Select Page

আঞ্চলিক রাজনীতির ছবি ‘বিরোধ’

আঞ্চলিক রাজনীতির ছবি ‘বিরোধ’

বিরোধ; পরিচালক: প্রমোদ চক্রবর্তী; শ্রেষ্ঠাংশে: শাবানা, রাজেশ খান্না, মাস্টার টাপু, অশোক কুমার, গোলাম মুস্তাফা, সৈয়দ হাসান ইমাম, অনুপ কুমার, বিপ্লব প্রসাদ, প্রেম চোপড়া প্রমুখ; উল্লেখযোগ্য গান: তোর আঁচলে মমতারই ছায়া, আজও বয়ে চলে পদ্মা মেঘনা, চোখ তোমার বলে হ্যাঁ; মুক্তি: ৪ নভেম্বর ১৯৮৮

‘আজও বয়ে চলে পদ্মা মেঘনা

বুড়িগঙ্গার ধারা,

শুধু মানুষগুলো এক নেই আর

বদলে গেছে যে তারা’

এন্ড্রু কিশোরের অসাধারণ গায়কীতে এ গানটি ছবির প্রাথমিক পরিচিতি তুলে ধরে। নদী তার নিয়মে বহমান থাকলেও মানুষগুলো আর আগের মতো নেই কারণ তারা স্বার্থের জন্য অন্যায়কে বেছে নিয়েছে দুর্বলকে অত্যাচার করে।

একটা সময় ছিল যৌথ প্রযোজনার ছবি নির্মাণ করতে গেলে অনেক ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হতো। দুই দেশের বিভিন্ন পলিসি পূরণ করে ছবি নির্মাণ করতে হতো। অনেকদিন অপেক্ষা করে ছবির অনুমতি মিলত, শুটিং-এর অনুমতি মিলত এমনকি ছবি মুক্তিতেও সরকারি অনুমতির ব্যাপার ছিল। বাংলাদেশ-ভারত যৌথ প্রযোজনার অন্যতম সেরা ছবি ‘বিরোধ।’ অঞ্জন চৌধুরীর ‘শত্রু’ গল্প থেকে হিন্দি ছবি ‘শত্রু’র (১৯৮৬) বাংলা ডাবিং ‘বিরোধ’ ছবি। প্রযোজনা ছিল দুই দেশের এবং শিল্পী নির্বাচনসহ।

বাংলাদেশ থেকে শাবানার মতো লিজেন্ডারি শিল্পী ছিল নারীপ্রধান চরিত্রে, ভারত থেকে রাজেশ খান্না ছিল প্রধান পুরুষ চরিত্রে। পাশাপাশি গোলাম মুস্তাফা, হাসান ইমাম, প্রেম চোপড়া তো ছিলই।

হরিদাসপুর অঞ্চলকে ঘিরে ছবির গল্প। অঞ্চলটি দুর্নীতি, অবিচার, লুট, খুন এসবে ভরে যায়। অশোক কুমার এ অঞ্চলের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য সাহসী পুলিশ অফিসার রাজেশ খান্নাকে পাঠায়। অফিসার হরিদাসপুরে গিয়ে একটা আঞ্চলিক চক্রের সাথে জড়িয়ে পড়ে। পাশাপাশি তার দেখা হয় বিধবা শাবানা ও ছোটু চরিত্রের মাস্টার টাপুর সাথে। ছবির গল্পের মধ্যে সাসপেন্স আসে ছোটুর বাবা প্রাণলালের গুম হওয়া ও উদ্ধার হবে কিনা সে নিয়ে। বিরোধ চলে অসৎ চক্রের সাথে সৎ মানুষের।

একটা দুর্নীতিযুক্ত অঞ্চলকে চেনার জন্য কাঁচাবাজারের দৃশ্য থেকেই শুরু করা যেতে পারে। লাউ কিনে পয়সা না দিয়ে চলে যায় থানার কনস্টেবল। লাউওয়ালা টাকা চেয়ে পায় না। কনস্টেবল চলে যেতে চাইলে পেছন থেকে হাত পড়ে রাজেশ খান্নার। তারপর অবস্থা বেগতিক দেখে পয়সা দিতে বাধ্য হয়।

একদিনে তো পুরো প্রশাসনকে পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। তাই ধীরে ধীরে চলে রাজেশ খান্নার যুদ্ধ। হরিদাসপুরের একচ্ছত্র অধিপতি প্রেমচোপড়া সমস্ত অঞ্চলকে নিজের কব্জায় রেখে দিয়েছে। তার কবল থেকে উদ্ধার করতে বেগ পেতে হয় রাজেশ খান্নাকে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে যাকে বলে ‘লাল ফিতার দৌরাত্ম্য’ যার মধ্যে সমাজ ও রাষ্ট্রের আইনবিভাগ অশুভ শক্তির হাতে বন্দী থাকে তার আধিপত্য ভাঙা মুশকিল। আইনের রক্ষক কনস্টেবলই হয়ে যায় প্রেমচোপড়ার গোপন খবর পৌঁছানো ব্যক্তি যে বিনিময়ে পায় ঘুষ। এভাবেই দুর্নীতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ে।

ছবির চমৎকার অংশটি রাজেশ খান্না ও ছোটু চরিত্রের শিশুশিল্পী মাস্টার টাপুর দারুণ সম্পর্ক। ছোটুর সাথে তার পরিচয় হয় ঢিল খাওয়ার মাধ্যমে। ঢিল ছোঁড়ার কারণ পুলিশ তার বাবাকে ধরে নিয়ে গেছে কিন্তু ছাড়ছে না। বাবাকে ছেড়ে দেয়ার কথা বলে রাজেশ খান্না। তার সাথে ছোটুর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয় তাই ছোটু মিষ্টি করে বলে ‘ও পুলিশ, আমার বাবাকে ছেড়ে দাও।’ আনন্দ-বেদনা দুটোই ঘটে তাদের সম্পর্কে।

ছোটু ভাত খায় না অনেকদিন হয়। রাজেশ খান্না ভাত খেতে বসলে ছোটুকে দেখে থালার মধ্যে। চিঠি পৌঁছে দিলে বাবা ভাত পাঠাবে এ খুশিতে থাকে ছোটু। ভাতটা পাঠিয়ে দেয় রাজেশ খান্না আর আড়াল থেকে দেখে ছোটুর ভাত খাওয়ার আনন্দ। ঋণশোধ করতে কাজ করে পেয়ারা নিয়ে আসে পুলিশের জন্য। কিন্তু একটা দূরত্ব থাকে তাদের মধ্যে কারণ রাজেশ খান্না জানে ছোটুকে ভুলিয়ে রাখতে হবে বাস্তবকে এড়াতে কেননা তার বয়সটা বাস্তব মেনে নেয়ার মতো না। এরকম নিষ্পাপ একটা অম্ল-মধুর সম্পর্ককে দেখানো হয়।

ছবির আরেকটি স্ট্রং পার্ট বিধবা শাবানা ও ছোটুর মা-ছেলের সম্পর্ক। ছেলের অধিকারটুকু ছোটু নিজেই আদায় করে নেয় গানে গানে –

‘তোর আঁচলে মমতারই ছায়া

চোখে সজল ঐ মেঘ কাজল মায়া

যে তোর প্রাণেরই দুলাল যেন বাঁচে কোটি সাল

বয় সে সোনা হায়রে তোর আঁচলে

*****

দুধের কেমন স্বাদ গেছি ভুলে

কেউ বাসি ভাতও দেয় না রে মোর মুখে তুলে’

ছোটুর বাস্তব অবস্থাই শাবানার সাথে তার মা-ছেলের পবিত্র সম্পর্ক তৈরি করে। রাজেশ খান্না সে সম্পর্কে আসে ছোটুর রক্ষক হিসেবে আর শাবানার সাথে পরিচয় পথে হেনস্তার সময় তাকে বাঁচানোর পর হয়।

খলনায়ক প্রেম চোপড়ার সাথে রাজেশ খান্নার অসাধারণ কমেডি ও স্যাটায়ারে ভরা সংলাপ নায়ক-খলনায়ক রসায়ন জমিয়ে তোলে। সব শিল্পী যার যার ভূমিকায় পেশাদার অভিনয় করে ছবিটিকে করেছে অভিনয়সমৃদ্ধ। 

হিন্দি ছবিটিতে এন্ড্রু কিশোরের প্লেব্যাক ছিল অসাধারণ। বাংলা ডাবিং-এও তার কণ্ঠের জাদু বজায় থেকেছে। প্রথম গানটি ছাড়াও ‘চোখ তোমার বলে হ্যাঁ/ মুখে কেন বলো না’ এ গানটিও তাঁর নিজস্ব গায়কীর স্টাইলে দারুণ উপভোগ্য।

ছবির শেষদিকে রাজেশ খান্নার দেয়া গুরুত্বপূর্ণ সংলাপটি ছবির বক্তব্য-’যেদিন দেশে অন্যায়, অত্যাচার, রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব এসবের বিরুদ্ধে সত্যিকারের ন্যায়বিচার ও প্রতিবাদ আসবে সেদিন দেশের সব ঠিক থাকবে।’ কাজটা একদিনে হবার কথা নয়। তাই সমস্ত আঞ্চলিক রাজনীতির বিরোধকে মেটাতে একজন করে সৎ মানুষ জরুরি। আশির দশকে নির্মিত এ ছবি আজকের সমাজের জন্যও মেসেজ দেয় এটাই ছবিটির শক্তি।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র গত শতকে যেভাবে সমৃদ্ধ ছিল সেই সমৃদ্ধির দিকে আবারও যেতে প্রতিদিনই স্বপ্ন দেখি। সেকালের সিনেমা থেকে গ্রহণ বর্জন করে আগামী দিনের চলচ্চিত্রের প্ল্যাটফর্ম গড়ে উঠুক। আমি প্রথমত একজন চলচ্চিত্র দর্শক তারপর সমালোচক হিশেবে প্রতিষ্ঠিত হবার স্বপ্ন দেখি। দেশের সিনেমার সোনালি দিনের উৎকর্ষ জানাতে গবেষণামূলক কাজ করে আগামী প্রজন্মকে দেশের সিনেমাপ্রেমী করার সাধনা করে যেতে চাই।

মন্তব্য করুন