশ কান্নান; বরাবরের মতোই দুর্বল মারামারি দেখতে হলো।

এ অংশ পাবে ১০০ তে ৫০।

বিনোদন ও সামাজিক বার্তা: গান রয়েছে ৪টি। জাকির হোসেন রাজুর লেখা এবং শফিক তুহিনের সুরে জাহাঙ্গীর সাঈদের গাওয়া টাইটেল গানটি সেরা। পরিচালনায় ফেইল করলেও গীতিকার হিসেবে রাজু সেরাটা দিয়েছেন। হাবিব রহমান এ গানে ভালো কোরিওগ্রাফি করেছেন। ছবিতে হালের ক্রেজ মাহতিম সাকিবকে প্রথমবার প্লেব্যাকে পাওয়া গেলো। তার ও স্বরলিপির গাওয়া ‘প্রাণ জুড়িয়ে যায়’ গানটি সত্যিই প্রাণ জুড়িয়ে দেয়। তবে এই গানে বাবা যাদবের কোরিওগ্রাফি ভালো লাগেনি। এছাড়া ইমরান-খেয়ার গাওয়া ‘কত ভালোবাসি তোরে’তে শফিক তুহিন ভালো মিউজিক দিয়েছেন। কিন্তু তিনিই আবার ‘এ খাঁচা ভাঙতে হবে’ গানে সম্পূর্ণ হতাশ করেছেন। কোরিওগ্রাফার হাবিবও এই গানে নতুন কিছু সংযোজন করতে পারেনি, নব্বই দশকে যেভাবে উপস্থাপন করা হতো তিনি ঠিক সেই রীতিই ফলো করেছেন।

বর্তমান সমাজে ধর্ষণ যেন এক রকম ট্রেন্ডে পরিণত হয়েছে। পত্রপত্রিকায় চোখ বোলালেই এরকম কোনো না কোনো খবর প্রতিনিয়ত পাওয়াই যায়। এর মধ্যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দোষীরা আইনের আওতায় আসে না, আসলেও বিচার বিভাগের দূর্বলতায় অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। এসিনেমায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়বার একটা সহজ পদ্ধতি দেখানো হয়েছে – একতাবদ্ধ হওয়া। সিনেমাতে ‘আলো’ নামক সংগঠনটি সমাজে সেই কাজটি প্রতিনিয়ত করতো, অন্যায়ের বিরুদ্ধে থাকা মানুষদের একত্র করা। যে কাজটি দুই হাত দিয়ে করা অসম্ভব সেই কাজ দশ হাত থাকলে করা যায়। একতাবদ্ধ থাকলেই সমাজের শত্রুরা ক্ষতি করার কোনো সুযোগ পাবে না।

এ অংশ পাবে ১০০ তে ৬০।

ব্যক্তিগত: সবমিলিয়ে যদি বলি, এ সিনেমার গল্প ও অভিনয় শক্তিশালী দিক; একইসাথে গল্পের উপস্থাপনা ও প্রধান নেতিবাচক চরিত্রগুলোকে যথেষ্ট জায়গা না দেওয়া দুর্বল দিক।

রেটিং: ৫.৫/১০

ছবিটি কেন দেখবেন: শাকিবভক্তরা বরাবরই হিরোইজম দেখতে অভ্যস্ত, এবার প্রিয় নায়ক তাদের জন্য কিছুটা ভিন্নতা আনার চেষ্টা করেছেন। একবার দেখে আসতে পারেন। বন্ধু-বান্ধবের তুলনায় ফ্যামিলি অডিয়েন্স এ ছবি যে কেউ তুলনামূলক বেশি উপভোগ করতে পারবেন। ছবিতে কমার্শিয়াল উপাদান যথেষ্ট আছে, কিন্তু যদি শুধুমাত্র আড়াই ঘণ্টা হই-হুল্লোড় করে কাটাবেন এমন চিন্তা নিয়ে যদি পর্দার সামনে বসেন, আপনাকে হতাশ করবে।


Leave a reply