জালালের গল্প – একটি সত্যিকারের ভালো ছবি
ইমপ্রেস টেলিফিল্মের স্বল্প বাজেটের ছবিগুলো অনেকের ভালো লাগলেও ২-১ টা ছাড়া বেশীর ভাগই আমার কাছে বিরক্তিকর লাগে। জালালের গল্প নামে ইমপ্রেসের নতুন ছবিটির বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুরুষ্কারে ভূষিত হয়েছে শুনেও ছবিটির প্রতি আমার নূন্যতম আগ্রহ ছিলো না। এক বন্ধুর অতি আগ্রহে, সিনেমা হলে ঘুমিয়ে পড়ার মানুষিক প্রস্তুতি নিয়েই দেখতে গেলাম ছবিটি।
সত্যিকারার্থে ছবির শুরুটাই আমাকে গেঁথে ফেললো ছবির সাথে। এরপর প্রথম এবং দ্বিতীয় পর্ব দুটো অনেকটা মুগ্ধতার মধ্যেই কেঁটে গেলো। বিশেষ করে, দ্বিতীয় পর্বটি এতোটাই ভালো লেগে গেলো যে আমি তখন মনে মনে হিসেব করছি এই যে; কতদিন পরে এমন মুগ্ধতা নিয়ে বাংলা সিনেমা উপভোগ করলাম!!
কিন্তু আফসোস !! শেষের পর্বের বেশ কিছু ঘটনা আমার মুগ্ধতাটুকুকে নিভিয়ে দিলো। মোশাররফ করিম এবং মৌসুমী হামিদের মধ্যকার ঘটনাগুলো একেবারেই ছবির টিউনটা নষ্ট করে দিলো। নির্মাতা বোধহয় বানিজ্যিক ছবির দর্শকদের বিনোদন দিতে চাচ্ছিলেন এই পর্বটি দিয়ে; কিন্তু আমার মতে, মোশাররফ করিমের চরিত্রটির গল্পের একেবারেই বাইরে থেকে এসে হঠাৎ নায়ক হওয়ার যে চেষ্টা; তা ছবিটির মূল গল্প থেকে দর্শকদের মন সম্পূর্নরূপে বিচ্ছিন্ন করার জন্য যথেষ্ট।
যারা ছবিটি সম্পর্কে জানেন না তাদের জন্য বলছি, ছবিটি মূলত, জালাল নামে একটি ছেলের তিনটি বয়স এবং সেই তিন বয়সে তার আশেপাশে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনার সন্নিবেশ। অর্থাৎ, জালালের প্রতিটি বয়সকে একেকটি পর্ব ধরে ছবিটি তিন পর্বের একটি ছবি। এ ধরনের বিদেশী ছবি হয়তো আমরা অনেক দেখেছি, তবে আমার মনে হয় বাংলাদেশে এ ধরনের কাজ এতোটা পরিপাটিভাবে এর আগে কখনো করা হয়নি।
ছবির তিনটি পর্বে তিনটি গল্প আছে; তবে বিচ্ছিন্ন তিনটি গল্পকে জালালের গল্প দিয়ে গেঁথে দেয়া হয়েছে। আর জালালের গল্পটি এতোটাই সুন্দরভাবে বলা হয়েছে যে এই বিচ্ছিন্ন তিনটি গল্প যেন জালালের গল্পের সাথে মিশে গিয়ে জালালের গল্প হয়ে উঠেছে। আর ছবির শুরু এবং শেষটা নিরবেই বলে গেছে জীবনের চরম এক দার্শনিক সত্যকে।
আগেই বলেছি যে, মোশাররফ করীম এবং মৌসুমী হামিদের ঘটনাগুলো খুব বেশী ইতস্তত ছিলো এবং এইটুকু বাদ দিলে ছবির চিত্রনাট্যটি বেশ ভালো। চরিত্রগুলো খুবই চমৎকারভাবে লেখা হয়েছে, বিশেষ করে জালালের চরিত্রটি অসম্ভব রকম সুন্দর। পুরো ছবিতে জালাল কোন কথা না বলেই অনেক কিছু বলে গেছে। অল্প যেসব যায়গায় জালাল কথা বলেছে সেসব যায়গায়ও সে অল্প কথায় অনেক কিছু বলে গেছে। আমি জালাল চরিত্রটিকে মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করেছি। অন্য চরিত্রগুলোও ছিলো জীবন্ত। শুধুমাত্র মোশাররফ করীম এবং মৌসুমী হামিদের চরিত্র দুটো গোছানো হলে চিত্রনাট্যটি ফ্ললেস হতে পারতো।
ছবিতে চরিত্রানুযায়ী সবাই ভালো অভিনয় করেছেন। এই ডিপার্টমেন্টে সবাই ফুল মার্কস্ পেতেই পারে। তবে ব্যাক্তিগতভাবে আমি দ্বিতীয় পর্বটির সবার অভিনয় এগিয়ে রাখবো। অর্থাৎ, কিশোর জালাল, তৌকির আহমেদ, তৌকিরের বউ চরিত্রের মেয়েটি এবং সেই ওঝা।
দ্বিতীয় পর্বের ছোট ছোট কিছু বিষয় মুগ্ধ হওয়ার মতো বটে। রং করা হাঁস, কুকুরের ভয়ঙ্কর ডাক, পাখি, গ্রামীন প্রকৃতি; সবকিছুই অসম্ভব রকম সুন্দর।
পুরো ছবির সিনেমাটোগ্রাফীই অত্যন্ত সাবলীল এবং সুন্দর ছিলো। সম্পাদনাও বেশ পরিপাটি। আর ডায়লগ গুলোও শুনতে বেশ ভালো ছিলো।
ছবিতে গান নেই; তবে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক মোটামুটি চলনসই ছিলো।
সবমিলিয়ে, জালালের গল্প নিঃসন্দেহে একটি ভালো ছবি। যদিও, শেষ পর্বটিতে মোশাররফ করীমের চরিত্রটি ছবির মূল গল্প থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন ছিলো এবং মৌসুমী হামিদের সাথে তার মধ্যকার ঘটনাগুলো বিরক্তিকর ছিলো। বরং শীলা (মৌসুমী) এবং জালালের মধ্যকার ঘটনাগুলো অপেক্ষাকৃত বেশী স্পেস এবং ভালো ট্রিটমেন্ট পেলে ছবিটি বাংলা চলচ্চিত্রের এক অনন্য সৃষ্টি হতে পারতো।
যাইহোক, হয়তো এটি ততোটা অসাধারন কাজ শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠতে পারেনি; তবে সাম্প্রতিক সময়ের বাংলা চলচ্চিত্রে অল্প কিছু ভালো কাজের মধ্যে যে এ ছবিটি উল্লেখযোগ্য একটি কাজ তাতে কোন সন্দেহ্ রাখার অবকাশ নেই।
সবারই ছবিটি দেখা উচিৎ এবং এ ধরনের ভালো কাজকে এপ্রিশিয়েট করা উচিৎ।
রমিজ, ০৬/০৯/১৫