১৮ টাকার টিকিট ১২০ টাকায় কিনেও পয়সা উসুল ‘বিদ্রোহী কন্যা’
একটা সময় সারা দেশে বাংলা সিনেমা ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী ও জনপ্রিয় বিনোদনের মাধ্যম। মুক্তিযুদ্ধকে বারবার সঠিকভাবে উপস্থাপনা করার সার্থক মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে বড়পর্দাকে। এর কারণ হলো তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে ধারণা দেওয়া এবং মুক্তিযুদ্ধের মূল ৪টি নীতিতে উদ্বুদ্ধ করা।
এবার ‘বিদ্রোহী কন্যা’র কথায় আসি। আজকের যারা হলে যায় তারা ‘মাল্টিস্টার’ বা ‘তারকাবহুল’ বাংলা সিনেমার সঙ্গে পরিচিত কিনা আমার জানা নেই। অথচ আমাদের সময়ে ‘তারকাবহুল’ সিনেমা ছিলো ডালভাতের মতো। প্রতি সপ্তাহেই এমন সিনেমা মুক্তি পেতো আর ঈদ এলে তো কথাই নেই, তারকাবহুল সিনেমায় ঠাসা থাকতো তালিকায়। আজ ঈদে সর্বসাকুল্য ৩টি সিনেমা মুক্তি পায় তাও আবার সেটা একই নায়কের দুটি আর অফট্র্যাকের একটি সিনেমা মিলে, কী তামাশা!
১৯৯৬ সালের ঈদে দারুণ দারুণ সব সিনেমার ভিড়ে মুক্তি পায় ‘বিদ্রোহী কন্যা’। ঈদের তৃতীয় দিনে মনিকা হলে সকালের শোতে হাজির হয়েছিলাম আমরা কয়েক বন্ধুরা। হলের সামনে যাওয়ার আগেই দেখতে পেলাম আমাদের বয়সী শত শত পোলাপানের ভিড় আর জটলা। হলের সামনে গিয়ে পুরা তব্দা খেয়ে গেলাম দর্শকদের ভিড় দেখে। মনে হলো, পুরো সিলেটের সব ১৫ থেকে ২৫ বছর বয়সী ছেলেরা মনিকার বাহিরের চত্বর দখল নিয়ে ফেলেছে। এই সিনেমা দেখতে যদি এতো ভিড় হয় তাহলে অন্য হলগুলোতে যেখানে সালমান শাহ, ওমর সানীর সিনেমা চলছে সেখানে কী অবস্থা চিন্তা করছিলাম। ভিড় দেখে কাউন্টার থেকে টিকিট কেনার চেষ্টা বাদই দিলাম। কালো বাজারে ব্ল্যাকাররা দাম এমন চড়া করে ফেললো যে ধরেই নিলাম আজ একটা মারামারি লাগবে, তার আগেই টিকিট কেটে হলের ভেতরে ঢুকে যেতে হবে। ১৮ টাকা দামের টিকিট ১২০ টাকা করে কিনে আমরা হলে ঢুকে গেলাম, এবার মারপিট হলেও কোন সমস্যা নাই।
হলের ভেতরে দেখি, বাহিরে যত লোক রেখে এসেছি ভেতর ঠিক যেন তার চেয়েও বেশি মানুষ। সিট নিয়ে কাড়াকাড়ি, হাতাহাতি অবস্থা। কোন রকমে অনেক কষ্টে ডিসির বাঁ পাশের একদম উপরের সারির কোনায় আমরা ৬ জন আসন পেলাম।
সিনেমার গল্প শুরু মুক্তিযুদ্ধের সময়কারের ঘটনা নিয়ে। রাজীব থাকে রাজাকার আর মাহমুদ সাজ্জাদ (শাবানার বাবা) মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধ শেষে দেশ স্বাধীন হলে রাজিব বিজয় মিছিলের সামনে থেকে মুক্তিযোদ্ধা হয়ে যায় এবং ‘শীতল পার্টি’ নামের রাজনৈতিক দলের প্রধান হয়ে রাজনীতি করা শুরু করে।
রাজনীতির আড়ালে রাজিব চোরাকারবারি ও লুটপাট শুরু করে যা পুলিশ অফিসার মাহমুদ সাজ্জাদ মেনে নিতে পারে না। রাজিবকে গ্রেপ্তার করেও সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে শাস্তি দিতে পারে না। রাজীব ছাড়া পেয়ে মাহমুদ সাজ্জাদ ও তার স্ত্রীকে খুন করে। কিশোরী শাবানা ছোট ছোট দুই ভাইকে নিয়ে ঢাকায় চলে যায়। এরপরের গল্পটা জুড়ে শুধু শাবানা, ইলিয়াস কাঞ্চন ও রুবেলকে ঘিরে। বারবার গল্পের মোড় পাল্টে গিয়ে রোমাঞ্চকর উত্তেজনায় ঠাসা, পুরোটা সময় যেন দর্শকের চোখ পর্দা থেকে সেকেন্ডের জন্যও সরানোটা ছিল অসম্ভব।
গল্পের নাটকীয়তা ও টুইস্ট ছিল চরম। বিশেষ করে দুই ভাই ইলিয়াস কাঞ্চন ও রুবেলের মধ্যকার দ্বন্দ্ব ও বড় বোন শাবানার ভুমিকটা ছিল চরম। পুরো সিনেমা শেষ না করে উঠতে পারবেন না। সবচেয়ে মজার ব্যাপার ছিল, কিছুক্ষণ পরপর একেকটা দৃশ্য ও সংলাপের সঙ্গে সঙ্গে পুরো হলের দর্শক করতালি দিচ্ছিল।
শাবানা, ইলিয়াস কাঞ্চন, রুবেল ও রাজীবের মতো তারকারা যে সিনেমা জুড়ে আছে সেই সিনেমার অভিনয়ের লড়াইটা কী রকম হতে পারে তা সেদিনের দর্শক ব্যতীত অন্য কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। পরিচালক সোহানুর রহমান সোহান সেই সময় দর্শকদের কাছে এমনিতেই একটা ব্র্যান্ড হয়েছিলেন; তার সঙ্গে যদি প্রথম সারির বড় বড় তারকারা সিনেমায় থাকে তবে ১০০ গুন বেশি দিয়ে টিকিট কেটে দেখলেও আফসোস হবে না, সেটা সেই সময়ের দর্শক জানতো। প্রচন্ড গরমে ঘামে ভেজা শার্ট গায়ে প্রায় ৩ ঘন্টার মতো সময় কখন যে কেটে গিয়েছে টেরই পাইনি আর যখন পেলাম তখন ‘ইশ! সিনেমাটা আরেকটু লম্বা হলে ভালো হতো’ বলে আফসোস করলাম। কী অদ্ভুদ সুন্দর একটা সময় ফেলে এসেছি আমরা তা এই প্রজন্ম কিছুতেই বুঝবে না, বোঝানোর ভাষাও আমাদের নেই।