Select Page

আবুল হায়াত, চলচ্চিত্রে যার উজ্জ্বল উপস্থিতি

আবুল হায়াত, চলচ্চিত্রে যার উজ্জ্বল উপস্থিতি

আবুল হায়াত বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে কিংবদন্তি একজন অভিনেতা। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে তিনি অভিনয় করে যাচ্ছেন। নাটকে তাঁর অনন্য অবস্থানের পাশাপাশি চলচ্চিত্রেও তিনি আলাদা ক্যারিয়ার গড়েছেন।

উল্লেখযোগ্য ছবি : অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী, তিতাস একটি নদীর নাম, পালঙ্ক, চরিত্রহীন, বধূ বিদায়, কেয়ামত থেকে কেয়ামত, অবুঝ দুটি মন, আগুনের পরশমণি, মহা গ্যাঞ্জাম, স্বপ্নের ঠিকানা, অপরাজিত নায়ক, পাগলা বাবুল, অপহরণ, শঙ্খনীল কারাগার, আদরের সন্তান, বীর সন্তান, বাবা কেন চাকর, প্রাণের চেয়ে প্রিয়, আবদুল্লাহ, সুখের ঘরে দুঃখের আগুন, পাগলীর প্রেম, তেজী, শেষ প্রতীক্ষা, মনের মিলন, স্বপ্নের পুরুষ, অনন্ত ভালোবাসা, আমার প্রতিজ্ঞা, সবাইতো সুখি হতে চায়, বর্ষা বাদল, মহা সংগ্ৰাম, প্রেমের নাম বেদনা, প্রেমের তাজমহল, জয়যাত্রা, আমার স্বপ্ন তুমি, দজ্জাল শাশুড়ি, খেলাঘর, রূপকথার গল্প, দারুচিনি দ্বীপ, রাবেয়া, থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নাম্বার, অজ্ঞাতনামা, রাত জাগা ফুল।

আবুল হায়াত ক্যারিয়ারে বাণিজ্যিক ছবিতেই বেশি অভিনয় করেছেন। যে কোনো ভাবেই বাণিজ্যিক ছবিতে তার সেরা কাজ ‘আগুনের পরশমনি’। হুমায়ূন আহমেদের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এ ছবিতে আবুল হায়াত একজন সরকারি চাকুরিজীবী যিনি তার পরিবার নিয়ে থাকেন। প্রতি মুহূর্তে উৎকণ্ঠা নিয়ে বসবাস। অফিসে যাবার পথে লাশ দেখেন, পানের দোকানে দাঁড়িয়ে ভাবেন কী হচ্ছে দেশে। তার বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধা আসাদুজ্জামান নূরকে স্থান দেন। নূর গুলিতে আহত হলে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন। যখন ডাক্তারের প্রয়োজন পড়ে কারফিউর মধ্যেও বের হয়ে যান বাড়ি থেকে বলেন-‘আমার একটা ডাক্তার লাগবে, ছেলেটার কষ্ট আমি আর সহ্য করতে পাচ্ছি না।’ এভাবে তিনি হয়ে ওঠেন মানবিক একটি চরিত্র এ ছবির।

কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছবিতে সালমান শাহ-র বড়বাবা চরিত্রে তার অভিনয় অসাধারণ। সালমানের বাবা রাজিব যখন সালমানকে মৌসুমীকে ভোলার জন্য বলে আবুল হায়াত সালমানের পাশে থাকে। ‘আদরের সন্তান’ ছবিতে তিনি দায়িত্বশীল বাবা। ইলিয়াস কাঞ্চন মিথ্যা ছিনতাইয়ের অভিযোগে জেলে গেলে সেটা জানাজানি হয় এরপর সাদেক বাচ্চু সেটার সুযোগ নিয়ে তার গুণ্ডা ছেলের সাথে আবুল হায়াতের মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব দিলে নাকচ হয়। এতে সাদেক বাচ্চু আবুল হায়াতকে চড় মেরে ফেলে দেয় রাস্তা থেকে খাদে। এ অপমানের জ্বালায় আবুল হায়াত আত্মহত্যা করে। এ ছবিতে তার চরিত্রটি খুবই স্পর্শকাতর ছিল।

‘মহা গ্যাঞ্জাম’ ছবিতে আবুল হায়াতের চরিত্রটি ইন্টারেস্টিং ছিল। গ্রাম থেকে আসা ববিতা ও ইলিয়াস কাঞ্চনের সাথে তিনি তাঁর ছেলেমেয়ে অরুণা বিশ্বাস ও মাহমুদ কলির বিয়ে দেন কৌশলে কারণ ছেলেমেয়েরা বেহিসেবি জীবনযাপন করে। নাটকীয়তা শুরু হয় এরপর। আবুল হায়াত শক্ত হাতে সব সমাধান করেন। ‘স্বপ্নের পুরুষ’ ছবিতে আবুল হায়াত বাবা হিসেবে ছিলেন অনবদ্য। শাবনূর তার মেয়ে থাকে। বাবা-মেয়ের সম্পর্কের এত অসাধারণত্ব মুগ্ধ করার মতো। একটা সিকোয়েন্সে আবুল হায়াত গ্রামে যায় শাবনূরকে নিয়ে। গ্রামের কাদামাটির পথে গাড়ি আটকে গেলে হেঁটে যেতে হয়। শাবনূর হাঁটতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে যায় এরপর আবুল হায়াতও পড়ে যায়। কাদামাখা শরীরে বাবা, মেয়ে দুজন দুজনার দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকে। শাবনূরের বিয়ের পাত্র দেখানোর সময় সাদেক বাচ্চুর ষড়যন্ত্রে রিয়াজকে অন্য মেয়ের ছবি দেখানো হলে রিয়াজ নাক বোঁচা বলে এতে আবুল হায়াত শাবনূরকে নিয়ে বলেছে বলে খুব কষ্ট পায়। শাবনূরকে এটা জানানোর পর নিজেই বেশি কষ্ট পায়। বাবা হিসেবে তিনি এ ছবিতে এভাবেই অসাধারণ হয়ে ওঠেন।

‘বাবা কেন চাকর’ ছবিতে নায়করাজ রাজ্জাকের বন্ধু থাকেন তিনি। রাজ্জাকের সাথে তার তুই তোকারি সম্পর্ক উপভোগ্য ছিল। ‘প্রেমের নাম বেদনা’ ছবিতে তাঁর গেটআপ ছিল অন্য ছবির থেকে আলাদা। মদের ব্যবসা করত পতিতালয়ে। সেখানে বাপ্পারাজ মদের জন্য তাঁকে বাবা ডাকতে গেলে তিনি জানান-‘আমি কারো বাবা হবার যোগ্য না।’ ‘দারুচিনি দ্বীপ’ ছবিতে ইমনের বাবা থাকেন। দারিদ্র্যের সংসারে ছেলে সেন্টমার্টিন যাবার বায়না করলে সেটা নিয়ে আফসোস করেন কারণ ছেলের সামান্য আবদারও তিনি মেটাতে পারেন না এবং দুঃখ করে বলেন-‘কাজী নজরুল ইসলাম সাহেব দেখে যান দারিদ্র্য আমাকে কত মহান করেছে।’ ‘অজ্ঞাতনামা, ফাগুন হাওয়ায়’ তার শেষের দিকের ছবি এবং সর্বশেষ অভিনীত ছবি ‘রাত জাগা ফুল’-এ শিক্ষক ছিলেন। তাঁকে নিয়ে মীর সাব্বিরের সংলাপ ছিল-‘উনি তো মাস্টার, মাস্টার হইল জোনাকি পোকা, আলো ছড়ান।’

আবুল হায়াত নেগেটিভ চরিত্রও করেছেন বাণিজ্যিক ছবিতে। ‘থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নাম্বার’ ছবিতে তার নেগেটিভ রোল সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল। তিশাকে বাড়িভাড়া পাইয়ে দিতে তাকে বিরক্ত করা শুরু করে। তিশা কাজে যাবার সময় তার পথে পানের পিক ফেলে আর নারীলোভী দৃষ্টিতে তাকায়। অসাধারণ অভিনয় ছিল। অপরাজিত নায়ক’ ছবিতে ইলিয়াস কাঞ্চনের পরিবার ধ্বংসের জন্য আদালতে তিনি মিথ্যা সাক্ষী দেন হুমায়ুন ফরীদির কাছে ঘুষ নিয়ে। কাঞ্চন জেল থেকে পলাতক হবার পর এক পার্টিতে আবুল হায়াতকে খুন করে।

এছাড়া ‘আমার স্বপ্ন তুমি’ ছবিতে ছেলে ফেরদৌসকে অন্যত্র বিয়ে দিতে ষড়যন্ত্র করেন তিনি। শাবনূরকে ফেরদৌস বিয়ে করলে সেটা মেনে নিতে পারেন না তিনি। এটিএম শামসুজ্জামান তার বেয়াই হলেও অপমান করে তাড়িয়ে দেন তাঁকে কারণ তাঁর পূর্বপুরুষ তাঁদের বাড়ির চাকর ছিলেন এবং এটা বলে এটিএমকে খোটা দেন চূড়ান্ত অপমান করে তাড়িয়ে দেবার আগে। নেগেটিভ চরিত্রেও তিনি অনবদ্য পজেটিভের পাশাপাশি।

২০০৭ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান ‘দারুচিনি দ্বীপ’ ছবিতে।

আবুল হায়াত আমাদের অভিনয়জগতের গর্ব। তিনি চলচ্চিত্রে যে ক্যারিয়ার গড়েছেন তা যে কোনো অভিনেতার জন্য আদর্শ যারা আগামীতে এ অঙ্গনে তাঁর মতো চরিত্রে কাজ করতে চাইবে।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র গত শতকে যেভাবে সমৃদ্ধ ছিল সেই সমৃদ্ধির দিকে আবারও যেতে প্রতিদিনই স্বপ্ন দেখি। সেকালের সিনেমা থেকে গ্রহণ বর্জন করে আগামী দিনের চলচ্চিত্রের প্ল্যাটফর্ম গড়ে উঠুক। আমি প্রথমত একজন চলচ্চিত্র দর্শক তারপর সমালোচক হিশেবে প্রতিষ্ঠিত হবার স্বপ্ন দেখি। দেশের সিনেমার সোনালি দিনের উৎকর্ষ জানাতে গবেষণামূলক কাজ করে আগামী প্রজন্মকে দেশের সিনেমাপ্রেমী করার সাধনা করে যেতে চাই।

মন্তব্য করুন