Select Page

‘হাওয়া’ ও আরবান প্রতিক্রিয়াশীলতার বাস্তব চেহারা

‘হাওয়া’ ও আরবান প্রতিক্রিয়াশীলতার বাস্তব চেহারা

আরবান মিডিল ক্লাস যে প্রান্তিক শ্রমজীবীদের কীভাবে দেখে তার বড় এক নজির ‘হাওয়া’ এবং তার দর্শক সমাজ। একে ছোট পরিসরে এক সাংস্কৃতিক যুদ্ধও বলা যায়…

এক সময় অনেক মুভি দেখতাম। এত বেশি দেখতাম যে এখন কল্পনা করাও কঠিন। ঢাকার জোনাকিতে (বাংলা মুভি) এবং অভিসারে (ইংরেজি মুভি) যে শতাধিক মুভি দেখেছি সেগুলোর তালিকাও পুরানো কাগজের ভেতর ছিল কিছু দিন আগ পর্যন্ত। পারিপার্শ্বিকতা সেই বিলাসিতা কেড়ে নিয়েছে। তবে অনেকদিন পর এক বন্ধুর সৌজন্যে ‘হাওয়া’ মুভিটি দেখলাম।

‘হাওয়া’র নির্মাতাদলের প্রচার কৌশলের তারিফ করতেই হয়। অবশ্যই বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম ওভাররেটেড মুভি এটা। এতে অবশ্য সমস্যাবোধ করার কিছু নাই। কিন্তু বিস্ময়বোধ করেছি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এবং মূলধারার প্রচারমাধ্যমে এই মুভির রিভিউগুলো পাঠ করে।

প্রশ্ন হলো, এ মুভি সমুদ্রগামী মৎস্যজীবীদের সম্পর্কে আমাদের কী বার্তা দেয়? এই শ্রমজীবীরা নেশা করে, অসৎ উপায়ে মাছ বেচে আয়ের ধান্ধায় থাকে, পরস্পর ষড়যন্ত্র করে বেড়ায়, মদ খায়, গালিগালাজ করে সারাক্ষণ, নির্মমভাবে খুনখারাবি করে ইত্যাদিই পাই কেবল মুভিটিতে— তাই না?

বাংলাদেশে লাখ লাখ সমুদ্র ও নদীমুখী মৎস্যজীবী আছে। এরা আমাদের জাতীয় অর্থনীতির বড় এত শক্তি। মৎস্য আহরণে বাংলাদেশ সম্প্রতি খুব ভালো করছে এদের কল্যাণে। কিন্তু এদের জীবনধারা নিয়ে জাতীয়ভাবে খুব বেশি মুভি হয়নি। সে বিবেচনায় হাওয়া ভালো উদ্যোগ। কিন্তু বিশাল একদল শ্রমজীবীকে এই মুভি কীভাবে তুলে ধরলো— সেটাও ভাবা দরকার আছে নিশ্চয়ই।

এ মুভি দেশ বিদেশের মানুষকে আমাদের মৎস্যজীবীদের জীবন যাপন সম্পর্কে কী ধারণা দিল?

বাস্তবতা হলো, সমুদ্রগামী মৎস্যজীবীদের অসংখ্য সমস্যা। সময়মতো সঠিক আবহাওয়া বার্তার অভাবে প্রতি মওসুমে অনেক মৎস্যজীবী মারা যায়। প্রায় সময়ই অনেক জেলে সুদে টাকা নিয়ে সাগরে যায়। পরিমাণমতো মাছ পায় না বলে ঋণের জাল থেকে তাদের আর রেহাই মিলে না। সরকার বছরে কয়েকবার মাছ ধরা বন্ধ রাখে বলে নদী ও সাগরে মাছ ধরা জেলেরা তখন পুরোই বেকার হয়ে পড়ে। সেসময় ধারকর্জ আরেক দফা বাড়ে। প্রকৃত মৎসজীবীদের নেই কোন ইউনিয়ন— ফলে জাতীয়ভাবে তাদের এসব সমস্যা নিয়ে উচ্যবাচ্য করার মানুষও কম। সাগর থেকে বহুসময় এই মৎস্যজীবীদের ধরে নিয়ে যায় অন্যদেশের নৌ পুলিশ। এই জেলেরা যখন বিদেশের কারাগারে থাকে পরিবার তখন ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়।

এরকম হাজারো সমস্যার মাঝে যারা দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছে ‘হাওয়া’ তাদের কীভাবে চিত্রায়ন করলো? ভায়োলেন্স, চুরিচামারি আর লুকিয়ে প্রেম করা ছাড়া আমাদের মৎস্যজীবীদের জীবনে কিছু নাই? আর এসব দেখে প্রশংসায় মিডিয়া ভাসিয়ে দিলাম আমরা? কী নিদারুণ প্রতিক্রিয়াশীলতা!

আরবান মিডিল ক্লাস যে প্রান্তিক শ্রমজীবীদের কীভাবে দেখে তার বড় এক নজির ‘হাওয়া’ এবং তার দর্শক সমাজ। একে ছোট পরিসরে এক সাংস্কৃতিক যুদ্ধও বলা যায়। আপাতত সেটা একতরফাই হয়ে গেল।

এ মুভি দেখতে হলে হলে উপচে পড়া রাজধানীর নবীন প্রজন্ম আমাদের মৎস্যজীবীদের সম্পর্কে কী ধারণা পাবে? ওরা কি এটাই ভাববে না যে, এরা একটা আদিম বন্য জনগোষ্ঠী? কিন্তু বাস্তবে কী এই জনগোষ্ঠী এরকম? দেশের শ্রমজীবী, প্রান্তনিবাসীদের সঙ্গে আরবান মিডল ক্লাসের এই দূরত্ব তৈরির মাঝে কী কোন রাজনীতি নাই? থাকলে সেই রাজনীতিটা কী?


About The Author

আলতাফ পারভেজ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনশাস্ত্রে পড়েছেন। বর্তমানে আগ্রহ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে।

Leave a reply