Select Page

এগারো ভাবনার মেট্রোলাইফ

এগারো ভাবনার মেট্রোলাইফ

প্রথম সবকিছুর মধ্যেই একটা আলাদা ফিলিংস থাকে। ডিজিটাল চলচ্চিত্রের সময়ে এসে অমনিবাস ফিল্মের যাত্রা শুরু হলো। ল্যাটিন শব্দ ‘অমনিবাস’ যার সংজ্ঞা দাঁড়ায় বেশকিছু কাজ একখানে করে একটা সেন্টার পয়েন্ট রেখে তার মধ্যে connectivity রাখা। এভাবেই নির্মিত হয় অমনিবাস ফিল্ম। সাহিত্যেও এ ধরণের লেখা আছে। যেমন – মিসির আলি অমনিবাস, হিমু অমনিবাস। ইংরেজি সংজ্ঞায় ‘provide many other things in one’ যার টার্ম ‘anthology film’.

বাংলাদেশে ২০১৯ সালে এসে ইন্ডাস্ট্রি পেলো নতুন কিছু। ইমপ্রেস টেলিফিল্ম প্রযোজিত অমনিবাস ফিল্ম ‘ইতি, তোমারই ঢাকা।‘ নির্মিত হলো ১১ জন তরুণ নির্মাতার মাধ্যমে। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিকভাবেও প্রদর্শিত হয়েছে এবং আরো হবে। ১১ জনের ১১ ভাবনায় connectivity ছিল ঢাকার মেট্রোলাইফ স্টোরি যার মধ্যে উচ্চ-মধ্য-নিম্নবিত্ত তিন স্তরের গল্পই প্রাধান্য পেয়েছে। ভালো-মন্দ মিলিয়ে এক নজরে সেগুলোর দিকে চোখ বুলানো যাক –

সাউন্ডস গুড – গোলাম কিবরিয়া ফারুকী
শব্দের কারসাজি দেখানো এক্সপেরিমেন্ট। মিডিয়ার ভেতরের গল্পকে তুলে ধরা হয়েছে হেডফোনের বিশেষ ব্যবহারে। খালি কানে শোনা আওয়াজ আর হেডফোনে শোনা আওয়াজ দুটি আলাদা ইমেজ তৈরি করে। বাকিটা দর্শকের দেখার উপর ছেড়ে দিতে হবে। শাহতাজ ও তার কো-আর্টিস্ট মোটামুটি অভিনয় করেছে।
চিরকুটের গান ‘তুমি আমি দূরে দূরে ফন্দি আঁটা, শহরের ফাঁকে ফাঁকে গোলাপের কাঁটা’ ভালো ছিল।
রেটিং – ২/৫

জিন্নাহ ইজ ডেড – কৃষ্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়
১৯৪৭-এর দেশবিভাগের পরে বিহারীদের জীবনযাপনের এক টুকরো ছবি দেখানো হয়েছে। সামাজিক স্তরের যত নিচেই থাক নিজের আত্মসম্মানবোধ সবার আছে। নিজের ক্ষমতাকে জানান দিতে সতর্ক থাকে তার সাথে রাজনৈতিক বিষয়ও জড়িত ‘জিন্নাহ’ প্রসঙ্গে যখন দর্শক খেয়াল করবে। বিহারীদের ভাষার ব্যবহার বা অ্যাকসেন্টটা ঠিকমতো আসেনি। এর বাইরে অভিনয় এবং সংলাপ দারুণ।
মোস্তফা মনোয়ার, লুৎফর রহমান জর্জ, ইলোরা গহর সবাই ন্যাচারাল অভিনয় করেছে।
রেটিং – ৩/৫

ঢাকা মেট্রো – মাহমুদুল ইসলাম
সিনেমাটিক স্টোরি। গাড়ির ব্যবসার সিন্ডিকেটকে মাইন্ড গেমে তুলে ধরা হয়েছে। সেরের উপরে সোয়া সের বলা ভালো এক কথায়। দর্শক ইন্তেখাব দিনারের মধ্যে কৌশল শিখতে পারবে খারাপ সিচুয়েশন থেকে বের হয়ে আসার জন্য। শতাব্দী ওয়াদুদের সাথে দিনারের অভিনয়টা জমেছে।
রেটিং – ৩/৫

অবিশ্বাসের ঢাকা – মীর মোকাররম হোসেন
ঢাকার পথেঘাটে ঘটে যাওয়া বাস্তব গল্প। কারো উপকার করতে গেলে নিজের ফেঁসে যাবার সম্ভাবনাই বেশি। উপকার করতে গিয়ে নিজে বিপদে পড়লে বা বিপদে ফেলা হলে দ্বিতীয়বার কেউ উপকার করতে যাবে কি? মনোজ কুমার ভিকটিমের চরিত্রে ভালো অভিনয় করেছে।
রেটিং – ২.৫/৫

ব্যাকগ্রাউন্ড আর্টিস্ট – নূহাশ হুমায়ূন
ক্যামেরার পেছনে যারা কাজ করে তারা যেমন অবহেলিত তেমনি ক্যামেরায় থেকেও তারা এক্সট্রা আর্টিস্ট তাদের প্রতি অবহেলাও একই ধরণের। যত কিছুই করুক না কেন দিনশেষে এক্সট্রা শোনাই তার নিয়তি। গল্পটা সিনেমাটিক ছিল এবং এক প্লট থেকে আরেক প্লটে গিয়েও ফ্লো ধরে রেখেছে। নূহাশ হুমায়ূনের জেনেটিক ট্যালেন্ট তাঁর বাবা হুমায়ূন আহমেদের মতোই প্রকাশ পেয়েছে একটা ডায়লগে-‘আপনি জাঙ্গিয়া পরেন না!’ সেরা ছিল। প্রধান চরিত্রের মোস্তাফিজ নূর ইমরান খুব ন্যাচারাল ছিল আর ফজলুর রহমান বাবু তো সেরাই।
রেটিং – ৩.৫/৫

জীবনের gun – রাহাত রহমান
নামকরণেই ক্রিয়েটিভিটি ছিল। হিউমারাস প্রেজেন্টেশন। সিম্পল ক্রাইম গ্যাং এর গল্প কিন্তু অভিনয় আর ক্লাইমেক্সে উতরে গেছে। অ্যালেন শুভ্রর ক্লোজ শটের কিছু এক্সপ্রেশন মনে রাখার মতো। মুশফিক ফারহান অ্যাজ ইউজুয়্যাল।
রেটিং – ৩/৫

মাগফিরাত – রবিউল আলম রবি
অপেক্ষাকৃত দুর্বল গল্প এবং নির্মাণ। লাস্ট শটে একটা কিছু দেখানোর চেষ্টা ছিল। মিথ্যার বেসাতি দিয়ে জীবন চালানোর ফাঁকে ব্যক্তিগত বিবেক দংশনের চিত্র আছে। শ্যামল মওলার অভিনয় ভালো ছিল।
রেটিং – ২/৫

যূথী – সালেহ সোবহান অনীম
ওয়ান অফ দ্য বেস্ট কাজ। নারীর ক্ষমতায়নকে রাস্তা থেকে গলির ধারের আলোতে সিগনিফাই করে ডায়লগ দিয়ে ঝাঁকিয়ে দেয়া হয়েছে। রওনকের প্রতি সংলাপ তিশার-‘এরপরে রুমের সাথে আমার ভাড়াটাও দিয়ে দিও।’ ব্রেকিং নিউজে ভেসে আসা নারীর ক্ষমতায়নের খবরকে পরিচালক ব্যবহার করেছেন জায়গামতো। আয়নার দিকে তাকিয়ে তিশার টলমল চোখের এক্সপ্রেশন সেরা।
রেটিং – ৩.৭৫/৫

চিয়ার্স – সৈয়দ আহমেদ শাওকী
মেট্রোলাইফের কাপল স্টোরি। রিলেশনশিপের মূল্যায়ন না হলে যে কেউ সাহসী হয়ে উঠতে পারে। যা তার অনুকূলে না তাও করে ফেলতে পারে। স্পর্শিয়ার চরিত্রটি তাই ছিল। তাকে অনেকদূর পর্যন্ত চলে যেতে দেখা যায়। মেয়েদের নিয়ে যে ধারণাগুলো প্রচলিত আছে তা পরিবর্তনের মেসেজ দেয়া হয়েছে। ক্লাইমেক্স অসাধারণ। স্পর্শিয়া চমৎকার অভিনয় করেছে, ইয়াশ রোহান নর্মাল। সেরা ডায়লগ ছিল-‘জেল থেকে পালানো সহজ, আয়নাবাজি দেখিস নাই!’

এম ফর মানি/মার্ডার – তানিম নূর
কর্পোরেট স্টোরি। বলির পাঁঠা হতে হয় উঁচুতলা থেকে নিচুতলা যে কাউকে। হয়ে গেলে পরিস্থিতি কি দাঁড়াতে পারে তারই একটা নমুনা দেখানো হয়েছে। সিম্পল ছিল গল্প ও উপস্থাপনা। ইরেশ যাকের, গাওসুল আলম শাওন ন্যাচারাল অভিনয় করেছে। পাখির একটা ক্লোজ শট দেখার মতো ছিল।
রেটিং – ২/৫

আকাশের পোষা পাখিরা – তানভীর আহসান
অপরাধ, শাস্তি ও ভোগান্তির গল্প। একজন অপরাধ করে আর তার জন্য ভুগতে হয় অনেককে। স্যাক্রিফাইস করতে হয়। টাকার খেলা শুরু হয়। আইনের মারপ্যাঁচের একটা বাস্তবতা গল্পটিকে প্রাণ দিয়েছে। ত্রপা মজুমদার অসাধারণ অভিনয় করেছে। ওয়ান অফ দ্য বেস্ট কাজ।
রেটিং – ৩.৫/৫

প্রত্যেকটি কাজের মধ্যে একটা কমন মিল ছিল কাঁপা কাঁপা ক্যামেরার কাজ যাকে ‘objectify treatment’ বলে। সাদা চোখে হাঁটতে গেলে বা চলাফেরা করতে গেলে আমাদের যে দোলনা অনুভূত হয় সেটাই রাখা হয়েছে যাতে কাজগুলো রিয়েলিস্টিক থাকে। এটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

১১ টি ছবিতে সেন্টার পয়েন্ট মেট্রোলাইফ। নগর জীবনের মানুষের সংগ্রামের অলিগলি দেখানো হয়েছে। গল্প ও উপস্থাপনের ছোটখাটো হেরফের থাকলেও চেষ্টাটা প্রশংসনীয়। এ অমনিবাস ফিল্মটি নির্মাণের পেছনে ‘জালালের গল্প’ ছবির পরিচালক আবু শাহেদ ইমনের নেপথ্য অবদান আছে।

এরপর যত অমনিবাস ফিল্ম হবে ‘ইতি তোমারই ঢাকা’ আসবে ১১ টি লম্বা লেন্থের first reference হিসেবে এটাই এ ছবির বিশেষত্ব এবং এ ধারার ছবির জন্য ইতিহাসের অংশ। ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন এক্সপেরিমেন্ট হতে থাকুক আরো।


মন্তব্য করুন