চলচ্চিত্র ব্যবসা: লাভের গুড় কে খায়?
চলচ্চিত্র ব্যবসায়ীদের দীর্ঘদিনের অভিযোগ-চলচ্চিত্র পরিবেশনার নানা ক্ষেত্রে অস্বচ্ছতা ও দুর্নীতির কারণে তাঁরা প্রাপ্য টাকাটা পান না। এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রযোজক ও পরিবেশকদের সঙ্গে কথা বলে এ বিশেষ নিবন্ধ।
প্রযোজকের হিসাবে ১৯ কোটি টাকা আয় করেছিল এটলাস মুভিজের ‘স্বপ্নের ঠিকানা‘। ছবিটির প্রযোজক এখনো পাঁচ-ছয় কোটি টাকা পান পরিবেশকদের কাছে। কাকরাইলের পরিবেশক ও প্রযোজকদের অফিসে এই ছবির উদাহরণ টানা হয় প্রায়ই। ‘মনপুরা‘র ক্ষেত্রেও একই ঘটনা। প্রযোজক এখনো অনেক টাকা পাননি। অভিযোগের তীর পরিবেশনার সঙ্গে যুক্ত পরিবেশনা সংস্থার ম্যানেজার, বুকিং এজেন্ট, হল রিপ্রেজেনটেটিভ ও হল মালিকদের বিরুদ্ধে। প্রযোজকদের মতে, তাঁদের সবার যোগসাজশে ছবির আয় নানাভাবে কম দেখানো হয় বা প্রযোজককে তাঁর প্রাপ্য টাকা দেওয়া হয় না। সাধারণত ঢাকার বাইরের হলগুলোতে আয়ের ফিফটি ফিফটি শেয়ারে একটা ছবি ভাড়া দেওয়া হয় হল মালিককে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন প্রযোজক উদাহরণ দিয়ে বললেন, “ধরা যাক টঙ্গীর ‘চম্পাকলি’ হলে এক সপ্তাহে সর্বমোট আয় হয় চার লাখ টাকা। হিসাব অনুযায়ী প্রযোজককে দুই লাখ টাকা অগ্রিম দেওয়া হলো। নিয়ম অনুযায়ী ওই চার লাখ টাকার বেশি এক টাকাও যদি টিকিট সেল হয় তাহলে তার অর্ধেক প্রযোজক পাবেন। অনেক হল মালিক এ সেলটা দেখাতে চান না, উল্টো কমিয়ে দেখান। এ জন্য তাঁরা পরিবেশনা সংস্থা কর্তৃক নিযুক্ত প্রতিনিধিকে [হল রিপ্রেজেনটেটিভ] হাত করেন। মাত্র পাঁচ হাজার টাকা ঘুষ দিলেই কাজ হয়। যদি এক দিনে ৫০ হাজার টাকা সেল হয় তখন প্রযোজককে প্রতিনিধি জানান, ২০ হাজার টাকা সেল হয়েছে। এতে হল মালিকের নগদ ২৫ হাজার টাকা বাড়তি আয়। অন্যদিকে প্রযোজকের অর্ধেক আয় কমে যায়।”
অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সিরাজগঞ্জের ‘মমতাজ’ হল প্রতিনিধি তারিক বলেন, ‘ভালো ছবি হলে আমরা একটু বেশি টাকা পাব প্রযোজকের কাছ থেকে, কারণ তখন আয়ও বেশি হয়। কিন্তু সেল কমানোর ব্যাপারে আমি কিছু জানি না।’
আরো অভিযোগ, কোনো কারণে ছবি মুক্তির প্রথম সপ্তাহে যদি সেল কম হয়, তাহলে পরের সপ্তাহে ওই ছবির রেন্টাল অনেক কমিয়ে বলেন বুকিং এজেন্ট ও পরিবেশনা সংস্থার ম্যানেজার। কোনো হলের রেন্টাল যদি হয় এক লাখ টাকা, তাহলে ম্যানেজার প্রযোজকের উপস্থিতিতে বুকিং এজেন্টের সঙ্গে দরকষাকষির পর ৭০ হাজার টাকা ধরা হয়। সঙ্গে সঙ্গে রেন্টালের ১০ শতাংশ অর্থ কমিশন বাবদ বুঝে নেন বুকিং এজেন্ট। এই যে কমিয়ে রেন্টাল ধরলেন, এর জন্য এজেন্টের কাছ থেকে ৫-১০ হাজার টাকা কমিশন নেন ম্যানেজার। পরে দেখা যায়, বুকিং এজেন্ট ঠিকই এক লাখ টাকা হল মালিকের কাছ থেকে নিয়েছিলেন। ফলে একই সঙ্গে হল মালিক ও প্রযোজক দুই পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বুকিং এজেন্ট সমিতির সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘প্রতিটা ব্যবসায় ভালো-খারাপ দুই ধরনের লোক আছে। অনেক সময় হল মালিক অগ্রিম টাকা দিতে পারেন না। তখন আমরা পুঁজি খাটাই। সপ্তাহ শেষে তাঁরা আমাদের ফেরত দেন। আর ১০ শতাংশ নয়, আমাদের কমিশন গ্রস সেলের ওপর ৫ শতাংশ।’
পছন্দের নায়ক-নায়িকা না হলে বুকিং এজেন্টরা ছবি নিতে চান না। তখন তাঁরা ছবির রেন্টাল অনেক কমিয়ে দেন, কিংবা বাকিতে ছবি নেন। ছবি নির্মাণের সময় নানা রকম পরামর্শও দেন। অভিযোগ আছে, প্রভাবশালী নায়ক বা রাজনৈতিক মহলের সিন্ডিকেটের কারণে নতুন পরিচালকদের [বিশেষ করে টেলিভিশন থেকে আসা পরিচালক] ছবির চাহিদা থাকা সত্ত্বেও কম হলে ছবি মুক্তি দিতে বাধ্য করা হয়। এসব অভিযোগ উড়িয়ে দিলেন আনোয়ার হোসেন-‘কে না চাইবে একটু বেশি আয় করতে? এখন একই সপ্তাহে শাকিবের সঙ্গে অন্য নায়কের ছবি মুক্তি পেলে স্বাভাবিকভাবে তাঁর ছবির প্রতি বুকিং এজেন্টদের আকর্ষণ থাকবে। আর সিন্ডিকেটের কোনো অস্তিত্ব আছে বলে আমার জানা নেই।’
অভিযোগ আছে, কিছু হল মালিক তাঁদের প্রতিশ্রুত অঙ্কের টাকাও প্রযোজককে দেন না। সবচেয়ে বেশি অভিযোগ দেশের নামকরা হল মালিকদের বিরুদ্ধে। ‘মনের মাঝে তুমি’, ‘খোদার পরে মা’, ‘লাভ ম্যারেজ‘সহ অনেক ছবি দেশের নামকরা হল মালিকের কাছে টাকা পায়। মিয়া আলাউদ্দিন বলেন, ‘একটা ছবি হলে নেওয়ার আগে হল মালিকের সঙ্গে বুকিং স্লিপের মাধ্যমে প্রযোজকের চুক্তি হয়। কত টাকা অগ্রিম দেবে কিংবা সপ্তাহ শেষে কত শতাংশ শেয়ার দেওয়া হবে। এ ধরনের অনেক অভিযোগ পাই। কিন্তু এখন পর্যন্ত এগুলো নিয়ে বসার পরে একটা অভিযোগও ধোপে টেকেনি।’
পুরান ঢাকার একটি হলের বিরুদ্ধে আবার অদ্ভুত অভিযোগ, শুক্রবার সকালের শোতে যা আয় হয় তা হলের স্টাফরা ভাগ করে নেন। এর কোনো অংশই হল মালিক বা প্রযোজক পান না। এ ছাড়া ওই হলে বেশির ভাগ ‘নাইট শো’ হাউসফুল গেলেও টিকিট সেল কমিয়ে দেখানো হয়। মালিকের যোগসাজশে অনেক হলের স্টাফরাই টিকিট কালোবাজারিতে নামে। কিন্তু এটিও অস্বীকার করেন মিয়া আলাউদ্দিন-‘টিকিট কালোবাজারিতে স্টাফরা জড়িত থাকে, মালিকরা কখনো থাকে না। কারণ এতে তাঁদের কোনো লাভ নেই।’
পরিবেশনায় নানা দুর্নীতির কথা সংশ্লিষ্টরা অস্বীকার করছেন, কিন্তু পরিচালক সমিতির মহাসচিব মুশফিকুর রহমান গুলজার বলেন, ‘সমস্যা তো আরো আছে। হলের প্রজেক্টর ভাড়া কেন প্রযোজক দেবেন? এটা হল মালিক দিলেই প্রযোজক লাভবান হবেন। এসব সমস্যা সমাধান করতে পারলে ছবির আয় অনেক বেড়ে যাবে এবং নতুন অনেক প্রযোজক আসবেন চলচ্চিত্র ব্যবসায়।’
নিবন্ধটি কালের কণ্ঠের ফিচার পাতা রঙের মেলা‘য় প্রকাশিত