হালদা : নোনা জলের গল্পে আমাদের সিনেমা
সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে বর্ণিল সাজে সজ্জিত মতিঝিলের মধুমিতা সিনেমা হলে তখন সর্ব সাকুল্যে এক-দেড়শোর মতোন দর্শক। শো শুরু হওয়ার আগে নিয়ম মেনে জাতীয় সংগীত বেজে উঠল। পাশের বন্ধুসহ দাঁড়িয়ে চারিপাশে তাকিয়ে দেখি– আমরা দুজনই কেবল দাঁড়িয়ে! হলজুড়ে জাতীয় সংগীত বাজছে – অথচ মানুষ বসে আছে, উচ্চশব্দে মোবাইলে কথা বলছে, পাশের জনের সাথে গল্প করছে। কয়েক বছর আগে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বেশ আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ”বঙ্গবন্ধু একটি অনিচ্ছুক জাতিকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন।” উনি কি খুব ভুল বলেছিলেন?
জয়যাত্রা, রূপকথার গল্প, দারুচিনি দ্বীপ, অজ্ঞাতনামার মতোন সিনেমা বানিয়েছেন যে নির্মাতা তার সিনেমার শিল্পগুণ বিচার করার মতোন ধৃষ্টতা দেখানোর দুঃসাহস আমার নেই। তবে, ব্যক্তিগত ভালো লাগা-খারাপ লাগাটুকু বর্ণনা করার ঝুঁকিটুকু নেওয়াই যায়।
গল্পটা একটা নদীর আর তার চারিপাশের মানুষের ব্যাক্তিজীবনের টানাপোড়েনের, আক্ষেপের, রূঢ় বাস্তবতার। আজাদ বুলবুলের লিখা মূল গল্প থেকে কাহিনী, সংলাপ, চিত্রনাট্য লিখেছেন পরিচালক তৌকির আহমেদ নিজেই। ট্রলার ডাকাতির কবলে পড়ে সর্বস্ব হারানো জেলে মনু মিয়াকে জানে বাঁচিয়ে তার বাড়িতে ঠাঁই হয় এতিম বদির। মনু মিয়ার মেয়ে হাসুকে তার ভালো লাগে। হাসুরও ভালো লাগে বদিকে। হালদার পাড়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখে দুজন। কিন্তু, বাবার দেনা মেটানোর বাস্তবতার কাছে হার মানে হাসুর স্বপ্ন। বিয়ে করে তিন গ্রাম পরের চৌধুরী বাড়ির নিঃসন্তান নাদেরকে।
বদরাগী স্বামী, হিংসুটে সতীন জুঁই, শাশুড়ি সুরত বানুর সংসারে থাকলেও হাসুর মন পরে থাকে আলাভোলা সহজ সরল বদির কাছে। মায়ার টানে বদিও বারবার ছুঁটে আসে হাসুর কাছে। বদিকে ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতাটুকু নেই হাসুর, নেই ধরে রাখার ক্ষমতাও। গল্পের অন্য অধ্যায়ে মানুষের লোভের কাছে হালদা নদীর হেরে যাওয়া, ক্ষয়ে যাওয়া। পয়সা পেয়ে প্রশাসন নির্বিকার, নিম্নবিত্ত মানুষগুলোর ভাতের হাড়িতে পড়ে থাকা হাহাকারেরা সেখানে বড্ড নিঃসঙ্গ। হাসু-বদির প্রেম কি পূর্ণতা পাবে কিংবা এভাবেই কি ধ্বংস হতে থাকবে হালদা? এইসকল প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য একটু কষ্ট করে নিকটস্থ সিনেমা হলে যেতে হবে আপনাকে!
অভিনয় নিয়ে বেশি কিছু বলার নেই। জাহিদ হাসান, নুসরাত ইমরোজ তিশা, মোশাররফ করিম, ফজলুর রহমান বাবু, রুনা খান, দিলারা জামান প্রত্যেকে নিজের সেরা কাজ দেখানোর জন্য এই সিনেমাকে বেছে নিয়েছেন- এমন লাগছিলো। এর মধ্যেও, নুসরাত ইমরোজ তিশা-মোশাররফ করিমের রোমান্টিক দৃশ্যগুলোয় তাদের অভিনয় একটু বেশিই ভালো লেগেছে। শুধু কথায় নয়, তারা অভিনয় করছিলেন- চোখ-মুখের এক্সপ্রেশানে, নীরবতার ভাষায়। বড়পর্দায় এতো ন্যাচারাল অভিনয় দেখা সত্যি ভাগ্যের ব্যাপার।
সিনেমাটোগ্রাফি অসাধারণ। হালদা নদীর সৌন্দর্য খুব চমৎকারভাবে ক্যামেরার ফ্রেমে ফুটিয়ে তুলেছেন তাহির আহমেদ ও এনামুল হক সোহেল। বেশি মুগ্ধ করেছে ভিজ্যুয়াল ইফেক্ট। বৃষ্টি, বজ্রপাতের শব্দ, মেঘ- আলো-ছায়ার খেলায় শতভাগ সফল কৌশিক রায়। পিন্টু ঘোষের সংগীতায়োজন কানের জন্য আরামদায়ক। চরিত্রের পোশাক-পরিচ্ছদ, মেকাপের মতো বিষয়েও যত্নের কোনো কমতি ছিল না। প্রতিটা দৃশ্যে নির্মাতার শিল্পের প্রতি ভালোবাসার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছিল। পালাগানের দৃশ্যটুকু ছাড়া নির্মাণে তেমনভাবে কোনো দুর্বলতা চোখে পড়েনি!
সবকিছু ছাপিয়ে যে জিনিশটা প্রথম থেকে শেষ অব্দি সিনেমার প্রতি মায়া বাড়িয়েছে তা হচ্ছে- এই সিনেমার সংলাপ।
– মিছা কতা কইলা ক্যান? ক্যান কইলা খও?
– ভালোবাসাত মিছা কইলে পাপ নয়।
– চুপ করো। আই কেউরে ভালো ন বাসি।
– জানি। ইতার লাই তো লইতে আসছি।
– আর ঘর দেখিলা, তুয়ার ঘর ন তুলিবা?’
এমন অসংখ্য আঞ্চলিক ভাষার সংলাপ পুরো সিনেমা জুড়ে বারবার মুগ্ধ হতে বাধ্য করেছে। মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্তের গল্প আমরা হররোজ ফেসবুক থেকে শুরু করে টিভি পর্দায় দেখে অভ্যস্ত কিন্তু প্রান্তিক নিম্নবিত্ত মানুষদের গল্প বলার কেউ নেই। উনাদের আবেগের কথা, অনুভূতির কথা সংলাপের মাধ্যমে বড়পর্দায় এমন শিল্পসম্মতভাবে তুলে আনবেন নির্মাতা- সত্যি বলতে এতো প্রত্যাশা করিনি। এই জায়গাটায় প্রত্যাশাকেও ছাপিয়ে গিয়েছেন নির্মাতা।
একেক সিনেমার একেক ধরণের দর্শক রয়েছে। কারো কাছে হয়তো নাচ-গান-মারামারিতে ভরপুর সিনেমা ভালো লাগে, কারো কাছে জীবন নিয়ে ভাবতে শেখানো সিনেমা। হালদা জীবন নিয়ে ভাবতে বাধ্য করা সিনেমা। সিনেমা দেখা শেষে হল থেকে বেরিয়ে নিষ্ঠুর বাস্তবতার কথা ভেবে মন খারাপ হবে আবার পরক্ষণে প্রকৃত শিল্প দেখতে পারার জন্য মন ভালো লাগবে। ধন্যবাদ, তৌকির আহমেদ। আপনার পরবর্তী সিনেমার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। শিল্পের জয় হোক।