ইতি, তোমারই ঢাকা – মহানগরীতে জীবনের খণ্ড খণ্ড চিত্রের চমৎকার সমন্বয়
(দেশে মুক্তির আগে বিদেশের বেশ কিছু উৎসবে অংশ নেয় ‘ইতি, তোমারই ঢাকা‘। এর একটি লন্ডন ইন্ডিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। সেখানে ছবিটি দেখে হাইঅন ফিল্মসের জন্য রিভিউ করেন শুভ পাইন। তার অনুবাদ উপস্থাপন করা হলো।)
★★★
ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী। বিশ্বের অন্য যে কোন শহরের মত, ঢাকাতেও জীবন ও গল্পের ক্যানভাস বুনন হচ্ছে। এই অমনিবাস ছবিটি ঢাকার কয়েকটি জীবন ও গল্পকে কেন্দ্র করে বর্ণিত শহরের আধ্যাত্মিকতার গাঁথা।
অন্যান্য একাধিক-গল্পের চলচ্চিত্রের মত এই চলচ্চিত্রের গঠনেও সুবিধা ও অসুবিধা দুই’ই বিদ্যমান ছিল। একাধিক গল্প থাকার কারণে একটি গল্প খুবই ভালো আবার আরেকটি প্রথমটির চেয়ে কিছুটা কম ভালো। এই ধরনের চলচ্চিত্রে সবকয়টি গল্প একই রকমভাবে আকর্ষণ ধরে রাখতে পারে তা বিরল।
অমনিবাস চলচ্চিত্রে একাধিক পরিচালক থাকার কারণে একটি সাধারণ সমস্যা হলো গল্পগুলোকে একত্রে ধরে রাখা। “ইতি, তোমারই ঢাকা”-এর ক্ষেত্রে গল্পের কেন্দ্রবিন্দু হলো ঢাকা শহর। সবকয়টি গল্প এই বিষয়বস্তুকে প্রতিবিম্বিত করতে পারেনি এবং কয়েকটি বাকিগুলোর সাথেই তুলনায় পিছিয়ে পড়েছে।
দ্য ব্যাকগ্রাউন্ড আর্টিস্ট: এটি প্রথম খণ্ড এবং এই চলচ্চিত্রের একটি দুর্দান্ত সূচনা। গল্পটি একজন ব্যাকগ্রাউন্ড/জুনিয়র আর্টিস্ট বা অভিনেতাকে কেন্দ্র করে, যিনি চলচ্চিত্রশিল্পে একজন অতিরিক্ত শিল্পী হিসেবে কাজ করেন। এই খণ্ডটি হাস্যরস এবং শহরের আনন্দ ও সংস্কৃতিতে পরিপূর্ণ। এটি সুন্দর সমাপ্তি নিয়ে আত্ম-সচেতন একটি খণ্ড, যা চলচ্চিত্রটিকে ভালো সূচনা এনে দিয়েছে।
চিয়ার্স: পরবর্তী খণ্ডটিও হতাশ করেনি। দুটি তরুণীর একজনের ব্রেকআপ হওয়ার পর তারা শহরের একটি বারে মদপান করতে যান। কিন্তু এই শহরে নারীর মদপানকে মন্দ চোখে দেখা হয়। এই খণ্ডের স্বল্প পরিসরে, সমাজে বিদ্যমান নারীপুরুষের বৈষম্যকে তুলে ধরা হয়েছে। পরিমিত অভিনয় ও সুন্দর পরিচালনা এই খণ্ডটিকে এই চলচ্চিত্রের অন্যতম সুন্দর অংশ করে তুলেছে।
মাগফিরাত: এটি ১১টি খণ্ডের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। এটি এই শহরে বসবাসরত একজন আম-আদমির গল্প। এতে দক্ষতার সাথে সুক্ষ্ম রূপকের সমন্বয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও হতাশার চিত্র বর্ণিত হয়েছে। এতে কীভাবে একজন ব্যক্তিকে একটি বড় শহরে মানিয়ে চলতে হয় তা প্রতিফলিত হয়েছে, বিশেষ করে যখন সেই ব্যক্তিটি যদি কোন বড় শহরের না হয়ে থাকেন। পরিচ্ছন্ন সম্পাদনা এর প্রভাবকে ফুটিয়ে তুলতে সাহায্য করেছে এবং বাকিগুলো থেকে আলাদা করেছে।
হোয়্যার, নোহোয়্যার: এই খণ্ডটি কিছুটা তালগোল পাকিয়েছে। দুজন মুখ্য চরিত্রের কারো প্রতিই মনোনিবেশ করতে পারেনি। তবুও এই খণ্ডে ঢাকাই জীবনের সমস্যা জর্জরিত চিত্র ফুটে ওঠেছে।
এম ফর মার্ডার/মানি: নাম থেকে ধারণা করা যায় যে এটি অ্যালফ্রেড হিচককের থ্রিলার চলচ্চিত্র ‘ডায়াল এম ফর মার্ডার’-এর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রদর্শন, কিন্তু আদতে এটি আপনার দেখা থ্রিলার বা অপরাধ-নাট্যধর্মী চলচ্চিত্রের নতুন নির্মাণ নয়। এছাড়া ঢাকা শহরও এতে বিদ্যমান নয়। গল্পটি কানেটিকাট শহরের প্রেক্ষাপটে হতে পারত।
জিন্নাহ ইজ ডেড: এই খণ্ডটি ঢাকা শহর ও বাংলাদেশের ইতিহাস ও রাজনীতির সাথে সম্পর্কিত। ঢাকায় একটি নির্দিষ্ট অংশের জীবনের বিভাজন সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ভারতের বিহার থেকে আগত নিম্নবিত্ত মুসলমানদের জীবনযাত্রা এই খণ্ডের আলোচ্য বিষয়, যারা ভারত বিভাগের পর ঢাকার নিম্নশ্রেণীয় এলাকায় বসতি স্থাপন করে এবং পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশ হয়ে যাওয়ার পরও যাদের হেয় করে দেখা হয়। কিন্তু এই খণ্ড নিয়ে অভিযোগ হলো এতে সূক্ষ্মভাবে নির্দিষ্ট একটি বিষয়বস্তু ফুটে ওঠেনি।
যুথি: যুথি আগ্রহ তৈরিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ, যা সামগ্রিকভাবে এই চলচ্চিত্রে প্রভাব ফেলে। ‘চিয়ার্স’ খণ্ডের মত এই খণ্ডের মূল বিষয়বস্তু হল সমাজে বিদ্যমান পুরুষতান্ত্রিকতা ও নারী-পুরুষের মধ্যকার যৌনপ্রাধান্য। কিন্তু এতে ‘চিয়ার্স’-এর মত হাস্যরস ছিল না এবং বেশিরভাগ সময়ই মূল বিষয়বস্তু থেকে দূরে সরে গেছে। ফলে এই খণ্ডটিকে সফল বলা যাবে না।
মাগফিরাত, ব্যাকগ্রাউন্ড আর্টিস্ট ও চিয়ার্সের মতো সফল কয়েকটি অংশ নিয়ে “ইতি, তোমারই ঢাকা” যথেষ্ট সুন্দর একটি অমনিবাস চলচ্চিত্র।