Select Page

আনন্দ অশ্রু : ভালোবাসা যেভাবে ‘আনন্দ’ ও ‘অশ্রু’ হয়ে যায়

আনন্দ অশ্রু : ভালোবাসা যেভাবে ‘আনন্দ’ ও ‘অশ্রু’ হয়ে যায়

প্রথমেই অবাক করা কথা দিয়ে শুরুটা করি। জানলে অবাক না হয়ে পারবেন না যে এমন একটা ক্লাসিক সিনেমা জীবনে এখন পর্যন্ত মাত্র নয়বার দেখেছি। এর অাগে অাটবার আর গত পরশু দেখার পর নয়বারে ঠেকেছে।  কারণটা জিজ্ঞেস করতে হবে না, বলছি। ‘অানন্দ অশ্রু’ দেখার সময় প্রথমে ‘অানন্দ’ অার পরে ‘অশ্রু’-র যে আগমন তার মধ্যে অশ্রুটাই আমাকে বেশি জ্বালাতন করে দেখার সময় তাই এত কমবার দেখা। তাই বলে অাবার ভাববেন না যে সিনেমাটি পুরো দেখিনি। একদম পাই পাই করে দেখা,  মুখস্থ।

‘অানন্দ’ অার ‘অশ্রু’ দুটো একজন অার একজনের জানের দুশমন বলা যায়। কারণটা হল এরা একে অপরকে দেখতে পারে না তাই ‘অানন্দ’ বেশিক্ষণ দীর্ঘ হয় না,  ‘অশ্রু’ এসে গোলযোগ বাঁধায়। সালমান-শাবনূরের মিষ্টি-মধুর প্রেমের ‘অানন্দ’ তাই ‘অশ্রু’ হতে খুব বেশি সময় লাগেনি। সিনেমার শুরুটা দেখার মতো। মাস্টার অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদি তার নিজের সাম্রাজ্য রক্ষা করতে ডলি জহুরের স্বামীকে হত্যা করে। ডলি জহুর বরাবরের মতোই গগনবিদারী কান্নায় নিজের করুণ অবস্থা তুলে ধরে। তার দস্যি মেয়ে শাবনূর। তার বৈশিষ্ট্য হলো ঘরে না থাকা,  বনে-বাদাড়ে ঘোরা অার এটা ওটা করে লোকের ঘুম হারাম করা। লোকে তাকে পাগলি মেয়ে ভাবলেও সে কিন্তু বুদ্ধিমতী কেননা সে জানে কোথায় কিভাবে যেতে হবে। তার তো সব জানা। যেমন সে গানে গানে জানাচ্ছে –

‘উত্তরে ভয়ঙ্কর জঙ্গল
দক্ষিণে না যাওয়াই মঙ্গল
পূর্ব-পশ্চিম দুই দিগন্তে নদী’

এমন করে কে বলবে কোথায় যাওয়াটা ভালো অার কোথায় অাছে ঘোর বিপদ! শাবনূরের ইমম্যাচিউর বিষয়টা সালমান শাহ অাসার পরে ম্যাচিউরিটির দিকে যায়। দেওয়ানগণ্জে ঘুরতে যাওয়া সালমান,  কাঞ্চি,  দিলদারের দল সিনেমার মোড় ঘুরিয়ে দেয়। সালমান গাছতলায় বসে গান লেখে ‘তুমি মোর জীবনের ভাবনা’ আর পৃষ্ঠাগুলো ঢিল দিয়ে আটকে রাখে যাতে বাতাসে উড়ে না যায়। কিন্তু পৃষ্ঠাগুলো যে পেছন থেকে পগার পার হয়ে যাচ্ছে সেটা টের পায় পরে। শাবনূর এটা করে। শেষে ধরাই পড়ল। এর অাগে গাছের মগডালে বসে ভূতের ভয় দেখাত সে। একবার তো দিনের বেলাতেই ভয়ে কাঁপাকাঁপি হবার যোগাড় দিলদারের। সেই চঞ্চল পাড়াগাঁয়ের মেয়ে শাবনূরের পরিবর্তনটা এল ভালোবাসার স্পর্শে। সাপে কাটার পরে সালমান যখন বিষ তুলে ফেলল জ্ঞান ফেরার পর পুরো পরিস্থিতিটা বুঝতে দেরি করেনি শাবনূর। তারপর বাড়িভর্তি লোকের সামনেই জড়িয়ে ধরল সালমানকে। এ অপূর্ব মুহূর্তে দানব এসে হাজির হল। হুমায়ুন ফরীদি। ভালোবাসা যার গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দেয় সে যে ভালোবাসাকে গলাটিপে মারবে সে তো জানা কথা। অতঃপর,  ‘অশ্রু’-র অায়োজন শুরু। টনিসাহেব মানে নানাশাহর কথা বলছি তাকে ডেকে সালমানকে পাগলের ইনজেকশন দিয়ে ঢাকা নিয়ে যাবার অায়োজন চলে। দেওয়ানগণ্জে অাবার চিকিৎসার জন্য অানা হলে সালমানের চিকিৎসার দায়ভার শাবনূরের হাতেই পড়ে। শাবনূরকে টাকা দিয়ে রাজি করাতে পারে না সালমানের বাবা সাদেক বাচ্চু। পরে কাঞ্চি অাঁচল পেতে তার ভালোবাসার মানুষটিকে বাঁচাতে বলে। শাবনূর রাজি হয়। একসময় ‘তুমি মোর জীবনের ভাবনা’ গানটির মাধ্যমেই সালমানের জ্ঞান ফিরে অাসতে থাকলে দর্শক হিশেবে ‘অানন্দ’ আবার ফিরে পাবার বাসনা থাকলেও তা অার হয় না। ততক্ষণে হুমায়ুন ফরীদি তার দলবল নিয়ে হাজির। গুলি করে মেরে ফেলে সালমানকে। পরে শাবনূরকেও। ভালোবাসার করুণ পরিণতি আসে ‘অশ্রু’তে অার দর্শক বুঝে যায় ভালোবাসায় ‘অানন্দ’র থেকে ‘অশ্রু’ই দীর্ঘস্থায়ী হয়।

অভিনয়ে সালমান শাহ বরাবরই ক্লাসিক। তার প্রেমিক ও পাগল চরিত্র দুুটিতে একশোতে একশো মিশে যেতে সে নিজেকে ঢেলে অভিনয় করেছে। সাপে কাটা শাবনূরের বিষ তুলে রক্তমাখা মুখে তার এক্সপ্রেশন যেমন মুগ্ধ করে,  গান লেখার সময় প্রকৃতির সাথে মিশে যাওয়ায় তার জুড়ি নেই,  পাগল হয়ে পাগলামিতে ‘তুমি অামার এমনই একজন’ গানে মিশে যায় সহজাত অভিনয়ে যেখানে দর্শক হিশেবে অাপনার/ আমার দুটি চোখ ছলছল করে। শাবনূর অতু্লনীয়। তার চরিত্রেও দুটি দিক। প্রথমটা গাঁয়ের চঞ্চল মেয়ে পরেরটা সালমান পাগল হবার পরে হাসতে ভুলে যাওয়া কষ্টের মূর্তি। তার ‘উত্তরে ভয়ঙ্কর জঙ্গল’ গান যেমন অানন্দ দেয় তেমনি ‘থাকত যদি প্রেমের অাদালত’ অশ্রু ঝরায় অার সে অশ্রুকে অঝোর ধারা করে ‘তুমি অামার এমনই একজন’ গানে যখন ভালোবাসাকে কাছে পেয়েও সে দু’হাতে জড়াতে পারে না। কাঞ্চিও তার সাপোর্টিং রোলে অনবদ্য। ‘তুমি অামার এমনই একজন’ এই একটা গানই যথেষ্ট তাকে স্মরণীয় করে রাখতে এবং সেটাই হয়েছে। তাছাড়া ‘তুমি মোর জীবনের ভাবনা’ গানের প্রথম ভার্সনে সে চমৎকার ছিল। হুমায়ুন ফরীদি মাস্টার অভিনেতা অার পুরো সিনেমায় চষে বেড়াতে সে অভিনয়ই দেখিয়েছে। শেষবার যখন বলে ‘হয় রবিনকে সারাজীবন পাগল থাকতে হইব না হইলে মরতে হইব’ তার সে রুদ্রমূর্তি ভোলা যায় না। ডলি জহুর,  খালেদা অাক্তার কল্পনা নিজেদের চরিত্রে সেরা। ক্লিনিকের ডাক্তার সিরাজুল ইসলাম অনবদ্য অভিনয় করেছে। সাদেক বাচ্চুর অভিনয়ও মনে রাখার মতো। দিলদার তো তার চরিত্রে রাজত্ব করবেই।

director’s emotion এ সিনেমাকে শক্তিশালী করেছে। সালমান শাহ-শাবনূর-কাঞ্চি ত্রিভুজ প্রেমের সমীকরণটি শিবলি সাদিক স্যার এত নিখুঁতভাবে ভাগ করেছেন যে ভাষাহীন হতে হয় বলতে গেলে। সালমান পাগল হবার পর তার সুস্থতা দরকার,  ভালোবাসা দরকার সেদিক থেকে সালমানের চরিত্রের অাবেদন শতভাগ। শাবনূর তার নার্সের ভূমিকায় থেকে কাছে পেয়েও নিজের ভালোবাসাকে জড়াতে পারছে না বুকে সে বেদনাও অসামান্য। কাঞ্চি তো সালমানের জন্য পাগল। তিনজনের বাস্তবতাকে একই ফ্রেমে অানতে তাই ‘তুমি অামার এমনই একজন’ গানটি এতটা শক্তিমান হয়ে ওঠে। সব ইমোশন একখানে এসে থেমে যায় অনন্ত তৃষ্ণা হয়ে সালমান-শাবনূরের লাশকে যখন চাদরে ঢেকে দেয় কাঞ্চি। সিনেমা শেষ হলেও কানে লেগে থাকে শাবনূরকে বলা কাঞ্চির দরদী সংলাপ-
‘বলিসনি কেন হতভাগী তুই-ই খসরুর দোলা!’…

পোস্টার কৃতজ্ঞতা : জাহিদ তুষার


Leave a reply