হিট সিনেমার লাভের টাকা কোথায় গেল?
আয়নাবাজি। ঢাকা অ্যাটাক। দেবী। হাওয়া। এই ছবিগুলোই সাম্প্রতিক বছরে বলার মতো ব্যবসা করেছে। এর বাইরে যে ছবিগুলো ব্যবসা করেছে সেগুলো হয় শাকিব খানের ছবি, নয় জাজ মাল্টিমিডিয়ার ছবি। এই ছবিগুলো দিয়ে বাইরের প্রযোজকরা বলতে গেলে সিনেমাকে নাড়িয়ে দিয়েছেন। ছবিগুলো নিয়মিত দর্শকদের বাইরে বিপুল দর্শকদের সিনেমা হলে ফিরিয়ে এনেছে; একরকম প্রমাণ করেছে, দর্শকরা আর নকল ছবি দেখতে আগ্রহী নয়। সবচেয়ে বেশি যে জিনিষটা প্রমাণ হয়েছে, তা হচ্ছে, নাট্যনির্মাতারাও সিনেমা নির্মাণে সফল হতে পারেন।
দেবী ও হাওয়া (কোলাজ)
কিন্তু দীপংকর দীপন বা অমিতাভ রেজা চৌধুরী সফল নির্মাতা হলেও, তাদের ছবি দর্শককে সিনেমা হলে টেনে আনলেও, তাদের ছবি কি পরিপূর্ণভাবে সফল? যদি সফলই হবে কেন তবে এই প্রযোজকরা পরের ছবি নির্মাণ করলেন না? ‘আয়নাবাজি’র প্রযোজক কেন পরের প্রডাকশনে হাত দিলেন না? ‘ঢাকা অ্যাটাকের’ প্রযোজক কোথায় হারিয়ে গেলেন? ‘দেবী’র পর মিসির আলীকে নিয়ে দ্বিতীয় ছবিটি কোথায়?
আগে একটা ছবি সফল হলে দেখা যেত, সেই ছবির পরিচালক নতুন একটা ছবি শুরু করতেন, সেই ছবির প্রডাকশন হাউজ নতুন ছবির কাজে হাত দিত। এটাই ছিল ট্রেন্ড। এভাবেই ইন্ডাস্ট্রির চাকা ঘোরে। একটা হিট ছবির লাভের টাকা ইন্ডাস্ট্রিতে খাটে। ‘দেবী’র লাভের টাকা কোথায় গেল? `হাওয়া’র লাভের টাকা কি বিনিয়োগ হবে ইন্ডাস্ট্রিতে?
নব্বই দশকের কথাই ধরা যাক। একজন বিশেষ নায়কের কথাই বলি। সর্বকালের অন্যতম সফল চিত্রনায়ক সালমান শাহর ছবিগুলোকেই ফিরে দেখি। ‘স্বপ্নের পৃথিবী’ তার একটা সুপারহিট ছবি। এই ছবিটি ব্যবসাফল হওয়ার পর এর প্রযোজনা সংস্থা ‘স্বপ্নের পৃথিবী’র পরিচালক বাদল খন্দকারকে দিয়ে নির্মাণ করায় ‘পৃথিবী তোমার আমার’, ‘মিস ডায়না’র মতো কিছু ছবি।
‘স্বপ্নের ঠিকানা’ শুধু সালমান শাহর জীবনে কেন, সিনেমার ইতিহাসেও বলার মতো ব্যবসাসফল ছবি। এই ছবির প্রযোজন প্রতিষ্ঠান হিট ছবি দেয়ার পর হারিয়ে যায়নি। সালমান শাহ বেঁচে না থাকায় তারা রিয়াজকে নিয়ে নির্মাণ করেছে ‘হৃদয়ের আয়না’, মান্নাকে নিয়ে নির্মাণ করেছে ‘শেষ প্রতীক্ষা’। ‘মায়ের অধিকার’ যে প্রযোজনা সংস্থা নির্মাণ করেছে, সেই ব্যানারও কিন্তু একই পরিচালক শিবলী সাদিককে দিয়ে নির্মাণ করেছে ‘আনন্দঅশ্রু’, পরে সেলিম আজমকে দিয়ে বানিয়েছে ‘অনেক দিনের আশা’।
আর উদাহরণ না বাড়াই।
আজকের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি হয়ে গেছে সরকারি অনুদাননির্ভর। সবাই ছুটছে অনুদানের পেছেনে। যারা টাকা আছে সেও ছুটছে, যারা টাকা নেই সে তো পড়িমরি করে ছুটছে। বড় প্রযোজকও কাছা মেরে ছুটছে, কমপদর্কহীন প্রযোজকও লাফিয়ে ছুটছে। এর ফলে ছবি তো হচ্ছে, কিন্তু ইন্ডাস্ট্রিতে প্রযোজনা সংস্থা গড়ে উঠছে না।
‘স্বপ্নের ঠিকানা’, ‘স্বপ্নের পৃথিবী’, ‘মায়ের অধিকার’ ইত্যাদি হিট হওয়ায় যে প্রযোজকদের জন্ম, তারা ইন্ডাস্ট্রিতে গেড়ে বসেছিলেন। যে কারণে ঢালিউডে টাকার প্রবাহে কখনো ঘাটতি পড়েনি। কিন্তু ‘ঢাকা অ্যাটাক’ চালিয়ে হল মালিকরা লাভের মুখ দেখেছেন ঠিকই, ‘দেবী’ চালিয়ে মধুমিতা মালিকের মুখে হাসি আর ধরে না; কিন্তু নতুন প্রযোজনা সংস্থা গড়ে না ওঠায় ছবিগুলোর চূড়ান্ত কোনো অবদান নেই।
একজন প্রযোজক একটা ছবি মুক্তি দিয়েই লোকসান করে তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে যাচ্ছে। যারা হিট ছবির প্রযোজক তারাই যদি প্রডাকশন হাউজ হিসেবে প্রতিষ্ঠা না পায়, তবে ক্ষুদ্র প্রযোজকরা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো টিকে থেকে কিভাবে ইন্ডাস্ট্রিকে অর্থনৈতিকভাবে সবল করে তুলতে পারে?
হল মালিকদের কাছ থেকে সিনেমাটাকে প্রযোজকের বা পরিচালকের করতে চাইলে বড় প্রযোজনা সংস্থা প্রয়োজন। বিচ্ছিন্ন-বিনিয়োগকারীদের হাতে সিনেমা নিরাপদ নয়, সিনেমা নিরাপদ প্রযোজনা সংস্থার হাতে।
এখন সিনেমার পুরো সিস্টেমে সবচেয়ে লাভবান গোষ্ঠী হল মালিকরা। ‘ঢাকা অ্যাটাক’ বা ‘দেবী’ থেকে সবচেয়ে বেশি পয়সা কামিয়েছে তারা। লাভের গুড় প্রযোজক পেয়েছে যৎসামান্যই। হল মালিকদের সঙ্গে দর কষাকষি করে জিতে আসতে পারবে এমন প্রযোজনা সংস্থা দরকার এখন। শিল্পীদের পৃষ্ঠপোষকতা করার জন্য বড় প্রযোজনা সংস্থা লাগবে। নতুন পরিচালকদের প্রতিষ্ঠার জন্য প্রযোজনা সংস্থা চাই।
এজন্য, হিট ছবির চেয়েও জরুরি কয়েকটা প্রযোজনা সংস্থার নিজের পায়ে দাঁড়ানো। অতীতে যেমনই হোক না কেন, আশা করব ‘হাওয়া’র মতো ছবি সফল ছবির প্রযোজনা সংস্থাগুলো ছবিটির লাভের টাকা ইন্ডাস্ট্রিতে খাটাবে। তারা আরো একটা আনন্দমেলা সিনেমা হয়ে উঠবে, হয়ে উঠবে বাংলাদেশের যশরাজ প্রডাকশন!
/ লেখাটি আরটিভি অনলাইনে পূর্ব প্রকাশিত