
এশা মার্ডার: দ্য এমেচার ড্রাফটিং
ফিল্মের সাথে সাহিত্যের বড় পার্থক্যের জায়গা, সাহিত্যে প্লট আর স্টোরিলাইন ঠিকঠাক হলেও সাবস্ক্রাইবার তাতে এনগেজ হতে পারে, ফিল্মের ক্ষেত্রে এ দুটো ঠিকঠাক হওয়াই যথেষ্ট নয়, ক্ষেত্রবিশেষে দুর্বল হলেও উতরে যেতে পারে যদি মাস্টারি দেখানো যায় স্ক্রিনপ্লে তে।

‘এশা মার্ডার’ দেখবার পরে স্বত:স্ফূর্ত উপলব্ধিই ছিলো, আমাদের ফিল্মমেকাররা প্লট-স্টোরি-স্ক্রিনপ্লে এর পার্থক্য বুঝতে পারেন না অনেকেই, যে কারণে একই সাথে তিনটা স্বতন্ত্র ইউনিটকে পারফেকশন দিতে না পেরে তাদের কাজগুলো রূপ পায় ‘প্রিম্যাচিউর এজাকুলেশনে’!
এশা মার্ডারের প্লট সুপার্ব, স্টোরিলাইন অপরিশীলিত, স্ক্রিনপ্লে এমেচার; যে কারণে ‘ হলেও হতে পারত কাল্ট ক্লাসিক’—- আক্ষেপই এ ফিল্মের জন্য যথার্থ লেবেলিং!
যেহেতু নিজে ফিল্মমেকার নই, ফিল্ম ক্রিটিক হিসেবেও একাডেমিক স্কুলিং নেই, তাই ভাবলাম প্লট-স্টোরিলাইন-স্ক্রিনপ্লে বিষয়ে ফিল্মলাইনের খ্যাতিমানদের ভাষ্য আমদানি করি।
Robert Mckee এর খুবই বিখ্যাত বই, Story: Substance, Structure,Style and the Principles of Screenwriting, এখানে তিনি অভিমত দেন-
“The difference between story and plot is the difference between living and telling. A screenplay is neither — it’s a blueprint for the telling on screen.”
৬টি একাডেমি এওয়ার্ড জেতা পরিচালক Billy Wilder এর ভাবনাও আমার সাথে মিলে-
“The best screenplay is the one where you don’t hear the writer. You hear the characters.”
তবে আদতে আমি যা বলতে চাই তার প্রায় সবটাই কভার করে পরিচালক ও স্ক্রিনরাইটার পল থমাস এন্ডারসনের দুই অভিমতে,
১.” Screenwriting is not real writing. You’re not writing a book… leave room for an actor to do something… an actor could take over… a camera could take over… it becomes invisible.”
২.“Start with characters, not theme or meaning upfront… let story naturally emerge.”
‘এশা মার্ডার’ ক্রাইম থ্রিলার ঘরানার সাইকোলজিকাল ড্রামা।
এশা নামের এক নার্স শিক্ষার্থী খুন হয়, তার শরীরের ত্রিশের অধিকবার ছুরিকাঘাত করা হয়, বিচ্ছিন্ন মাথা নিয়ে যায় ঘাতক, এবং খুনের পূর্বে ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায়। সেই খুনের তদন্তে আসে নারী পুলিশ কর্মকর্তা যার শৈশব-কৈশোর কেটেছিল এশাদের এলাকায়, এবং বয়:সন্ধিকালে সেও ধর্ষিত হয়েছিল স্কুলের শিক্ষকের দ্বারা, যে ট্রমা এখনো বয়ে বেড়ায়৷ এশার পটেনশিয়াল খুনি হিসেবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় ৩ জনকে যাদের প্রত্যেকেরই শক্ত মোটিভ থাকা সম্ভব৷
এক পর্যায়ে উন্মোচিত হয় এক সাইকোপ্যাথের চেহারা, যে বিভিন্ন নারীকে বিশেষ ধরনের কেক পাঠিয়ে প্রেম নিবেদন করে ভ্যালেন্টাইন ডে তে, প্রত্যাখ্যাত হয়ে ধর্ষণের পরে হত্যা করে। আমরা জানতে পারি সেই খুনি একজন চিকিৎসক, যার সাইকোপ্যাথ হবার ব্যাকস্টোরি দেখানো হয়, যদিও সেটা স্টোরি হিসেবে কনভিন্সিং নয় তেমন। এবং অন্তিম দৃশ্যে এশার বাড়িতে যায় পুলিশ কর্মকর্তা, কন্যা এবং স্ত্রী বিয়োগে বিধ্বস্ত এশার বাবা, এবং আমরা জেনে যাই ইনিই সেই মলেস্টর শিক্ষক! পুলিশের করণীয় কী আসলে- বীভৎস খুনের শিকার এক কন্যার পিতার প্রতি সহমর্মী হবে, নাকি সারাজীবন যার ট্রমা বয়ে বেড়াচ্ছে তার ন্যাচারাল পানিশমেন্টে তৃপ্তি বোধ করবে!
—- এই প্লট এবং স্টোরিলাইনে যদি মালায়লাম ইন্ডাস্ট্রিতে ফিল্মটা নির্মিত হত, প্রথমেই নামটা দিতে ঘ্যাচাং করে কেটে৷ ‘এশা মার্ডার: কর্মফল’- নামটা একদম স্ট্রেইটকাট, শৈল্পিক-কমার্শিয়াল কোনো আঙ্গিকেই আবেদন তৈরি করে না।
দ্বিতীয়ত লিড রোলে বাঁধনের মতো কাউকে কাস্টিং করত না। বাঁধনকে বহুবছর পরে দেখলাম, তার আপডেট জানি না। তবে তার ফেসিয়াল কম্পোজিশনে তুমুল পরিবর্তন এসেছে, যা আমার লেন্সে নেগেটিভ পোরট্রে হিসেবে এসেছে। ইদানীং অনেকেই এন্টি এজিং ট্রিটমেন্ট করে, তার প্রভাব পড়ে চোয়ালে এবং ঠোঁটে। বাঁধন সেরকম কিছু করেছে কিনা জানি না, তবে এফডিসির নিপুণ আক্তার এরকম ট্রিটমেন্ট করেছিল নিউজ পড়েছিলাম৷ তার চোয়াল এবং ঠোঁটের অবস্থার সাথে বাঁধনের কোথাও মিল পেলাম মনে হলো। বাঁধনকে উপযুক্ত কাস্টিং মনে হয়নি আমার।
তৃতীয়ত ক্যারেক্টার সংখ্যা কমিয়ে ক্যারেক্টারের বিল্ড আপ এ নজর দিত। একটা ফিল্মে অনেক বেশি ক্যারেক্টার হয়ে গেলে কোনো ক্যারেক্টারকেই ওয়েল ডিরেক্টেড লাগে না। তারা খাপছাড়া মুভ করতে থাকে শুধু, ভিজুয়াল কম্পোজিশন নষ্ট হয়। বাঁধনের ক্যারেক্টারসহ কোনো একটা ক্যারেক্টারও ঠিকমতো ডিজাইন করা হয়নি, অনেকটা আনস্ক্রিপ্টেড, যে যেখন সেটে উপস্থিত ছিল তাকে নিয়েই একটা সিকুয়েন্স শুট করা হয়েছে। একটা উদাহরণ দিই- পুলিশ টিমে ডিবির একজন সদস্য, এর সঙ্গে ডিবির সিনিয়র অফিসার, আবার পুলিশের সিনিয়র অফিসার৷ সিনিয়র কর্মকর্তা প্রথম থেকেই বাঁধনের উপর নাখোশ, তার এটিচুড বা বডি ল্যাঙ্গুয়েজ এসআই বা হাবিলদারের মতো। এখানকার ডায়নামিক্স থেকে কোনো পারসেপশনই তৈরি হয়নি৷ এশার বাড়িওয়ালা, বান্ধবীর বড় ভাই দুজনই পটেনশিয়াল লম্পট কিন্তু ভীরু। ফ্রেমের প্রতিটি সেকেন্ড হিসেব করে বসাতে হবে। দুটো রিপিটিটিভ ক্যারেক্টার অপ্রয়োজনে সময় নিয়েছে।
চতুর্থত, যেহেতু থ্রিলার কেইস সলভ করার প্রসেসে আরো স্মার্ট এবং ইন্টেলিজেন্ট এপ্রোচ রাখা হত। প্রটাগনিস্ট আসলে কী করেছে! এশার বান্ধবীদের বয়ান মোতাবেক দুজনকে সাসপেক্টকে ধরে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে, বাড়িওয়ালার বয়ান নিয়েছে, আর গাড়িতে চড়ে এখানে-ওখানে চক্কর দিয়েছে৷ যারা প্রচুর থ্রিলার দেখে অভ্যস্ত, তাদের কাছে সমগ্র আয়োজনটাই আনাড়ি মনে হবে।

পঞ্চমত, ফিল্মের বাজেট বাড়িয়ে আরেকটু হাইপ্রোফাইল কাস্টিং করা হত। মিশা সওদাগর গেস্ট এপিয়ারেন্স।তার ট্রেডমার্ক ভয়েস রেখে কেন অন্যকে দিয়ে ডাবিং করানো হয়েছে বোধগম্য নয়৷ সম্ভবত মিশার স্কেজিউল মিলেনি। শতাব্দী ওয়াদুদ, ফারুক আহমেদ, শিল্পী সরকার অপু কি আদৌ কোনো বড নাম৷ এর মধ্যে ফারুক আহমেদ হুমায়ূনীয় ধাঁচের কমেডি চেষ্টা করেছে, যা ফিল্মের মেজাজের সাথে মারাত্মক বেমানান৷ হুমায়ূনের গল্পের সেট আপই থাকত ইউনিক, সেই টেম্পলেট অন্য প্রজেক্টে বসিয়ে দিলে বিদিকিচ্ছিরি দশা হবে। কাস্টিং যদি সব স্ট্রাগলিং আর্টিস্ট পুনর্বাসন কেন্দ্র হয়, লো-বাজেট প্রজেক্ট হিসেবে সেটাও অনেক সময় সফল হয়। সেক্ষেত্রে বাঁধনের ক্যারেক্টারটা আরো অনেক বেশি স্পেস এবং ক্যারিশমার দাবি রাখত, যদিও একাই ফিল্ম টানার মতো ক্যালিবার বাঁধন রাখে কিনা সে সংশয় থেকেও পুরোপুরি মুক্ত হতে পারি না।
এবার বাংলাদেশেই ফিরি। এ ফিল্ম থেকে পিক করার মতো ক্যারেক্টার বললে চারজনকে বেছে নিব।
প্রথমত সাইকোপ্যাথ হিসেবে সৈয়দ এজাজ অতুলনীয়৷ আমার ধারণা বাংলাদেশে যদি চোখওয়ালা কোনো ডিরেক্টর থাকে, এই ফিল্মের পারফরম্যান্স এজাজকে তার স্ক্র্যাপবুকে অবশ্যই জায়গা দিবে৷ আমরা একজন তুখোড় এন্টাগনিস্ট পেতে যাচ্ছি হয়তবা
দ্বিতীয়ত, হাসনাত রিপনকে অনেকদিন ধরেই বিভিন্ন প্রজেক্টে পার্শ্বচরিত্রে পারফর্ম করতে দেখছি। প্রেজেন্স থাকে সামান্য, সুনিপুণভাবে মানিয়ে যায়। হাসনাত রিপন আগামীতে আরো বড় রোল ডিজার্ভ করে।
তৃতীয়ত, এ ফিল্মের সবচাইতে বড় ব্লান্ডার নাম ভূমিকায় অভিনয় করা পূজা এগনেস। এত দুর্বল এক্টিং স্কিল, কেবলই প্রশ্ন জাগিয়ে যায়। বরং এশার বান্ধবী চরিত্রে ইশিকা সাকিনকে অনেক বেশি সপ্রতিভ মনে হয়েছে। সে আরো বেটার স্ক্রিন প্রেজেন্স ডিজার্ভ করে।
চতুর্থত, লুনাটিক রোমিও হিসেবে নাসির ওরফে শরীফ সিরাজ দুর্দান্ত চয়েজ।।
উল্লিখিত ৪ জনই স্কিল্ড আর্টিস্ট। তবে ফিল্মের কমার্শিয়াল পারসপেক্টিভ থেকে দেখলে তারা ৩টা পৃথক ফিল্মে থাকলে আরো বেটার ফোকাস পেত। সব অখ্যাত একই সাথে স্ক্রিনশেয়ার করায় ব্যাপারটা দাঁড়ালো এমন- একজন ফিল্মমেকার ইনভেস্টরকে পিচ করেছে, ইনভেস্টর সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য তাকে একটা লো-বাজেট প্রজেক্ট অফার করেছে; পাশ করলে সিরিয়াস ইনভেস্টমেন্ট। আমি যদি সেই ইনভেস্টর হতাম তবে তাকে ২য় আরেকটা সুযোগ দিতাম স্টোরিলাইনে পাশমার্ক পাওয়ায়, এবং স্ক্রিনপ্লে এর বিষয়ে সর্বোচ্চ কঠোর অবস্থান নিতাম!