Select Page

কণ্ঠরাজ কড়চা

কণ্ঠরাজ কড়চা

‘ভালো থাকা হয় যেন!’- নব্বই দশকের প্রজন্ম রেডিও-র দিনগুলোতে এ লাইনের সাথে পরিচিত না এমন মানুষ কম মিলবে। প্রতিধ্বনি করতে করতে এ লাইনটা চলত। রেডিও-র বিজ্ঞাপনী প্রচারণায় ১৫ মিনিটের বিভিন্ন ছবির কণ্ঠে অংশ নিতেন কণ্ঠরাজ নাজমুল হুসাইন।

১৯৫১ সালের ৩১ আগস্ট জন্ম নরসিংদী জেলার পাহাড়তলীতে। চলচ্চিত্রে পরিচয় সহকারী পরিচালক, প্রযোজক, অভিনেতা, বিজ্ঞাপন কণ্ঠদাতা।

শৈশবে স্বপ্ন ছিল কৃষিবিদ হবার। তাঁর ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড এ বিষয়ে অগ্রণী ছিল। পড়তেন জগন্নাথ কলেজে। একসময় ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। তাঁর আপন মামা কিংবদন্তি পরিচালক খান আতাউর রহমান, ছোটমামা বিখ্যাত ক্যামেরাম্যান খান আরিফুর রহমান এবং কাজিন তখনকার নায়িকা আতিয়া। আতিয়া-র উল্লেখযোগ্য ছবি ছিল ‘শনিবারের চিঠি।’

তিনি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের একজন ‘শব্দসৈনিক।’ নিজেকে এ পরিচয়ে পরিচিত করাতেই সবচেয়ে বেশি
গর্বিতবোধ করতেন।

চলচ্চিত্রে প্রথম কাজ শুরু করেন সহকারী পরিচালক হিসেবে। বিশিষ্ট নাট্যকার মামুনুর রশীদের ‘আরণ্যক’ নাট্যদলে ছিলেন। অভিনয় করেছেন কালজয়ী কিছু নাটকে।

‘শ্রীলঙ্কান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন’ যা একসময় ‘রেডিও সিলন’ নামে পরিচিত ছিল সেই প্রোগ্রামটি নিয়মিত শুনতেন নাজমুল হুসাইন। কণ্ঠের জাদুকরী কারিশমা নিয়ে সেখানে হাজির হতেন আমিন সিয়ানী নামে একজন কণ্ঠদাতা। তাঁকে দেখেই তিনি অনুপ্রাণিত হতেন এবং নিজেও কণ্ঠচর্চা করতেন। স্বপ্ন যে তাঁরও সফল হবে তিনি তখনও জানতেন না।

১৯৭৫ সালটি তাঁর ক্যারিয়ারের বিশেষ বছর হয়ে আসল। এ বছর রেডিওতে চলচ্চিত্রের বিজ্ঞাপন প্রচার শুরু হয়। ফোক-ফ্যান্টাসি ছবির সেরা নির্মাতা ইবনে মিজানকে একদিন নাজমুল হুসাইন ‘গোল্ডেন জুবিলি ডিরেক্টর’ বলে তাঁর ছবির প্রচারণা করতে থাকেন স্টুডিওতে। সেটা পরিচালকের নজরে আসে। তিনি বিষয়টা আমলে নেন এবং কণ্ঠ রেকর্ড করতে চান। যেই কথা সেই কাজ। পরে ছবির প্রচারণার জন্য এটা পাবলিক করা হলে দর্শক ব্যাপকভাবে গ্রহণ করে। নির্ধারণ হয়ে গেল তার ক্যারিয়ারের নতুন মোড়। বিজ্ঞাপন কণ্ঠদাতা হয়ে তিনি সগৌরবে কাজ শুরু করলেন।

‘নয়ণমনি’ ছবির ১৫ সেকেন্ডের বিজ্ঞাপনে সারাদেশে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। ‘দি রেইন’ ছবির প্রচারণার সময় নাজমুল হুসাইনের নিজের আবিষ্কার করা টাইটেল ‘ফুজি কালার ট্র্যাজেডি’ সারাদেশে হিউজ রেসপন্স পায়। আড়াই মাস চলেছিল এ বিজ্ঞাপন। ১৯৭৮ থেকে রেডিওর পাশাপাশি টিভিতেও বিজ্ঞাপন প্রচার শুরু হয়। আজকে যেমন ‘ট্রেলার’ বলা হয় তখন বলা হত ‘কাটিং।’ ‘মিন্টু আমার নাম’ ছবির প্রথম কাটিং-এ তিনি কণ্ঠ দেন। ‘সাম্পানওয়ালা’ ছবিতে ৪৮ শব্দের বিজ্ঞাপন করা হয়। তখন প্রথমবার ছবিকে ‘বাণীচিত্র’ বলেন তিনিই। যশোরের মণিহার সিনেমাহলকে নিয়ে রেডিও বিজ্ঞাপন করা হয় তাঁর মাধ্যমেই। এটাও সম্পূর্ণ নতুন ছিল। তখনকার অন্যতম সেরা বাণিজ্যিক পরিচালক এ জে মিন্টু বিজ্ঞাপনের কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করতেন। নাজমুল হুসাইন তাঁকে ‘বাণিজ্যিক ছবির মাস্টারমেকার’ উপাধি দিলে দর্শক এটাও ব্যাপকভাবে গ্রহণ করে। এ জে মিন্টু তাঁর ‘সত্যমিথ্যা’ ছবির রজত জয়ন্তী উৎসবে নাজমুল হুসাইনকে সংবর্ধনা দেন।

১৯৮০-তে এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’ ছবিতে নাজমুল হুসাইন প্রধান সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। ‘সুজন সখি’ ছবির রিমেক ‘রঙিন সুজন সখি’-র প্রযোজক ছিলেন তিনি। রিমেকের অনুমতি নিতে তাঁকে পরিশ্রম করতে হয়েছে। রাইট নিতে গিয়ে ফারুক-কবরীর বিকল্প কে হবে প্রশ্ন করা হয়েছিল। তিনি সালমান শাহ-শাবনূরের জনপ্রিয়তার কথা বলেছিলেন। রিমেক করা হয় এবং ছবিটি বিপুলভাবে ব্যবসাসফল হয়।

এতদিন খুঁজেছি যারে
পেয়ে গেছি আজ আমি তারে
‘হ্যাঁ পেয়ে গেছি আজ হেনোলাক্স কমপ্লেক্সন ক্রিম।’ ঠিক এভাবেই সোহেল চৌধুরীর লিপে ‘প্রিয়শত্রু’ ছবির গানটি ব্যবহার হত নাজমুল হুসাইনের হেনোলাক্স ক্রিমের বিজ্ঞাপনী কণ্ঠে রেডিওতে। ‘বেবী লজেন্স সঙ্গীতমালা, সুরে সুরে কেয়া সুপার বিউটি সোপ, হাঁসমার্কা নারিকেল তেল গানের দোলা, গানে গানে গন্ধরাজ সুগন্ধি কেশতেল, লক্ষীবিলাস হারবাল কেশতেল জলসাঘর, বোম্বে সুইটস চিপস আনন্দ সারাক্ষণ, লায়ন হাসপাতাল লটারি সঙ্গীতমালা, অভিযাত্রী সুরবিহার’ এরকম অনেক বিজ্ঞাপন তরঙ্গের অনুষ্ঠানে তিনি কণ্ঠ দিতেন। ‘গন্ধরাজ সুগন্ধি কেশতেল’ এর বিজ্ঞাপন তরঙ্গে তিনিসহ সহ-উপস্থাপনা করতেন মিতা গোমেজ। অনুষ্ঠানে চলচ্চিত্রের প্রচারের পাশাপাশি শ্রোতাদের অনুরোধের গান প্রচার করতেন, চিঠি পড়তেন, শ্রোতাদের পাঠানো কবিতা আবৃত্তি করতেন। মুক্তি প্রতীক্ষিত নতুন ছবির গান, সংলাপ প্রচার করা হত অন্যান্য অনুষ্ঠানগুলোতে। ঐ প্রচারণা তখন কী যে ব্যাপকভাবে কাজে লাগত সেটা একমাত্র তখনকার দর্শকরাই জানে।

তিনি অসংখ্য অভিনয়শিল্পী ও পরিচালকদের উপাধি দিয়েছেন প্রথমবারের মতো। তাঁর হাত ধরেই সেগুলো পরিচিতি পেয়েছে। অসংখ্য উপাধির মধ্যে কয়েকটা বলা যায়-
শাবানা – বিউটিকুইন
সোহেল রানা – ড্যাসিং হিরো
ফারুক – সুপারস্টার
ববিতা – ইন্টারন্যাশনাল ট্যালেন্ট
কবরী – চার্মিং
উজ্জ্বল – মেগাস্টার
এ জে মিন্টু – মাস্টারমেকার
ইবনে মিজান – গোল্ডেন জুবিলি ডিরেক্টর

১৯৯১ সালে নিজের বিজ্ঞাপনী সংস্থা ‘ভাইব্রেশন টু’ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর বেশিরভাগ বিজ্ঞাপন প্রচার করা হত এ প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে। আবৃত্তিকার হিসেবেও তাঁর সুনাম আছে।

১৯৯৯ সালের পর অশ্লীলতা শুরু হলে তিনি আর নিয়মিত সেভাবে হতে পারেননি। তিনি মনে করতেন তাঁর কণ্ঠে ছবির প্রচার হয়ে দর্শক সিনেমাহলে গিয়ে অশ্লীল ছবি দেখবে এটা হতে পারে না। তবে অশ্লীলতার পর বা মাঝামাঝি ভালো কিছু ছবির প্রচারণা তিনি করেছেন রেডিওতে। যেমন – হৃদয়ের কথা, চাচ্চু, না বোলো না।

নাজমুল হুসাইন অভিনয়ও করেছেন কিছু ছবিতে। যেমন – মহানগর, যন্ত্রণা, সাহেব, অশান্তি, জামিন নাই, বর্তমান, আব্বাজান, ইতিহাস ইত্যাদি। তিনি নিজেকে অভিনেতা হিসেবে ‘নাথিং’ মনে করেন। এটা অবশ্যই তাঁর বিনয়। তাঁর অভিনয় ন্যাচারাল ছিল। ‘জামিন নাই’ ছবিতে কলেজ ফাংশনে শাবনূর ও মাসুদ শেখের মধ্যে উপস্থাপনার কাজ করেন তিনি। বিজ্ঞাপনের কণ্ঠের মতোই ছিল সেটি। চমৎকার। ‘যন্ত্রণা’ ছবিতে সরকারি আমলার ভূমিকায় ছিলেন। ‘ইতিহাস’ ছবিতে কাজী মারুফকে আইনি জটিলতায় ফাঁসিয়ে দেন তিনি। অসৎ পুলিশ অফিসারের চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেছেন। ‘বর্তমান’ ছবিতে অসৎ মিজু আহমেদের কথায় চলতেন।

এতবড় ক্যারিয়ারেও তিনি বাংলাদেশ বেতারের হীরক জয়ন্তীতে মূল্যায়ন পাননি। কার্ড পাঠিয়ে দায়িত্ব সারা হয়েছিল। যেখানে তিনি উচ্চতর কোনো সম্মান পেতে পারতেন। এটা নিয়ে তাঁর আক্ষেপ আছে। অবশ্য এদেশে গুণীর কদর যে হয় না জানা কথা।

একজন নাজমুল হুসাইন ‘কণ্ঠরাজ’ পরিচয়ে দেশের চলচ্চিত্রপ্রেমী দর্শকের মাঝে চিরকাল শ্রদ্ধার জায়গায় থাকবেন। তাঁর চিরচেনা কণ্ঠের জাদুতে দর্শক তাঁকে মনে রাখবেন। দৈনন্দিন জীবনে তাঁর কথার সুরেই আমরা কাছে-দূরে সবাইকে বলতে পারি ‘ভালো থাকা হয় যেন!’

বি. দ্র. ব্যক্তিগত বিশ্লেষণ ও স্মৃতি থেকে নেয়া তথ্য বাদে লেখাটি তৈরি করতে ইউটিউবে ‘আমার ছবি’-তে প্রচারিত নাজমুল হুসাইনের ইন্টারভিউ ও গুগল থেকে প্রাপ্ত ইন্টারভিউ, তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে।


মন্তব্য করুন