Select Page

হারানো সাম্রাজ্য ফিরে পাচ্ছে বাংলা সিনেমা, আশা আফজাল হোসেনের

হারানো সাম্রাজ্য ফিরে পাচ্ছে বাংলা সিনেমা, আশা আফজাল হোসেনের

নিজেকে ‘সিনেমাপাগল’ দাবি করলেও আফজাল হোসেনের ক্যারিয়ারে সিনেমা হাতে গোনা কয়েকটি। মূল চরিত্র করেছেন ‘দুই জীবন’ ও ‘নতুন বৌ’ সিনেমায়। তবে টিভি পর্দায় তিনি ছিলেন সরব, দুর্দান্ত সেই ক্যারিয়ার। আজকাল জমিয়ে দিচ্ছেন ওটিটি। সম্প্রতি ঈদের সিনেমা প্রসঙ্গে খুলে দিলেন গল্পের ঝুলি। ফেসবুকে। পড়ে নিন সেই লেখাটি—

ছিলাম সিনেমার পাগল। এতটাই পাগলামো ছিল, ঢাকাতে যেদিন প্রথম পা দেই- শহর তেমন আকৃষ্ট করেনি, করেছিল সিনেমা হল।

বলাকা সিনেমা হলের পাশ দিয়ে যেতে যেতে দেখি, দর্পচূর্ণ চলছে।

গ্রামের ছেলে, মফস্বলের সিনেমা ঘরে ছয় মাসের বা এক বছরের পুরানো সিনেমা দেখতে হতো। দর্পচূর্ণের বিশালাকারের ঝলমলে ব‍্যানার দেখে নেশা চেপে গেলো, আজকেই সিনেমাটা দেখতে হবে।

এখনও বলাকা সিনেমা হলের সামনে দিয়ে যখনই যাই, আমার মন ঘুরে তাকায় বলাকার দিকে। আজও তাকিয়েছি। তাকিয়ে দেখে খুব কষ্ট হলো- কেমন সর্বস্বান্ত হয়ে দাঁডিয়ে রয়েছে সে সিনেমাঘরটা।

ঢাকা থেকে মিরপুর দিয়ে বের হতে গেলে অবশ‍্যই আমি ডান দিকে ঘুরে বিউটি সিনেমা হলটাকে খুঁজি। পাই না। অনেকদিন পর সেদিন হাটখোলার দিকে যেতে হয়েছিল। মতিঝিলে ঢুকেই মনে হয়, আহা! কত পুরানো স্মৃতিময় মধুমিতা, অভিসারের সামনে দিয়ে যেতে হবে। অনেকদিন পর সিনেমা হল দুটোকে দেখতে পাবো।

দেখতে পেলাম। মধুমিতাকে মনে হলো প্রাচীন বংশের নিঃস্ব সন্তানের মতো। বরবাদ চলছে বলে মানুষজনের ভীড় রয়েছে কিন্তু সে ভীড়ে উৎসব মুখরতা নেই। আমাদের যৌবনে সিনেমা দেখাটা ছিল আনন্দ উদযাপন। অভিসার সেদিন দুঃখ দিয়েছে। মনে হলো, তার যদি দুঃখ প্রকাশের ক্ষমতা থাকতো- রোজ যত মানুষ তার দিকে স্মৃতিভারাক্রান্ত মন নিয়ে তাকায়, জায়গাটা শোকে, দুঃখে অঝোরে কাঁদতো।

গুলিস্তানের দিকে অনেকদিন যাওয়া হয় না। যেসব বন্ধুবান্ধব ওদিকে যায় টায়— তারা বলে, যাসনে ওদিকে। গুলিস্তান সিনেমা হলের দিকে তাকালে মনে হবে— ইতিহাস চুরমার, স্মৃতি ধুয়ে মুছে সাফ।

আজ এপ্রিলের চব্বিশ তারিখ। পাঁচটা পনেরোয় বলাকা অতিক্রম করেছি। ঠিক এ সময়টাতে লোক গমগম করতো হলটার সামনে। টিকেট ব্ল‍্যাকার গলা তুলে মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করতো- অ‍্যাই রেয়ার, অ‍্যাই ডিসি। প্রবেশ পথের মুখে হাউস ফুল লেখা লাল বোর্ড ঝোলানো তবু টিকেট কাউন্টারের সামনে হাল্কা ভীড় জমে থাকতে দেখেছি।

যারা টিকেট পেয়ে গেছে, তারা দেখতাম— আসিতেছে, চলিতেছে লেখা বোর্ডগুলোর সামনে জড়ো হয়ে প্রদর্শনের জন‍্য সাজিয়ে রাখা সিনেমার স্থিরচিত্রগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখছে।

আসিতেছে মানে প্রদর্শিত হওয়ার জন‍্য যে সিনেমা আগামীতে এই হলে আসবে আর চলিতেছে মানে, যে ছবি প্রেক্ষাগৃহে চলছে। খবরের কাগজগুলোয় বিজ্ঞাপন ছাপা হতো, অমুক অমুক প্রেক্ষাগৃহে সগৌরবে চলিতেছে অমুক অমুক ছবি।

সময়ের তোড়ে কতকিছু বদলে যেতে দেখলাম। সিনেমা হলগুলোতে ইংরেজী, উর্দু এবং বাংলা- তিনটি ভাষার সিনেমা চলতো। সর্বশ্রেনীর দর্শক সব ভাষার সিনেমা আগ্রহ নিয়েই দেখেছে। ইংরেজি ছবি হাউস ফুল, উর্দু ছবি চলা সিনেমা হলেও টিকেট নেই। আর বাংলাতে সিনেমা হয়েছে কতরকমের— সবরকমের সিনেমা দেখতে ঠ‍্যালাঠেলি ধাক্কাধাক্কি হতে দেখতাম।

সকল রকমের সিনেমা দেখায় আগ্রহ ছিল বলেই নির্দ্বিধায় তৈরি হয়েছে সামাজিক সিনেমা, পোষাকি বা রাজনৈতিক সিনেমা। গ্রামের গল্প, শহুরে গল্প— সবরকমের সিনেমাকে উপভোগ‍্য মনে করা মানে দর্শকের মানসিক উচ্চতা কতখানি ছিল- বুঝে নেয়া যায়।

এখনও ভেবে অবাক হই—  নায়ক-নায়িকারা সংখ‍্যায় ছিলেন অনেক এবং তাঁদের সকলেরই আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। সে বৈশিষ্ট্যের জন্য সিনেমা সাদা-কালো হলেও তারকারা হৃদয়ে হৃদয়ে রঙ ছড়াতে পারতেন। সব অভিনয়শিল্পী, পরিচালক, সুরকারদের প্রতি আলাদা মনোযোগ ছিল দর্শকের।

দর্শকেরা তখন সিনেমার আদর্শ দর্শক ছিলেন। সিনেমার বিজ্ঞাপনে কাহিনী কার, গানের কথা কার, লেখা বা সুর করেছেন কোন সুরকার সবই জানার আগ্রহ ছিল।

নায়িকাদের সাজগোজ নিয়ে আলাপ হতো। সিনেমা মন্দ লাগলে মনখারাপ করতেন কিন্তু দুর্নাম করতে কোমর বেঁধে নেমে পড়তে দেখিনি। পরিচালকেরা তাই দারুণ একটা হিট ছবি বানানোর চেষ্টায় নেমে পড়তেন না। দর্শকের প্রতি সন্মান রেখে নতুন ধরণের চলচ্চিত্র উপহার দেবার চেষ্টা করতেন।

দর্শকেরা নিজের দেশের অসংখ‍্য তারকাদের পাশাপাশি ইংরেজি ছায়াছবির ক‍্যারি গ্র‍্যান্ট, গ্রেগরী পেক, চার্লস ব্রনসন, এলিজাবেথ টেলর, সোফিয়া লরেন, ব্রিজিট বার্দোতদেরও চিনতেন। উর্দূভাষী, ভারতীয় বাংলা এবং হিন্দী ভাষাভাষী অভিনয়শিল্পী, চলচ্চিত্র, গল্প, চরিত্র, গান ইত‍্যাদি নিয়ে ব‍্যাপক চর্চা হতে দেখেছি।

এসব উদাহরণ বলে দেয়, দর্শকের কাছে সিনেমা, চলচ্চিত্র খুবই আগ্রহের, ভালোবাসাপূর্ণ, বিনোদনের বিষয় ছিল। বলতে হচ্ছে ছিল- অর্থাৎ নেই এখন। একসময় দেখতে পাই, সিনেমার জন‍্য আগের সেই আগ্রহ, ছায়াছবির প্রভাব মানুষের মন থেকে মুছে গেছে। যা সুন্দর- তা জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া দুঃখের।

সারা বিশ্বে সিনেমার রূপান্তর ঘটছে। চলচ্চিত্র দিয়ে দেশের পরিচিতি তৈরি হয়। দেশের নাম ছড়িয়ে পড়তে পারে বিশ্বব‍্যাপী। দেশ অন‍্য দেশের মানুষের কাছ থেকে সমীহ পেতে পারে- আর আমরা সিনেমা দেখা, বানানো ছেড়ে দিলাম।

আমাদের ঝলমলে সিনেমাজগৎটা অন্ধকারে ডুবে গেলো।

সৌভাগ‍্যের কথা অন্ধকার থেকে সিনেমা আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠতে শুরু করেছে। এবারের ঈদে মুক্তি পেয়েছে চার চারটি সিনেমা। চক্কর, জংলী, দাগী এবং বরবাদ। খুব ভালো লাগছে- ঈদের পর থেকে আজ অবধি যেখানেই যাই এই সিনেমাগুলো নিয়ে চর্চা হতে দেখি। এটা হারানো সাম্রাজ‍্য ফিরে পাওয়ার মতো।

তারকা সিনেমার চেহারা বদলে দিতে পারে। সিনেমাও বদলে দিতে পারে তারকাকে। শাকিব খান তার উদাহরণ। এই তারকা প্রথমে নিজের পরিবর্তন ঘটিয়েছেন তারপর ক্রমাগত বদলে দিচ্ছেন তাঁর সিনেমাগুলোকে।

দেশটায় আরও কয়েকজন সাহসী পরিচালক থাকলে মোশাররফ করিম, চঞ্চল চৌধুরী, সিয়াম, নিশোরা আমাদের চলচ্চিত্রের মহা আকর্ষণ হয়ে উঠতে পারতেন। সিনেমার চেহারায় দারুণ পরিবর্তন  নিশ্চয়ই আসতে পারতো।

আমি দাগী দেখেছি। শিহাব শাহীনকে অতি চমৎকার নির্মাতা হিসাবে জানি, তাই আগ্রহ নিয়ে দাগী দেখতে যাই। নিশোকে নিয়ে বহু মহলে আলোচনা শুনি- সেজন্যেও বন্ধুবান্ধব ঠিক করে দাগী দেখবে।

একসাথে গিয়েছিলাম নয়জন। সবাইকে মুগ্ধ করতে পেরেছে দাগী। হল থেকে বেরিয়ে দলেবলে রেস্তোরাঁয় খেতে গেছি- এ পুরো সময়টা দাগী নিয়ে অসংখ‍্য রকমের কথা হয়েছে।

আমার খুব ভালো লেগেছে- আবার আগের মতোই আমাদের দেশে তৈরি একটা সিনেমা নিয়ে দীর্ঘক্ষণ সবাই হৈহৈ রৈরৈ আলাপ করেছি। শিহাব শাহীন মুগ্ধ করেছে তারা নির্মানের মুন্সীয়ানা দিয়ে। গল্পটা এক বৈচিত্র থেকে আর এক বৈচিত্রে দৌঁড়ায়। থামে না। দৌঁড়াতেই থাকে।

কি হবে এরপর- এই কৌতুহল সারাক্ষণ টিকিয়ে রাখতে পারা খুবই কঠিন কিন্তু সহজেই তা পেরেছেন শিহাব শাহীন।

নিশো চমকে দেওয়ার মতো সুবাতাস। এত বড় একটা চলচ্চিত্রের ভার কাঁধে নিয়ে দর্শকমনে বিশ্বস্ততা ধরে রেখে দৌঁড়ে চলা মোটেও সহজ কাজ ছিলনা। সিনেমার পর্দাটা অনেক বড় সেই পর্দা জুড়ে সারাক্ষণ বড় হয়ে জুড়ে যে থাকতে পারে- সে ই নায়ক।

এই সিনেমার প্রত্যেক অভিনয়শিল্পীকে বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে। চরিত্রগুলোর উপস্থাপনা অসাধারণ। প্রেমকে নতুনভাবে হাজির করা হয়েছে আর দুই নায়িকার প্রেমময়তা যে কোন দর্শকের জন্য চমৎকার উপহার।

আমি আমাদের কালে সিনেমা পাগল ছিলাম। বয়স বেড়েছে কিন্তু একের পর এক ভালো সিনেমা হতে থাকলে যৌবনের আনন্দ আবার ফিরে পেতে পারি- মনে হয়েছে। নতুন নতুন সিনেমা ঘর হোক, মানুষ সিনেমা দেখুক। নানারকম গল্পের চর্চায় মানুষ নিত‍্য নতুন করে নিজেকে আবিষ্কার করতে পারুক। এ চাওয়া বাড়াবাড়ি রকমের নয়।

ঈদের আনন্দের সাথে বহুকাল পরে আবার সিনেমার আনন্দ যুক্ত হয়েছে। এ যেনো হারিয়ে পাওয়া। মানুষ কথা বলছে বরবাদ, চক্কর, জংলি, দাগী নিয়ে। সিনেমা তো এক ধরণের স্বপ্ন রচনা। স্বপ্ন বড় হতে থাকলে মানুষও বড় হবে।


Leave a reply