Select Page

ইতিবাচক চরিত্রের রাজিব

ইতিবাচক চরিত্রের রাজিব

একজন কিংবদন্তি অভিনেতা সব ধরনের চরিত্রে অভিনয় করেই নিজেকে কিংবদন্তি পর্যায়ে পৌঁছান। রাজিব আমাদের চলচ্চিত্রের গর্বিত একজন অভিনেতা। তাঁর কিংবদন্তি ইমেজ চলচ্চিত্রে পজেটিভ ও নেগেটিভ দুই ধরনের চরিত্রেই এগিয়েছে। এ লেখায় পজেটিভ চরিত্রের রাজিবকে দেখানো হচ্ছে। পজেটিভ চরিত্রে রাজিবের অভিনয় এত বাস্তব যে নেগেটিভ চরিত্রের সুপরিচিত রাজিবকে যেন এখানে অচেনা মনে হয়।

স্নেহের প্রতিদান : এ ছবিতে যৌথ পরিবারের প্রধান কর্তা থাকেন রাজিব। ডলি জহুরের বিপরীতে ছিলেন। ইলিয়াস কাঞ্চন বাড়ির কাজের ছেলে হলেও তাকে অনেক স্নেহ করেন। বাড়িতে অন্যান্য ভাইভাবীরা কাঞ্চনকে সহ্য করতে পারত না। একদিন চুরির দায়ে কাঞ্চনকে অভিযুক্ত করা হলে পরিস্থিতির চাপে রাজিব কাঞ্চনকে চোর বলে। কাঞ্চন কষ্ট পেয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যায় এবং নতুন জায়গায় নিজের পরিস্থিতিতে আরেকজনকে দেখে তার ভুল ভাঙে। মূলত তাকে বাড়ির অন্যান্যদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যই দোষারোপ করে বাড়ি থেকে তাকে চলে যেতে বলেছে যাতে সে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে। কাঞ্চনের ভুল ভাঙলে সে রাজিবকে খুঁজতে থাকে। ততদিনে দেনার দায়ে রাজিব বাড়িছাড়া হয়। একসময় মাজারে খাবার দিতে গিয়ে সেখানে রাজিবকে পায়। ডলি জহুরের মৃত্যুর পর রাজিব তার স্বার্থপর সেই ভাইদেরকে আবার পায় কাঞ্চনের বদৌলতে। কাঞ্চন তাদেরকে ক্ষমা করতে বললেও রাজিব চায় না কারণ তাঁর বোন দিতিকেও ভাইয়েরা অপমান করেছিল। শেষ পর্যন্ত রাজিব তাঁর মাকে দেয়া কথাকে স্মরণ করে যেখানে যে-কেনো পরিস্থিতিতে ভাইবোনদের আগলে রাখার কথা দিয়েছিল। এরপর হার্টঅ্যাটাকে রাজিবের মৃত্যু হয়। পুরো ছবিতে রাজিবই যেন পজেটিভ চরিত্রে প্রতাপের সাথে অভিনয় করে ছবির অন্যতম আকর্ষণ হয়ে ওঠে।

বিদ্রোহ চারিদিকে :

  • নূরী?
  • কে?
  • আমি। কদমরসুল। এভাবে সমাজের ঠোকর খেয়ে তুই বাঁচতে পারবি না রে নূরী। তোর ভেতরের নূরীকে জাগিয়ে তোল। এই নূরীকে মেরে ফেল।
  • হ, আমারে বাঁচতে হইলে নতুন নূরীর জন্ম দিতে হইব।
    এ ছবিতে সমাজের ঠোকর খাওয়া পপিকে নূরী থেকে নূর মোহাম্মদ হয়ে ওঠার জন্য সাহস দেন কদম রসুল চরিত্রের রাজিব। পজেটিভ চরিত্রে রাজিবের অন্যতম সেরা চরিত্র এটি। ছবির সেরা গান ‘মোরা নিরন্ন বড় ক্ষুধার্তত’-র এন্ড্রু কিশোরের লিপে রাজিব ছিলেন অসাধারণ। এমন চরিত্র এখনকার চলচ্চিত্রে দেখা যায় না।

হাঙর নদী গ্রেনেড :
‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ ছবির উল্লেখযোগ্য চরিত্রে ছিলেন লিজেন্ড রাজিব। হলদী গাঁয়ের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের সময় যখন পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর বিপ্লব চলছে রাজিব তরুণদের সংঘবদ্ধ করতে ভূমিকা রাখেন।
সুচরিতা রাজিবের কাছে দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চান। তখন রাজিব বলেন-‘আমরা নির্বাচনে জিতেছি। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানিরা আমাদের ক্ষমতা দিতে চায় না। অনেকদিন ধরে লুটেপুটে খাচ্ছে তো! খাওয়াব, ভালো কইরে খাওয়াব এবার।’ তাঁর এই স্টেটমেন্টটি ছবির পলেটিক্যাল সিচুয়েশনকে ব্যাখ্যা করে। পূর্ব পাকিস্তানের উপর পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণের চিত্রটি ফুটে উঠেছে রাজিবের সংলাপে। সুচরিতা প্রথমে বুঝতে পারেন না কিন্তু সময় যত এগিয়ে যায় তাঁর কাছেও সব পরিষ্কার হয়ে যায়। রাজাকার চরিত্রে থাকা নাসির খানের কারণে রাজিব ধরা পড়ার পর তাকে মারধর করা হয়। সুচরিতা দেখতে গেলে বলেন-‘ব্যথা কি গায়ে না মনে?’ রাজিবের উত্তর-‘গায়ে।’ এই সংলাপটিও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। সংলাপে দেশের মানুষের উপর শোষণটাকে ‘গা’ শারীরিক শোষণ বলা হয়েছে আর মনটা ছিল বিপ্লবী ভূমিকায়। এভাবে রাজিবের চরিত্রটি ছবিতে মিনিংফুল হয়ে ওঠে।

অন্তরে অন্তরে : মৌসুমীর বাবার চরিত্রে মাঝির ভূমিকায় ছিলেন। আনোয়ারা তাদের মালিক। একাকীত্ব ঘোচাতে একদিন রাজিবের কাছ থেকে ছোট্ট মৌসুমীকে চেয়ে নেয় আনোয়ারা। মেয়ের ভালো থাকার কথা চিন্তা করে দিয়ে দেন রাজিব। এরপর সালমান শাহর সাথে মৌসুমীর প্রেম হবার পর বাধা আসে। আনোয়ারা মৌসুমীকে প্রাসাদ থেকে তাড়িয়ে দেয় এবং রাজিবকে মেয়ের অপরাধের কথা বললে রাজিব প্রতিবাদ করে বলেন-‘আমার মেয়ে একাই ভালোবেসেছে? দোষী হলে তো সেও হবে।’ মৌসুমীর বাবার চরিত্রে অসাধারণ ছিলেন।

অপরাজিত নায়ক : এ ছবিতেও যৌথ পরিবারের বাড়ির প্রধান কর্তা থাকেন রাজিব। রাজিবের সাথে শত্রুতা বাঁধে হুমায়ুন ফরীদির। তাঁর শত্রুতায় একে একে স্ত্রী, বোনকে হারান রাজিব। নিজেও খুন হন ফরীদির হাতে। পরে ভাই ইলিয়াস কাঞ্চন প্রতিশোধ নেয়। এ ছবিতেও রাজিবের পজেটিভ চরিত্র অনবদ্য।

প্রেম পিয়াসী : শাবনূরের বাবার চরিত্রে থাকেন। সালমান শাহর সাথে শাবনূরের প্রেম হলে মুসলমান, হিন্দু দুই ধর্মের সমস্যা সামনে আসে। সালমান, শাবনূর তাদের পরিণতি বেছে নেয় মৃত্যুর মাধ্যমে। শাবনূর বিষ খেয়ে মৃত্যুর পর রাজিব হাহাকার করতে থাকে। একজন অসহায় বাবার চরিত্রে রাজিব ছিল অসাধারণ।

শেষ ঠিকানা : এ ছবিতে শাবনূরের ভাইয়ের চরিত্রে রাজিব। শাবনূরের ভালোমন্দ সব দিক নিয়ে চিন্তিত থাকেন। সন্তানের মতো আগলে রাখেন। শাবনূর অমিত হাসানকে ভালোবাসে। ভালোবাসার মাঝখানে বাস্তবতা চলে আসে। শাবনূর নিজের ওপর নিজে অত্যাচার করতে থাকলে রাজিব তাকে আরো আগলে রাখে। স্নেহশীল ভাইয়ের চরিত্রে অসাধারণ ছিলেন।

ঘায়েল : এ ছবিতে ওমর সানীর বাবা ও পুলিশ অফিসারের রাজিব। সানী সমাজের চাপে অপরাধজগতে চলে যায়। বন্ধুহত্যার প্রতিশোধ ও সন্ত্রাস দমনের জন্য অন্ধকার পথে যায়। একসময় রাজিবও সেই পথে চলে যান বাধ্য হয়ে। বাবা ও ছেলের অন্যরকম মিলনের করুণ পরিস্থিতি তৈরি হয়।

অন্ধ ভালোবাসা : মৌসুমীর বাবার চরিত্রে এবং ডলি জহুরের স্বামীর চরিত্রে ছিলেন। মৌসুমী তার আদরের মেয়ে, তার স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে ইলিয়াস কাঞ্চনের সাথে বিয়ে দেন। পরে কাঞ্চনের নকল বাবা মিজু আহমেদের ষড়যন্ত্রে কাঞ্চন জেলে যায় আর মৌসুমী বাড়িছাড়া হয়। রাজিব পাগল হয়ে ডলি জহুরেরই আশ্রয়ে যায় যখন তাদের মধ্যে অনেকদিন কোনো যোগাযোগ থাকে না। ডলি জহুর পায়েশ রান্না করে দেয় আর সেই পায়েশ খেয়ে রাজিব ডলিকে মনে করেন। সেখানেই তাদের পরিচয় ঘটে এবং মৌসুমীও ঘটনাচক্রে সেখানেই যায় ও মা ডলি জহুরকে পায়। রাজিব পায়েশ খাওয়ার মুহূর্তে হার্ট টাচিং অভিনয় করেন।

জিদ্দি : জসিমের ভাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করেন। জসিম আহমেদ শরীফের চক্রান্তে জেলে গেলে বোন কবিতাকে শত্রুপক্ষই কৌশলে বিয়ে করে। তাদের হাতে কবিতার মৃত্যু হলে আদালতে মামলাতেও হেরে যায় তারপর খুন হন রাজিব। বোকা, সরল চরিত্রে একদম মিশে গিয়েছেন এ ছবিতে।

আব্বাজান : এ ছবিতে ‘আমার মরণকালে কাঁদবে যে জন’ গানে রাজিবের পজেটিভ চরিত্রের অভিনয় লাজবাব। কে বলবে তিনি একজন ভিলেন! মান্নার ‘আম্মাজান’ ছবির ব্যাপক পরিচিতি ও সাফল্যের পর ‘আব্বাজান’ নামেও ছবি হয় এবং এ চরিত্রে ছিলেন রাজিব। মান্নার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ অভিনয়ে কিছুসময় নেগেটিভ মনে হবে কিন্তু আদতে এটি পজেটিভ চরিত্রই ছিল। শেষের মৃত্যুদৃশ্যে রাজিব ও মান্না দুজনের অভিনয়ই ছিল অসাধারণ।

অন্যমানুষ : ক্যারিয়ারের শেষ ছবি ছিল এটি। এ ছবিতে কাজী মারুফের ফাদারের চরিত্রে ছিলেন। মারুফকে মানুষ করেন তিনি। হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করে মারুফ। সহজ-সরলের জন্য পদে পদে সমস্যায় পড়ে মারুফ পরে তার জীবনে শাবনূর আসে সহপাঠী হিসেবে। রাজিব মারুফকে বলেন শাবনূরকে আগলে রাখতে সে তার স্বপ্ন পূরণ করতে এসেছে বলে যান। শাবনূর শাকিল খানকে ভালোবাসলে মারুফ তা সহ্য করতে পারে না সে খারাপ সিদ্ধান্তে যাবার কথা রাজিবকে বললে রাজিব তা সমর্থন করেন না। মারুফ রাজিবকে জোরে চেপে ধরে নিজের ভালোবাসা জোর করে আদায়ের কথা বলতে থাকে এবং একসময় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে রাজিবের মৃত্যু হয়। শেষ ছবিতেও অসাধারণ চরিত্র ও অভিনয় ছিল তাঁর। ডাবিং নিজে করে যেতে পারেননি অন্য কণ্ঠ ব্যবহৃত হয়েছিল।

এভাবেই একজন কিংবদন্তি রাজিব পজেটিভ চরিত্রেও নিজের অপ্রতিদ্বন্দ্বী ইমেজ তুলে ধরেছেন। তিনি এসব চরিত্রেও অমর হয়ে থাকবেন।


About The Author

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র গত শতকে যেভাবে সমৃদ্ধ ছিল সেই সমৃদ্ধির দিকে আবারও যেতে প্রতিদিনই স্বপ্ন দেখি। সেকালের সিনেমা থেকে গ্রহণ বর্জন করে আগামী দিনের চলচ্চিত্রের প্ল্যাটফর্ম গড়ে উঠুক। আমি প্রথমত একজন চলচ্চিত্র দর্শক তারপর সমালোচক হিশেবে প্রতিষ্ঠিত হবার স্বপ্ন দেখি। দেশের সিনেমার সোনালি দিনের উৎকর্ষ জানাতে গবেষণামূলক কাজ করে আগামী প্রজন্মকে দেশের সিনেমাপ্রেমী করার সাধনা করে যেতে চাই।

Leave a reply