ফিরে দেখা ২০১০-১৯: নাটকে আলোচিত দশ অভিনেতা
টিভি নাটকে বিভিন্ন সময়ে অভিনয়গুনে আমাদের মুগ্ধ করে গেছেন অভিনেতারা। ভালো ভালো কাজ করে নিজেরা হয়েছেন দর্শকপ্রিয়,তাদেরকে আপন করে নিয়েছেন। এক সময় আমাদের টিভি মিডিয়ায় অভিনয় দিয়ে মন জয় করে নিয়েছিলেন আসাদুজ্জামান নূর, আফজাল হোসেন, জাহিদ হাসান, তৌকীর,মাহফুজরা। সময়ের বহমানে তাদের কেউ অভিনয়ে আছেন কিংবা অনিয়মিত হয়ে গেছেন। তাদের ই পদাঙ্ক অনুসরন করে এই দশকে এসে কারা কারা আলোচিত অভিনেতা হয়েছে দেখা যাক-
১. মোশাররফ করিম: টিভি নাটকের ইতিহাসে তিনি সেরা জনপ্রিয় অভিনেতাদের একজন। গত দশকে যে জয়রথের সূচনা করেছিলেন সেটার লাগাম এই দশকেও তিনি বেশ ভালোভাবেই ধরে রেখেছিলেন। একদিকে এফ এন এফ,মাইক,হাড় কিপ্টের মত জনপ্রিয় ধারাবাহিক নাটক অন্যদিকে পিন্টু- মিন্টু সিরিজ,সিকান্দার বক্স ও যমজ সিরিজে অভিনয় করে নিজের জনপ্রিয়তা আরো বহুগুণ বাড়িয়েছেন। তবে অতিরিক্ত নাটকে অভিনয়,নাটক নির্বাচনে অসচেতনতা,জনপ্রিয়তা পাওয়া সিরিজগুলোর দীর্ঘসূত্রিতার কারনে দর্শকরা হতাশ হয়েছেন। তবে এর মাঝেও বেশ সংখ্যক ভালো নাটকে অভিনয় করেও তিনি প্রত্যাশা মিটিয়েছেন। এই দশকে তাঁর আরো উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে দ্য জেন্টলম্যান, দানব, ইউনিভার্সিটি, চুপ! ভাই কিছু বলবে, সেই রকম চা খোর, লং মার্চ, জর্দা জামাল, সাদাসিধে মানুষের গল্প অন্যতম। এছাড়া বেশ কয়েকটি সিনেমাতে অভিনয় করে প্রশংসিত হয়েছেন। সম্প্রতি কৌতুক অভিনয়ের জন্য প্রথমবার জাতীয় পুরস্কার পেলেও তিনি গ্রহণ করেননি।
২. আফরান নিশো: ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে ব্রাত্য থেকে গেলেও মিউজিক ভিডিওর কল্যানে তিনি সবার নজরে আসেন। টিভি নাটকে ফুলমতি,আয়নারহস্য,স্বপ্নকুহক,আগুন্তক,এই শহরে,প্রতীক্ষা,ট্যাটু,কমলা সুন্দরী,লালাই,ফেরার পথ নেই সহ বিভিন্ন নিরীক্ষাধর্মী কাজ করে সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছিলেন, পাশাপাশি ‘বুকের বাঁ পাশে’ তে অভিনয় নিজের জনপ্রিয়তা দ্বিগুণ করেছেন। তবে সাম্প্রতিক কালে তিনিও নাটক নির্বাচনে হতাশ করেছেন দর্শকদের,একটা নির্দিষ্ট মহলে তিনি আবদ্ধ থাকছেন এই অভিযোগ অনেকের। এছাড়া হোম টিউটর, তুমি না থাকলে, প্রশংসায় পঞ্চমুখ, শাড়ী, উচ্চতর হিসাববিজ্ঞান, লাইফ এন্ড ফিওনা অন্যতম উল্লেখযোগ্য কাজ।
৩. অপূর্ব: গত দশকেই নবীন থাকাকালীনই তারুণ্যনির্ভর বেশ জনপ্রিয় হয়েছেন এই অভিনেতা,তবে মাঝে আলোচনার বাইরে চলে গেলেও আবার দারুণ প্রত্যাবর্তন করেছিলেন ‘বড় ছেলে’ টেলিফিল্ম দিয়ে। বড় ছেলের মত সাফল্য এই দশকে আর কোনো নাটক ই পায় নি,তবে একই ঘরানায় আবদ্ধ থাকায় তিনি এই জনপ্রিয়তা আরো দারুণভাবে সাজানোর কথা থাকলেও এই মুহুর্তে পারছেন না। নিজের ঘরানার বাইরে গিয়ে ‘মার্চ মাসে শূটিং’ এ দারুন অভিনয় করেছিলেন।তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে ইন এ রিলেশনশিপ, ব্যাচ ২৭ সিরিজ, বিনি সুতোর টান, উৎসর্গ ,নীল প্রজাপতি, ছোট্ট পাখির বাসা, বাইশে এপ্রিল ,লাইফ ইনন্সুরেন্স অন্যতম।
৪. তাহসান: সঙ্গীত জগতে বিচরণ করা এই গায়ক এই দশকে হয়ে উঠেন অন্যতম জনপ্রিয় অভিনেতা। আগে শখের বসে অভিনয় করলেও আমাদের গল্প, মন ফড়িঙের গল্প, মনসুবা জংশন, নীলপরী নীলাঞ্জনা, ল্যান্ডফোনের দিনগুলিতে প্রেমের তুমুল সাফল্যে অভিনয় জগতে মনোনিবেশ করেন। যদিও সর্বমহলে তাঁর অভিনয়ের গ্রহণযোগ্যতা তুলনামূলক কম,অন্যদিকে ভক্তের সংখ্যাও অধিক। নাটক নির্বাচনে আরো সচেতনতা থাকলে অভিনয়ের ক্যারিয়ার আরো সমৃদ্ধ হত। একটি সিনেমাও করেছেন,সম্প্রতি আরেকটি সিনেমায় চুক্তিবদ্ধ হয়ে আলোচিত হয়েছেন।
৫. চঞ্চল চৌধুরী: একের পর এক সিনেমা করে তিনি এই দশকে চলচ্চিত্রঅঙ্গনে বেশি আলোচিত ছিলেন,জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন। পাশাপাশি গত দশকের মত টিভি নাটকেও সমুজ্জ্বল ছিলেন। সাম্প্রতিক কালে ‘কিংকর্তব্যবিমূঢ়’ এ অভিনয় বেশ প্রশংসিত হয়েছেন,শুরুর দিকে সার্ভিস হোল্ডার, জামাই মেলা, হাড় কিপ্টে, অলসপুর, ইডিয়ট সহ বেশ সংখ্যক নাটকে অভিনয় করে আলোচিত ছিলেন। তবে সিনেমার মত নাটকে উনার আরো বৈচিত্র্যময় কাজ দর্শকরা প্রত্যাশা করেন।
৬. জাহিদ হাসান: টিভি নাটকের সবচেয়ে জনপ্রিয় অভিনেতা হিসেবে খ্যাত তিনি, সেই নব্বই দশক থেকেই তিনি সমানতালে কাজ করে যাচ্ছেন। এই দশকের শুরুতেই গ্র্যাজুয়েট ও আরমান ভাই সিরিজ করে নিজের জনপ্রিয়তা আরো বাড়িয়ে নিয়েছিলেন,দর্শকরাও খুশি ছিলেন। তবে গত কয়েক বছর ধরেই তিনি হতাশ করে যাচ্ছেন,কাজ করছেন ঠিকই কিন্তু কোনোটাই দর্শকদের মুগ্ধ করতে পারছে না। নিজেকে এর থেকে উত্তরন করা জরুরি। অন্যদিকে সিনেমায় অভিনয় করে দ্বিতীয়বারের মত জাতীয় পুরস্কার পেতে যাচ্ছেন।
৭. মাহফুজ আহমেদ: গত দশকের শীর্ষ এই জনপ্রিয় অভিনেতা এই দশকে নির্মাতা হিসেবে বেশি ব্যস্ত ছিলেন,তবে অভিনয় কম করলেও প্রশংসার ভার বেশি। নিজের পরিচালনায় ‘চৈতা পাগল’ ধারাবাহিকে নাম ভূমিকায় অভিনয় করে নিজেকে আরো সমৃদ্ধ করেছেন,বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল এই নাটকটি। এছাড়া হ্যালো বাংলাদেশ, লাইক এন্ড কমেন্টস, চলমান ছবি, মায়ের কাছে যাবো, ওগো বধূ সুন্দরী, তুমি থাকো সিন্ধুপাড়ে, ক্রাইম রিপোর্টার, পিতৃদায়, জলতরঙ্গ তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজ। সিনেমায় অভিনয় করে দ্বিতীয়বারের মত জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন।
৮. পার্থ বড়ুয়া: গানের জগতের মানুষ,বিখ্যাত সোলস ব্যান্ডের সবচেয়ে জনপ্রিয় তারকা। শখের বসে টিভি নাটকে অভিনয় করেন,তবে নাটকের মান ভালো থাকায় দর্শকরা পছন্দ করেন, অভিনয়টা ভালো করেন। তাঁর অবাক ভালোবাসায়,খুঁটিনাটি খুনসুটি ও মেড ইন চিটাগাং সিরিজ দর্শকদের অতি পছন্দের,জনপ্রিয় ধারাবাহিক ‘এফ এন এফ’ তেও তিনি ছিলেন। এছাড়া আলো, হাইওয়ে টু হেভেন, পোস্টমর্টেম, এ জার্নি বাই বোট, তোর জন্য প্রিয়তা নাটক দিয়ে নিজেকে পরিক্ষীত করেছেন।
৯. জন কবির: এক সময় গান করতেন,তবে এই দশকে অভিনয়েই বেশি নিয়মিত ছিলেন। বিশেষে দিবস এলেই টিভিতে তাঁর অভিনীত নাটক সবার নজরে পড়ে,নাটকের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। সবচেয়ে আলোচিত হয়েছেন লাইক এন্ড শেয়ার ও এক্স ওয়াই যেড সিরিজে অভিনয় করে, পাশাপাশি আমি আকাশ পাঠাবো, অত:পর, হেট হউ, সব মিথ্যে সত্যি নয়, আমরা ফিরবো কবে ,অ্যাডিকশন, কানামাছি ভোঁ ভোঁ, অ্যাওয়ার্ড নাইট সহ বেশিকিছু নাটকে অভিনয় করে আলোচিত হয়েছেন,তবে সম্প্রতি অভিনয় একেবারেই কমিয়ে দিয়েছেন।
১০. ইরেশ যাকের:বিখ্যাত দম্পতি আলী যাকের- সারা যাকেরের সন্তান এই অভিনেতা,বাবা- মায়ের ছায়া ছাপিয়ে স্বাতন্ত্র্য হয়ে উঠেছেন। অভিনেতা হিসেবে তিনি দর্শক নন্দিত,অহরহ নাটক ও করেন না। যেকোন চরিত্রেই তিনি নিজেকে মানিয়ে নেন। একক অভিনেতা হিসেবে উল্লেখযোগ্য কাজ কম হলেও তারকাবহুল নাটকে ঠিকই নিজেকে উজ্জ্বল করে তোলেন। সাম্প্রতিককালে ‘২২শে এপ্রিল’ সেটার উদাহরণ হয়ে থাকবে। এছাড়া উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে আমাদের গল্প, ভালোবাসি তাই ভালোবেসে যাই, তুমি না থাকলে, ভালোবাসার পংক্তিমালা, পাঞ্চ ক্লিপ, কেউ নয় শূন্যতা, কবির জন্য পাত্রী খোঁজা হচ্ছে অন্যতম। এছাড়া সিনেমায় অভিনয় করে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন।
*বিশেষ:
১. রওনক হাসান: দ্বন্ধ সমাস ,রাতারগুল, আমাদের গল্প নাটকগুলোতে অভিনয় করে দেখিয়ে দিয়েছেন ঠিকঠাক ভাবে ব্যবহার করলে তিনি কতটা প্রতিভাবান হয়ে উঠতে পারেন,দারুণ প্রশংসিত হয়েছিলেন। ‘নোয়াশাল’ ধারাবাহিক নাটকে অভিনয়ে ব্যস্ত ছিলেন। সুপ্রতিষ্টিত নির্মাতাদের তাঁর প্রতি আরো সৃদৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন।
২. অ্যালেন শুভ্র: তরুন তুর্কিদের মাঝে যেমন তিনি আশার সঞ্চার করেছিলেন,তেমনি আফসোসের নাম। বিকেল বেলার পাখি, কেবলই রাত হয়ে যায়,হলুদ, @18 অলটাইম দৌড়ের উপর, কিকঅফ, ইউনিভার্সিটি নাটকগুলোতে তাঁর দারুণ অভিনয় দেখে সবাই প্রশংসা করেছিলেন,বেশ আলোচিত হচ্ছিলেন। তবে ব্যক্তিগত অসচেতনতার কারনে তিনি এখন অগোচরেই। দর্শকরা চাইছে একটা সফল প্রত্যাবর্তন ঘটুক।
৩. শহীদুজ্জামান সেলিম: চলচ্চিত্র কিংবা নাটকে এই দশকে নিজেকে আরো নন্দিত করেন স্বনামখ্যাত এই অভিনেতা। লীলাবতী, জং কুটুম্বপুর, ভালোবাসি তাই, ইনসমনিয়া, রিল্যাক্স বস, ব্রেকিং নিউজ, বাবার জুতা সহ বিভিন্ন নাটকে অভিনয় করে আলোচিত হয়েছেন। চলচ্চিত্রেও পেয়েছেন দুইবার জাতীয় পুরস্কার।
৪. ফজলুর রহমান বাবু: চলচ্চিত্রের জন্য বেশি আলোচনায় ছিলেন,দুইবার জাতীয় পুরস্কার ও পাচ্ছেন।পাশাপাশি টিভি নাটকেও ছিলেন নিয়মিত। উনার অভিনয়ের প্রশংসা সর্বজনবিদিত,এই দশকে এসে বিকেল বেলার পাখি, মায়া, গল্পের ইলিশ, কবিরাজের বউয়ের একটি ছেলে বন্ধু ছিল, মাটির মানুষ সহ বেশ সংখ্যক নাটকে অভিনয় করেছেন।
৫. শ্যামল মাওলা: প্রতিভাবান হলেও কিছু অভিনেতা অগোচরে থেকে যান তিনি তাদের মত একজন। দর্শকরা চান তিনি যেন আরো ভালো ভালো নাটকে অভিনয় করুক। সাম্প্রতিক কালে ‘অন্ধকার ঢাকা’ সমালোচিত হলেও তাঁর অভিনয় সমাদৃত হয়েছে। এছাড়া উল্লেখযোগ্য নাটক জীবন সঙ্গী,স্বপ্ন দেখি আবারো, কাকতাড়ুয়া, লিফলেট, মাধবীলতা অন্যতম। তবে সাম্প্রতিক কালে একটি সমালোচিত শর্টফিল্মে অভিনয় করেছেন।
*প্রতিশ্রুতিশীল অভিনেতা:
১. মনোজ কুমার: মুগ্ধ করা ভালোবাসার নাটক ‘কথা হবে তো?’ তে তাঁর অভিনয়ে সবাই পছন্দ করেছিলেন এছাড়া ফুল ফুটানোর খেলা, বেস্ট ফ্রেন্ড ২ ,বিয়ের দাওয়াত রইলো,শহরে নতুন গান সহ অনেক নাটকে অভিনয় দেখে অনেকেই ভাবছেন তিনি হয়ে উঠবেন ভবিষ্যতের টিভি নাটকের একজন অন্যতম জনপ্রিয় অভিনেতা। প্রত্যাশা রইলো তিনি নিজেও সেই লক্ষ্যে অটুট থাকবেন।
২. ইয়াশ রোহান: নরেশ ভূঁইয়া ও শিল্পী সরকার অপু দম্পতির এই সন্তান সাম্প্রতিক কালে ‘আমাদের সমাজবিজ্ঞান’ টেলিফিল্মে দারুণ অভিনয় করে প্রশংসিত হয়েছেন। এছাড়া চাকা, মিস শিউলি, আগুন্তক, বিবাহ বিভ্রাট নাটকে তাঁর প্রানবন্ত অভিনয়ে সবাই আস্থা রাখছেন। সিনেমাতেও রেখেছেন প্রতিভার ছাপ।
৩. জোভান: ইউনিভার্সিটি, ঝালমুড়ি, লাল রঙা স্বপ্ন থেকে মায়া, মোমেন্টস শর্টফিল্মে অভিনয় করে তরুন তুর্কি হিসেবে বেশ আলোচনায় এসেছিলেন,তবে সেই আকর্ষনীয় ভাব টা ম্লান হয়ে গিয়েছিল। ব্রেস্ট ফ্রেন্ড সিরিজ,নো ওয়ে আউট নাটকের মধ্য দিয়ে আবার আলোচিত হয়েছেন। নিজের উত্তরন ঘটিয়ে আরো জনপ্রিয় হবেন এই প্রত্যাশা করাই যায়।