Select Page

পদ্ম পাতার জল : অনেকদিন মনে রাখার মতো একটি সিনেমা

পদ্ম পাতার জল : অনেকদিন মনে রাখার মতো একটি সিনেমা

pd1বানিজ্যিক সিনেমা মূলত দুই ধরনের৷ কিছু সিনেমার মানে শুধুই আড়াই ঘন্টার বিনোদন, আপনি সিনেমা দেখলেন কিছুক্ষন মজা নিলেন, দুই দিন পর সিনেমাটার কথা ভুলেই গেলেন৷

আবার কিছু সিনেমা আছে আড়াই ঘন্টার মুগ্ধতা, যেগুলো হৃদয়ে গেঁথে যায়৷ এসব সিনেমা আপনি বিশ বছর পরেও ভুলবেন না৷ সিনেমা হলে দেখে তো মুগ্ধ হবেনই৷ একটা ডিভিডিও সংগ্রহে রাখতে চাইবেন অথবা অনেক বছর পর একদিন টিভির চ্যানেল পাল্টাতে পাল্টাতে কোন একটা ঐ চ্যানেলে ঐ সিনেমাটা দেখাচ্ছে দেখলেই আয়েশ করে দেখতে বসে যাবেন৷ ২নং ক্যাটাগরি খুব কম বাংলা সিনেমা গুলোর তালিকায় থাকার মতো একটি সিনেমা পদ্ম পাতার জল
বানিজ্যিক ফিল্মেও যে শিল্প থাকতে পারে তার উৎকৃষ্ঠ উদাহরন পদ্ম পাতার জল৷ অসাধারন গল্প, সংলাপ, অভিনয় শৈলী, লোকেশন সব মিলিয়ে একটা অসাধারন কাজ৷

অত্যাচারী জমিদারের পুত্র খেয়ালি কবি রিজওয়ান৷ বাবার নির্দেশে শহরে যায় বিদ্যা অর্জনের জন্য৷ সেখানে এক রাতে দুই বন্ধুর পাল্লায় পড়ে এক নাঁচের আসরে আসে এবং বাইজী ফুলেশ্বরীর প্রেমে পড়ে যায়৷ কি হবে তাদের পরিনীতি? এটুকু কাহিনী সংক্ষেপ পড়ে হয়ত অনেকেই ছবিটিকে ধনী গরীবের প্রেম টাইপ ট্রিপিক্যাল বাংলা সিনেমা ভাবছেন৷ আপনিও যদি সেটা ভেবে থাকেন তাহলে অবশ্যই আপনি ভুল ভাবছেন৷ ছবির কাহিনী সাধারন কোন বাংলা সিনেমার মতো নয়৷ ছবির কাহিনী আসলে কেমন? সেটা সম্পর্কে ধারনা দিতে গেলে ছবির ভিতরের অনেক চমক ফাস হয়ে যাবে৷ যা আপনার ছবিটা দেখার মজা নষ্ট করে দিতে পারে৷ তারচেয়ে বরং আপনি ছবিটা দেখেই ছবির কাহিনী জানুন৷ শুধু একটা কথা বলতে পারি এ ছবি আপনাকে হাঁসাবে, কাঁদাবে, রাগাবে, ভাবাবে সর্বোপরি মুগ্ধ করবে৷

শুরুর দিকের বেশ কিছু কমেডি সিকোয়েন্সে আপনি হাসবেন৷ ইমন ও মীমের প্রনয়ের জায়গা গুলোতে এক ফালি মুচকি হাঁসি আপনার মুখে লেগে থাকবে৷ মীমের সাথে ইমনের কবিতার মাধ্যমে ভাব প্রকাশ আপনাকে এক অনন্য মুগ্ধতায় ডুবিয়ে রাখবে৷ তারপর আস্তে আস্তে কাহিনী যত এগোতে থাকবে নাটকীয়তা ততই বাড়তে থাকবে তখন আপনি কখনও ভাববেন আবার কখনও হলের অন্য দর্শকদের মতো আপনার চোখও কান্নায় জ্বল জ্বল করে ওঠবে৷ ছবির দ্বিতীয়অর্ধে একটা সময় আসবে যখন কাহিনী একটি সাধারন সমাপ্তির দিকে এগোচ্ছে এমন ভেবে বিরক্ত হতে শুরু করবেন৷ ঠিক তখনই কাহিনীতে আসবে নতুন বাঁক৷ ছবির শেষটা অনেকেই মেনে নিতে পারবেন না৷ শেষের দিকের প্রতিটা মুহূর্ত আপনার হৃদয়ে পিন ফোটার মতো অনুভূতি জাগাবে৷ মোট কথা দর্শকের আবেগ অনুভূতি নিয়ে সফল ভাবে খেলতে সক্ষম হয়েছে ছবিটি৷ আর এজন্য ধন্যবাদ পাবে ছবির কাহিনী ও চিত্রনাট্যকার লতিফুল ইসলাম শিবলী৷ উনি অসাধারন কাহিনীর পাশাপাশি তিনি সংলাপ গুলোও ভালো দিয়েছেন৷ প্রত্যেকটা সংলাপই অনেকদিন মনে রাখার মতো৷ তাছাড়া সংলাপে প্রচুর কবিতার ব্যাবহার ছিল৷ এছাড়া ছবির শেষটা যিনি যেভাবে করেছেন সেটা সত্যিই অভাবনীয়৷ ছবিটা মানুষ অনেকদিন মনে রাখবে শুধু মাত্র শেষের অংশ গুলোর কারনে৷ সব মিলিয়ে বলা যায় তিনি বেশ পরিশ্রম করেই ছবির কাহিনী ও চিত্রনাট্য লিখছেন৷ পরিচালক ও প্রযোজকদের উচিত ওনার মতো প্রতিভাবান ও পরিশ্রমী চিত্রনাট্যকারকে বাংলা সিনেমায় নিয়মিত করা৷

Emon mimছবির প্রেক্ষাপট ইংরেজ আমলের অর্থ্যাৎ আজ থেকে কমপক্ষে ১০০ বছর পূর্বের৷ ইতিপূর্বে বহু বাংলা সিনেমায় ইংরেজ আমল, জমিদারী,এগুলো উঠে আসলেও৷ কোন সিনেমাতেই ১০০ বছর পূর্বের পরিবেশ ফুটে ওঠেনি কিংবা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়নি৷ কিন্তু পদ্ম পাতার জল ছবিতে সেই সময়টা সফল ভাবে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন ছবির নির্মাতাগন৷ লোকেশন, বাড়ি ঘর, আসবাপত্র, যানবাহন, পোশাক-আশাক সব কিছুতে ছিল ১০০ বছর আগের ছোয়া৷ আর এজন্য ছবির পরিচালক, সেট নির্মাতা, মেক্যাপ ম্যান এবং কস্টিউম ডিজাইনারকে স্যালুট৷ সেই সঙ্গে ছবির প্রডিউসারকে ধন্যবাদ এধরনের ব্যায়বহুল একটি ছবি প্রযোজনার সাহস করার জন্য৷

এবার আসি অভিনয়ে৷
‘তীর মেরোনা মেরোনা’ শিরোনামের গানের মাধ্যমে,যখন পর্দায় মীমের আগমন ঘটলো৷ তখন ভয় হচ্ছিল এই মেয়ে পারবে তো? কিন্তু সময় যতো গড়াতে থাকলো ততই অবাক হতে থাকলাম মীমের অভিনয়ে৷ শুরুর দিকে মীমের হাসি, সংলাপ বলা, সৌন্দর্য এসব আপনার হৃদয়কে উথান পাথাল করে দিবে৷ উল্টোদিকে ছবির শেষে মীমের অভিনয়ে আপনার হৃদয় বিষাদে ভরে ওঠবে৷ এককথায় মীম অসাধারন অভিনয় করেছে শেষের দিকে৷ শেষের দিকের প্রতিটি সিকোয়েন্সে মীমের এক্সপ্রেশন, ডায়লগ ডেলিভারি ছিল অনবদ্য৷ এই অভিনয়ের জন্য মীম জাতীয় চলচিত্র পুরুষ্কার পাওয়ার দাবিদার৷

যেসব হুজুগে লোকজন ছবি মুক্তির আগে ছবিতে ইমনকে নেওয়া ঠিক হয় নাই এমন মন্তব্য করছিলেন তাদেরকে বলতে চাই৷ ছবিতে ইমন অত্যান্ত ভালো অভিনয় করছে৷ ইমনের ক্যারিয়ারের সেরা ছবি ‘পদ্ম পাতার জল‘। রিজওয়ান তথা ইমনের বাবার চরিত্রে অভিনয় করা তারিক অনাম খানকে পর্দায় খুব বেশী সময় দেখা যায়নি৷ যতক্ষন ছিলেন ভালো অভিনয় করেছেন৷ তবে সবচেয়ে অসাধারন অভিনয় করেছেন শহীদুজ্জামান সেলিম৷ ভিলেনগিরি কাকে বলে তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন ছবিতে৷ শেষের দিকে খুব কম সময়ের উপিস্থিতিতে অমিত হাসানের কাঁছ থেকে প্রধান ভিলেনের খেতাব রূতীমতো ছিনিয়ে নিয়েছেন৷ আপনি যেমন মানুষই ইউন না কেন ওনার চরিত্র’টি আপনাকে এক মহুর্তের জন্য হলেও রাগাবে৷
এছাড়া নিমা রহমান, আবু হেনা রনি সহ বাকিরাও নিজ নিজ চরিত্রে ভালো অভিনয় করেছে৷ তবে এক্ষেত্রে অমিত হাসান কিছুটা হতাশ করেছে৷ ওনার অভিনয়ে বিশেষ কিছু ছিল না, কোনরকমে চালিয়ে নেওয়ার মতো অভিনয় করেছেন তিনি 🙁

ছবিতে ক্যামোরার কাজ ও আবহ সংগীত ছিল আন্তর্জাতিক মানের৷ হলিউড বলিউডের সাথে এক কাতারে দাড়ানোর মতো৷ ছবির গান গুলো দেশের লোকেশন ব্যাবহার করে অসাধারন ভাবে চিত্রায়ন করা হয়েছে৷ আর গানের কথা গুলোও কাব্যিক৷ গান গুলোও ছবির প্রক্ষাপটে ঠিকঠাক৷ যদিও এটাও সত্য ছবির একটা গানও একবার শুনলেই বার বার গাওয়ার মতো মূর্ছনা জাগানোর মতো না৷ এই কারনে গান গুলো সকল দর্শকের কাঁছে ভালো লাগেনি৷ যদি গান গুলো জনপ্রিয় হতো তাহলে এই সিনেমাকে নিদ্বিধায় ঢালিউডের ইতিহাসের সেরা মুভি গুলোর একটি হিসেবে ঘোষনা করা যেত৷

সবমিলিয়ে পদ্ম পাতার জল মানে অন্যরকম অনুভূতি৷ বাংলা সিনেমা নির্মানে এক অনন্য বিপ্লবের নাম ‘পদ্ম পাতার জল’ নির্মাতাদের ৩ বছরের পরিশ্রম স্বার্থক৷

উল্লেখ্য কিছুদিন আগে ভারতে বাহুবলি নামে একটা সিনেমা বের হয়েছিল৷ বাংলাদেশী সিনেমার মান ও বাজারের বিবেচনায় পদ্ম পাতার জলকে যদি কেউ বাংলাদেশের বাহুবলী বলেন তাহলে খুব একটা ভুল বলবেন না৷ অফসোস একটাই চারটি বলিউড সিনেমার সমান বাজেটের বাহুবলী চারদিনে লগ্নি তুলে ফেলে৷ আর বাংলাদেশের পদ্ম পাতার জল ঠিক মতো হলই পায় না৷ প্রদর্শনীতেও বলার মতো দর্শক থাকে না৷ ওদের সিনেমা আর আমাদের সিনেমার মধ্য মানের পার্থ্যক্যের পিছনের কারন হয়তো এটাই৷


Leave a reply