লাভ ম্যারেজ একটি স্বার্থক বি গ্রেডের সিনেমা
দেখে ফেলেছি কথিত বেঁদের মেয়ে জোসনার রেকর্ড ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে দেওয়া বিখ্যাত ছিনেমা লাভ মেরিজ৷ কুরুচিকর পোস্টার, গতানুগতিক ট্রেলার, হাস্যকর নাম এসব দেখে প্রথমেই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম এ ছবি আমার দেখার উপোযোগী নয়! তারপরেও আমি সিনেমা হল পর্যন্ত গিয়েছি এ ছবিটিই দেখতে! আর এ অঘটনের কৃতিত্ব শুধু মাত্র ফেসবুকে বাংলা সিনেমার গ্রুপ পেজগুলোর কতিপয় ফিল্ম প্রমোটারের৷ আপনারা ক্যামেনে পারেন ম্যান! :O যেভাবে ফেসবুকে বাংলা ফিল্মের গ্রুপ পেজ চালানোকে আপনারা একটা পেশার পর্যায়ে নিয়ে গেছেন তা সত্যিই প্রশংসনীয়।যাইহোক, আসল প্রসঙ্গে আসি৷ চলুন জেনে নিই কি আছে লাভ ম্যারেজে?
শাকিবের বাবা সাদেক বাচ্চু কাফনের কাপড়ের ব্যাবসা করে হাজার কোটি টাকার মালিক৷ যদিও যে দোকানের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল পরিচালক কোন চাঁ দোকান খালি করিয়ে সেখানে শ্যুট করিয়েছিল৷ যদিও সিনেমাটা দেশের বিগ বিগ প্রডাকশন হাউজ হার্টবিটের কুটি কুটি টাকা বাজেটের সিনেমা৷
যাইহোক, প্রথম দৃশ্যে দেখা যায় দোকানে বসে কাফনের কাপড় বিক্রি করছে শাকিবের বাবা৷ হঠাৎ মিশা চামচার আগমন৷ যিনি শাকিবদের জমি কিনতে চায়৷ কিন্তু কুটিপতি শাকিবের বাবা ওনার জমি বিক্রি করতে নারাজ৷
হতাশ হয়ে মিশার চামচা মিশার কাছে যায়৷ মিশা ডায়লগ মারে ‘আমার নাম টাটা মার্বেল দিয়া করি মাইনষের চান্দি ফুটা’ এই এপিক ডায়লগ শুনে ইচ্ছে হচ্ছিল এই ডায়লগের আবিষ্কারকে খুজে বের করি, তার কানে গালে একটা থাপ্পড় দিই৷ তারপর তার হাতে একটা মার্বেল দিয়ে বলি চান্দি ফুটা করে দেখা তো দেখি।
যাইহোক, টাকা দিয়ে জমি কিনতে না পেরে জমি দখলের জন্য তার সাগরেদদের পাঠায়৷ জমিতে শাকিবের বাবার সাইন বোর্ড উঠিয়ে টাটার সাইনবোর্ড লাগাচ্ছিল মিশার গুন্ডারা৷ এমন সময় হেলিকাপ্টারের আওয়াজ৷ হেলিকাপ্টার থেকে নামলো শাকিব খান৷ প্রত্যাশিত ভাবেই ঠোটে হালকা লিপিস্টিক এবং দুই কানে দুল পড়া অবস্থায়৷
তারপর ছবির প্রথম কমেডি থুক্কু এ্যাকশন সিন শুরু আকাশে উড়া উড়ি করে শাকিব হাত পা ছোড়াছোড়ি করছে৷ আর মিশার গুন্ডাদের মুখ দিয়ে পানের পিকের মতো করে রক্ত বেরুচ্ছে!!! এরকম হাস্যকর এ্যাকশন শুধু বাংলা সিনেমাতেই সম্ভব৷ একটা ছবিতে এরকম এ্যাকশন রাখা থেকে আমার মতো না রাখাটাই উত্তম৷
মারামারি করে বাড়ি ফিরেছে শাকিব৷ হাত কেঁটে গেছে তার৷ তাই চাকর বাকরদের স্যাভলন আনতে বলে৷ কিন্তু কেউই শাকিবের নির্দেশ শুনছে না৷ শাকিব বিয়ে না করা পর্যন্ত কেউই শাকিবের নির্দেশ শুনবে না৷ কিন্তু শাকিব কিছুতেই লাভ ছাড়া ম্যারেজ করবে না৷
তার পরের কাহিনী আপনি যেটা ভাবছেন সেটাই৷ হঠাৎ একদিন রাস্তায় অপু কে দেখে শাকিব৷ স্বাভাবিক ভাবেই দেখেই প্রেমে হাবুডুবু খেতে থাকে৷ শুরু হয় গান৷ তারপর অপুর পেছনে ছোটাছুটি৷ গতনুগতিক চিরচেনা স্টাইলে টিজ করা৷
এদিকে অপুর বাবা মিজু আহমেদ, চাঁদাবাজ৷ মিশার প্রধান প্রতিদ্বন্দী৷ কিন্তু বাবার রক্ত চোষা টাকা-পয়সা চায় না অপু বিশ্বাস৷ শুরু হয় বাবাকে ধিক্কার জানিয়ে মেয়ের বাংলা রচনা টাইপ বিশাল ইমোশনাল সংলাপ৷ ব্যাকগ্রাউন্ডে বেজে ওঠে ২০ বছর আগের স্টাইলের ডুডুডুডুুডুটুুুুুুটু টাইপ মিউজিক৷ মেয়ের দিকে চোখ তুলে যে চায় তাক হাত পা গুড়ো করে দেয় অপুর বাবা৷ স্বাভাবিক ভাবেই শাকিবের কথা জানতে পারেন তিনি৷ ফলে তার গুন্ডাদের সঙ্গে শাকিবের কয়েকদফা কমেডি স্টাইলের এ্যাকশন সংঘটিত হয়৷
শাকিবের টিজ চলতে থাকে৷ অপু শাকিবকে পাত্তা দেয় না৷ কিন্তু একদিন শাকিবের ইংলিশ শুনে ফিদা হয়ে যায়৷ আবার শুরু হয় গান নাচ৷
শাকিব অপুর মিষ্টি মধুর প্রেমের সম্পর্কের এক পর্যায়ে তাদের মাঝে মিশার আগমন ঘটে৷ একদিন অপুর সাথে ধাক্কা খায় মিশা৷ প্রত্যাশিত ভাবেই অপুর প্রেমে হাবুডুবু খেতে থাকে মিশা৷ এবং চিরশত্রু অপুর বাবা মিজু আহমেদকে শ্বশুর বানানোর সিদ্ধান্ত নেয়৷ অপুর বাবাও রাজি হয়ে যায়৷ এবার অপুকে মিশার হাত থেকে কিভাবে রক্ষা করবে শাকিব? এই নিয়ে এগিয়ে যায় ছবির কাহিনী৷
গল্প শুনেই বুঝতে পারছেন গতানুগতিক গল্পের ছিনেমা লাভ মেরিজ৷ তার সাথে যোগ হয়েছে যাচ্ছেতাই নির্মান৷ সব মিলিয়ে একটা দুর্দান্ত বস্তাপঁচা সিনেমা৷ পরিচালক কোন রকমে ছবির কাজ শেষ করেছে৷ ছবির ক্ল্যাইমেক্সে একটা ফাইটিং সিকোয়েন্স ছিল যেখানে হেলিকাপ্টার নিয়ে বাড়ির ছাদে লেন্ড করে শাকিব খান৷ তারপর ফাইটিং শুরু হয়৷ ফাইটিংয়ের এক জায়গায় বাড়ির ছাদে হেলিকাপ্টার দেখা যাচ্ছিল এক সেকেন্ড পরের দৃশ্যেই তা উধাও হয়ে যাচ্ছিল আবার কয়েক সেকেন্ড পরেই আবার ফিরে আসছিল৷ বোঝেন এবার পরিচালক কতো দায়িত্বহীন হলে ছবিতে এ ধরনের ভুল করতে পারে৷ আসলে শাহীন সুমনের মতো অশিক্ষিত বুড়ো পরিচালকদের অবসর নেওয়ার এখনই সময়৷ ওনার মতো মূর্খ পরিচালকরাই আজকাল সুন্দর বনে সিংহ আবিষ্কার করে বাংলা সিনেমাকে কলুষিত করছে৷
স্বাভাবিক ভাবেই এ ধরনের সিনেমায় ভালো ক্যামেরার কাজ, লোকেশন, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, পোশাক পরিচ্ছেদ ইত্যাদি আশা করা বোকামী৷ আর আমি এসব আশাও করিনি৷
তাই সরাসরি চলে আসি অভিনয় প্রসঙ্গে৷
শাকিব ঢাকাইয়া ভাষায় ডায়লগ বলাতে মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন৷ তবে সিনেমায় তার হাবভাব, এক্সপ্রেশন আর পাঁচটা বস্তপচা সিনেমার মতোই ছিল৷ অপুকে অনেক স্লীম ও গ্ল্যামারাস লেগেছে৷ যদিও এর জন্য অনেক কড়া মেকাপের সাহায্য নিতে হয়েছে৷ মিশার লুক ছিল বস্তাপচা৷ তবে শেষের দিকে অপুর প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া অবস্থায় বেশ ভালো অভিনয় করেছে৷ দর্শকও বেশ মজা পেয়েছে৷ বাকি অভিনয় শিল্পীদের মধ্যে কোন বিশেষত্ব ছিল না৷ সবাই আর পাঁচটা বস্তপচা সিনেমায় যেমন অভিনয় করে এ ছবিতে তেমন অভিনয় করেছে৷
‘ভালোবেসে এই বার আয় কাছে তুই’ ও ‘কি করে বল’ ছবির এই দুটা গান বেশ ভালো ছিল৷ এর মধ্যে ভালোবেসে এই বার গানটির চিত্রায়ন, লোকেশন বস্তাপচা সিনেমা হিসেবে অনেক ভালো ছিল৷ আর পাঁচটা বস্তাপচা সিনেমার মতো এই সিনেমাতেও ছিল বিপাশা কবীরের আইটেম গান৷ আসলে একটা সিনেমাকে দেখার অযোগ্য করার জন্য বিপাশা কবীরের এমন একটা আইটেম গানই যথেষ্ঠ৷ এখন অনেকেই হয়ত অভিযোগ বলিউড সিনেমার আইটেম গান দেখতে পারলে বিপাশা কবীরের আইটেম গান দেখতে সমস্যা কোথায়? ঐসব কাঁনা, অথর্ব আহম্মকদের বলতে চাই৷ বলিউডের ক্যাটরিনা, কারিনা অার দীপিকাদের গ্ল্যামার, ফিগার আর বিপাশা কবীরের মতো একটা মাঝবয়সী বুড়ির গ্ল্যামারের মধ্যে যে আকাশ পাতাল তফাৎ৷ এই সহজ ব্যাপারটা বোঝার মতো ক্ষমতাও কি তোদের নেই?
যাইহোক সবমিলিয়ে শাকিবের ঢাকাইয়া ভাষার ডায়লগ গুলো ছাড়া নতুন কিছুই নেই লাভ ম্যারেজে৷ হলের দর্শক কিছু কিছু ডায়লগ বেশ ভালোই উপভোগ করেছে৷ তাছাড়া কাবিলার কিছু সস্তা কিছু কমেডি ছিল ছবিতে৷ এছাড়া শাকিবের সাঙ্গো পাঙ্গোদেরও কিছু সস্তা কমেডি ছিল৷ এগুলো থেকে আপনি মজা পেলেও পেতে পারেন৷ আসলে মজা পাওয়া না পাওয়ার পুরো ব্যাপারটা নির্ভর করছে আপনার রুচি ও মন-মানসিকতার ওপর৷ এক কথায় অনেকের কাছেই এ ছবি অমৃত মনে হতে পারে আবার অনেকের কাছে জঘন্যও মনে হবে৷ এবং অবশ্যই ছবিটি শিক্ষিত ও উৎকৃষ্ট রুচিবোধ সম্পন্ন দর্শকদের উপযোগী নয়৷ অন্যদিকে রিক্সা ওয়ালা, গার্মেন্টস কর্মী ইত্যাদি পেশার নীরীহ অশিক্ষিত দর্শকদের কাছে এ ছবি অমৃত মনে হতে পারে৷ আর তাদের কাছে সম্ভবত অমৃত মনে হচ্ছেও৷ আর এজন্যই ছবিটি দ্বিতীয় সাপ্তাহেও শতাধিক হলে চলছে!
আসলেও সব দেশের ইন্ড্রাস্ট্রীতেই নিম্নশ্রেণীর দর্শকদের রুচি অনুযায়ী ভিন্নধারার B গ্রেডের ফিল্ম তৈরি হয়৷ দুর্ভাগ্য বাংলাদেশী সিনেমা প্রেমীদের কারন বিভিন্ন কারনে এদেশের B গ্রেডের সিনেমাগুলো আজ মূলধারার সিনেমার আসন দখল করে ফেলেছে৷
যাইহোক, যতদূর জানি লাভ ম্যারেজ সিনেমাটি ভালো ব্যাবসা করছে৷ একটা B গ্রেডের সিনেমার জন্য ব্যাবসাটাই আসল৷ সে হিসেবে লাভ ম্যারেজ একটি স্বার্থক B গ্রেডের সিনেমা৷
চমৎকার রিভিউ