বসগিরি : দিশাহীন অনুভূতি !
গেলাম, দেখলাম, উঠে এলাম!!! মাঝ দিয়ে কিছু সময় চলে গেল। কথায় আছে সময় ও নদীর স্রোত কোনদিন কারো জন্য অপেক্ষা করে থাকে না। শুধু স্মৃতি হয়ে রয়ে যায়। আমার স্মৃতির মণিকোঠায় ‘বসগিরি’ও আপন মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে থাকবে আজীবন। কী পেলাম বা কী পেলাম না মাঝে মাঝে সে হিসেব যেন খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে। যখন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র একটু একটু করে আলোর মুখ দেখে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে তখন উন্নতির কোনো লক্ষণ না চোখে পড়লে, সেখানে স্থির হয়ে থাকবার আশঙ্কা মনে দানা বাধবে এটাই স্বাভাবিক।
আমি কেউ না, কিছু না। সিনেমা নিয়ে বলার মতো হয়তো যোগ্যতাও আমার নেই। কারণ এখন কিছু লিখতে গেলেই এসে বলবে— ভাই আপনি নিজে পারলে বানিয়ে আনেন। আসলে সমস্যা আমাদের পরিচালকদের যেমন আছে, সমস্যা স্ক্রিপ্টেও আছে। তবে সমস্যা আরো প্রবল হয় তখনই যখন একইভাবে স্ক্রিপ্ট ও পরিচালনা দুটোরই ঘাটতি দেখা যায়। ‘বসগিরি’ ঠিক তেমন একটি সিনেমা। যেখানে রয়েছে সেই পুরনো ফ্ল্যাট কাহিনী আর বাজে ডিরেকশনের পুনরাবৃত্তি।
‘বসগিরি’র কাহিনী নিয়ে আমি তেমন কিছু বলতে যাচ্ছি না, জাস্ট এটাই বলব অত্যন্ত নিম্নমানের একটি স্ক্রিপ্ট। হাসানোর চেষ্টা করা হয়েছে তাও জোর করে। মনে হচ্ছে সুড়সুড়ি দিয়ে আপনাকে হাসানোর চেষ্টা! ২০১৬ সালে এসে যদি মেয়ে পটানোর কাহিনী দেখতে হয়, তাহলে আমি বলব এর থেকে বাসায় বসে টেলিফিল্ম দেখা অনেক ভালো।
কাহিনীর কথা ছাড়ুন, ঐসব বলে আর কোন লাভ নেই আমাদের। কারণ আমাদের পরিচালক-প্রযোজক এসবের ধার ধারেন না। তাদের মতে, ফেসবুকের আলোচনা সিনেমার ক্ষেত্রে তেমন কোনো প্রভাব ফেলে না। সিনেমা হিট করাতে হলে কাকরাইল পাড়াকে খুশি রাখতে হবে। আপনার কাছে একটা বাজে ডিরেকশনও উপভোগ্য হতে পারে যদি কাহিনীতে ভালো মশলা থাকে।
‘বসগিরি’ এতো আলোচনায় থাকার মূল কাহিনী ছিল ‘শাকিব খান’। ‘শিকারি’র পর তার নতুন আগমনের বার্তা দেখে আমাদের মতো অনেকে খুশি হয়েছিলেন কিন্তু আবার তিনি হতাশ করলেন। আসলে শাকিব খান সত্যিকারার্থে নিজের মেধার অবমূল্যায়ন করছেন। তিনি নিজেও হয়তো জানেন না, তিনি কত ভালো নাচতে পারেন। একবার তিনি তার স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিয়ে নিজে নেচে সেই দৃশ্য নিজে মনিটরে দেখুক তাহলে বুঝবেন কী করে তিনি নিজেকে শেষ করছেন। পুরো সিনেমায় শাকিব খানের অভিনয় ছাড়া আর কিছু পেলাম না। আমার মনে হয় তাকে ডিরেকশন না দিলে ভালো অভিনয় করবেন। অ্যাকশন আর অভিনয়ে বেশ ভালো করেছেন। তবে ঐ যে বললাম তিনি আসলেই নিজেকে ধ্বংস করছেন। নিজেকে নিয়ে তার ভাবা উচিত।
নবাগত বুবলি, কী বলব তাকে নিয়ে! আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে এখন নায়ক বা নায়িকা হওয়া রীতিমত আলাদিনের জাদুর প্রদীপের মতো। হুট করে একজন চলে এলো আর হয়ে গেল। প্রদীপে ঘষাঘষিও লাগে না। হাসি, কান্না, আনন্দ, রাগ সবসময় একই এক্সপ্রেশন। ব্যথা পেলেও যে সুরে কথা বলে রাগলেও সেই সুরে কথা বলে! মনে হচ্ছে আমি একটা রোবট দেখছি। তাকে আসলেই অনেক পরিশ্রম করতে হবে।
আর অন্য চরিত্রগুলোর মাঝে শুধু সাদেক বাচ্চু ভালো করেছেন। অপ্রিয় হলেও সত্য কথা কি জানেন! আমাদের সিনিয়র শিল্পীরা ইদানিং কেন জানি তেমন সুযোগও পাচ্ছে না অভিনয় করার। ফলে তাদের মেধার কোনো মূল্যায়ন হচ্ছে না। বাকি চরিত্রগুলোতে নাকি এক-একজনের চরিত্র এক একটা বিখ্যাত (ভারতীয়) সিনেমা থেকে নেওয়া হয়েছে। আচ্ছা ভাই, আমাকে বলেন তো একথা কি কোথায়ও লেখা আছে যে ওই সিনেমা থেকে আপনাকে চরিত্র নিতে হবে? ঠিক আছে আপনি চরিত্র নিলেন কিন্তু আমাকে বুঝান চিকন আলী কেন সারাদিন রেডিও নিয়ে ঘুরবে? একবারও তো রেডিও শুনতে দেখলাম না? ধানুশের ‘মারি’র লুক দিয়ছেন শাকিব খানকে। তাও মানলাম, কিন্তু পাতার বিড়ি নিয়ে ৪টা দৃশ্য করল, মাত্র একবার বিড়িটা ধরালো আর অন্য ৩টা দৃশ্যতে বিড়িটা না ধরিয়ে মুখে নিয়ে কথা বলল। তাহলে বিড়িটা মুখে দেওয়ার কী দরকার? অমিত হাসান তো ভ্যাপার মুখে নিয়ে সংলাপ বলছিলো সাথে সেইটা টেনে ধোঁয়াও ছাড়ছিল। তাহলে শাকিব খানের ঐ ৩ সময় কেন আগুন না ধরিয়ে বিড়ি মুখে নিয়েই ডায়লগ দিল?
বুবলি একজন ইন্টার্ন ডাক্তার, আর সে কি একজন এআরসিএস ডাক্তারকে রোগীকে ড্রেসিং করার অর্ডার দিতে পারে? ভাই এইটা কি সার্কাস? সব জায়গায় তো গাঁজাখুরি জিনিস চলে না। আপনি মাথা দেওয়া আঘাত করে ফাটাবেন কিন্তু দেওয়ালে রক্ত লাগবে না, আমার ড্রেসিং করবেন কিন্তু রক্ত তুলাতে লাগবে না, এইটা কী ধরনের অবস্থা? উইগ পড়াবেন সেখানে আবার অরিজিনাল চুল বের হয়ে থাকবে এইটা কি সম্ভব? রজতাভ দত্তের মতো অভিনেতা এখানে টেনে এনেছেন তাও ডাবিং তিনি নিজে করেননি। তাহলে এমন অভিনেতা বাইরে থেকে আনার কী দরকার? মাত্র তো ১৫ মিনিটের মতো স্ক্রিনে ছিলেন। বাংলাদেশে কি কেউ ছিল না এই চরিত্র করার?
সব থেকে চোখে পড়ার মতো অবস্থা হলো গানের দৃশ্যতে শাকিব খানের মুখভরা দাড়ি, কিন্তু গান থেকে বের হলেই দাড়ি গায়েব। ইউ রিয়েলি কিডিং মি? মেক সাম সেন্স ম্যান! এইগুলো তো কমন জিনিস, একটু তো বোঝা উচিত। একঘণ্টার মধ্যে তিনটি গান দেওয়া হয়েছে, তাও দুইটা গান হুট করে চলে এসেছে কোনো কারণ ছাড়াই। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক এতো লাউড করার মানে বুঝলাম না, সাথে প্রথম একস্থানে ছিল তেলুগু ‘বোমারিল্লু’ এর সেই বিখ্যাত টিউন। এছাড়া মনে হল টাইটেল সংটা জিতের ‘বস’ মুভির টাইটেল থেকে অনুপ্রাণিত।
পজেটিভ দিক একটাই লোকেশন ভালো, লং শটগুলো ভালো নেওয়া হয়েছে। গানগুলো আসলেই দারুণ ও সুন্দর কোরিওগ্রাফি। এছাড়া ‘বসগিরি’তে মৌলিক কিছুই নেই।
কয়েকটা কথা বলতে চাই। দেখুন নিউ লুক এই লুক সেই লুক এসব দিয়ে সিনেমা খাওয়ানো যায় না। একটা ভালো গল্পই পারে একটা ভালো সিনেমা দিতে। যতই প্রযুক্তি আনুন বা গান বানিয়ে ছাড়ুন, ভালো গল্প ছাড়া লুক দিয়ে কিছু হয় না। আমাদের সমস্যা ভালো গল্পের। ধানুশের লুক দিয়ে কিন্তু ধানুশ নায়ক হয়নি, নায়ক হয়েছে তার অভিনয় দিয়ে, আর তাকে সেই অভিনয় দেখানোর সুযোগ করে দিয়েছে একটা ভালো কাহিনীর সিনেমা। তাই ৩ মাসে সিনেমা নামানোর কথা বাদ দিয়ে আগে ভালো একটা গল্প তৈরি করুন। এভাবে আর কতদিন। আর শাকিব খান আসলেই নিজের ট্যালেন্ট নষ্ট করছে।
সব মিলিয়ে ‘বসগিরি’ খুবই নিম্নমানের সিনেমা যেখানে কাহিনীর কোনো অস্তিত্ব নেই। ইচ্ছা হল একটা কাহিনী বানিয়ে ফেললাম।
রেটিং : ৪/১০