Select Page

কলকাতা-বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনার ফিল্ম এবং উহার ভবিষ্যত

কলকাতা-বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনার ফিল্ম এবং উহার ভবিষ্যত

shakib_khan_srabonty_shikari

পীযুষ সাহা নামের কলকাতার এক পরিচালক ও প্রযোজক কারুনিউজ২৪ নামক অনলাইন পত্রিকায় এক স্বাক্ষাতকার দিছেন।[১] লোকটা বেশ সোজা সাপ্টা কথা বলেন বলে মনে হইল। তার কথাবার্তায় সাম্প্রতিককালের কলকাতা-বাংলাদেশ যৌথ পরিচালনার ফিল্ম এবং এর ভবিষ্যত নিয়া অনেক কিছু বুঝা যেতে পারে। শাকিব-শ্রাবন্তী আর জিৎ-ফারিয়ার ফিল্মের ট্রেইলার দেখতে দেখতে ভাবার মত কিছু না পাইলে যাতে অল্প স্বল্প ভাবতে পারেন তাই কয়েকটা পয়েন্ট তুইলা ধরলাম। পয়েন্টগুলা পীযুষ সাহার স্বাক্ষাৎকার থেকেই নেয়া।

আসলে আমাদের ওখানে তো বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি, তামিল, তেলেগু সব মিলে গেছে। আমরা হিন্দি, ইংরেজি, বাংলা সব মিলিয়েই কথা বলি বেশি। কিন্তু এখানে আসলে পিউর বাংলাটা পাওয়া যায়। এটা হচ্ছে সবচেয়ে বড় কথা।

অর্থাৎ কলকাতায় বাংলা ভাষাটাই ভারতমাতার হিন্দির চাপে হারিয়ে যাচ্ছে। ছফা তার এক স্বাক্ষাৎকারে[২] বলেছিলেন, ভারতের ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখতে এটা খুব দরকার, কলকাতার বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিরে দমাইয়া রাখার। ইন্ডিয়ার অন্যান্য প্রদেশের চাইতে কলকাতার শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদরা দিল্লির আধিপত্যের গুণগান করে বেশি। অন্য প্রদেশগুলা এরকম করে না কারণ তাদের ভাষা সংস্কৃতি সঙ্গে শিকড়ের সম্পর্ক, কলকাতার এইটা নেই। এর কারণ হিসেবে ছফা উল্লেখ করেছেন কলকাতা ছিল কলোনিলাইজেশনের প্রথম ডিচ।

আর আমাদের সব কম্পিটিশন তো হিন্দি সিনেমার সাথে। আমাদের সালমান, হৃতিকদের সাথে প্রতিযোগিতা করতে হয়। একই সাথে হলে আসে।

এখানে বুঝা গেল হিন্দির তথা বলিউডের চাপে কলকাতার ইন্ডাস্ট্রি মৃতপ্রায়। বলিউডের ফিল্মের সাথে নিশ্চয়ই আর্ট ফিল্ম আর নকল তামিল ফিল্ম নিয়া ঠিকে থাকা যায় না।

ভারতবর্ষে ১০টা ভাষায় সিনেমা বানানো হয়। ওদের বাজেট যখন একশ কোটি, দুশো কোটি, তিনশ কোটি সেখানে আমাদের বাজেট কমছে। কারণ যুগের সাথে আমরা তাল মেলাতে পারি না।

এখানে বুঝা গেল বাজেটও কম। ফলে মানসম্মত ফিল্ম বানাইয়া বলিউডের এবং ইন্ডিয়ার অন্যান্য ইন্ড্রাস্ট্রির লগে কলকাতা পাল্লা দিতে পারছে না।

আজকে ১৬ কোটি লোক বাংলাদেশে, আমাদের ১১ কোটি লোক। সারা পৃথিবীতে প্রায় ৩০ কোটি বাংলা ভাষাভাষী আছি।

খেয়াল করেন হিসাব, বাংলাদেশের ষোলকোটি এখন টার্গেট। বাঙালি বিদেশিরা এইসব বাংলা ফিল্ম কি দেখবে? হলিউড বলিউড থুইয়া? না। তাই টার্গেট মূলত এই ষোলকোটি।

রুনা লায়লার গান ঘরে ঘরে চলতো না! এখনো চলে! জেমসের গান চলে নি! রাজ্জাক সাহেব একের পর এক সিনেমা করেন নি! যার ডিমান্ড আছে, ইন্ডিয়া তাকে তুলে নিয়ে আসে।

হুম্মম। ভারতমাতা ডিমান্ড থাকলে কিন্তু তুইলা নিবে। তাই ডিমান্ড তৈরি করতে হবে যাতে ভারতমাতা নেয় আমাদের শিল্পীদের। এইটা কীরকম সাম্রাজ্যবাদী আর আভিজাত্যবাদী কথা বুঝা যায়? যেন ভারত ডিমান্ড তৈরি হলে তুইলা নিবে এই আশায় আমাদের এইখানে শিল্পীরা তৈরি হবেন। যদি এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়, তাইলে আমাদের নয়া নয়া শিল্পীরা কিন্তু ভারতের ডিমান্ডে নিজেদের তৈয়ার করতে লাগবেন। তখন আবার তাদের দোষ দিয়েন না।

jeet-badsha-the-don

আসলে কলকাতায় মাড়োয়ারি প্রডিউসার ঢুকে গেছে। মাড়োয়ারিরা করে কি, ধু ধু মরুভূমিতে গিয়ে ১০০/২০০ একর জমি কিনে পেলে। বাঙালিরা তখন বলে ব্যটা মাওরা ভূত! কোথায় জমি কিনলো! দু বছর পর দেখা যায় সেখানে ইন্টারন্যাশনাল হাইওয়ে রোড যাচ্ছে। ততদিনে এক লাখ টাকার জমি ৪ লাখ হয়ে গেছে। বাঙ্গালী তখন ধারদেনা করে চার কাঠা জমি কিনে সেখানে। ব্রিটিশরা বলে গেছে, যাহা ভি নেহি গায়া রেল গাড়ি, ওহা ভি গায়া মাড়োয়ারি।

– এখানে বুঝা গেল মাড়োয়ারিদের ব্যবসা বুদ্ধি এবং কলকাতায় তাদের ঢুকে যাওয়ার কথা। এরা বাঙালি সংস্কৃতির সাথে সম্পর্কহীন তামিল স্টাইলের ফিল্ম বানাইতেছেন। তবে মাড়োয়ারিদের ব্যবসা বুদ্ধি আমার ভালো লেগেছে। আই লাইক মাড়োয়ারি।

দেখো জাজ মাড়োয়ারিদের সাথে ব্যবসা করছে। তোমরা বলছো সব বড় বড় ফ্লপ! তাহলে তারা কেন করছে! তারা কি বোকা! কখনই না। তারা তাদের মতো সিনেমা বানিয়ে বানিয়ে লোকজনের নেশা করিয়ে দেবে। লোকজন অভ্যস্ত হয়ে যাবে। তখন আর কেউ ছোটখাটো প্রডিউসারের ভুলভাল সিনেমা দেখবে না। ওদের পলিসিটা এই মূহূর্তের না। ওরা গাছটা পোতে ৩ বছর পর ফল খেতে। আর বাঙালিরা গাছ পুতে পরদিন পাতার ফাঁকে ফল খোঁজে। বাঙালি ফুল হওয়া গাছের ফুল ছিড়তে ভালবাসে। গাছটা লাগিয়ে ফুল ফোটাতে জানে না। আর বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি হচ্ছে তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ।

এইটাতে পরিষ্কার মাড়োয়ারিদের বাংলাদেশের ফিল্মে টেকা ঢালার কারণ। এট লাস্ট তাইলে আমরা একটা মাড়োয়ারি ফিল্ম ইন্ড্রাস্ট্রি পাইতেছি? তখন তো আমাদের ভুমি থেকে নিজস্ব কোন ফিল্ম বাইর হইবে না, যেইটা আমাদের গল্প। রুচি চেঞ্জ হইলে সেইটা তো আমাদের পছন্দ আর হবে না। ম্যাড়ম্যাড়ে লাগবে। তখন কি আমাদের কোন জহির রায়হান বা তার চাইতে বড় পরিচালক তৈরি হবে? নাকি আমরা ধইরাই নিছি এমন কোন প্রতিভাবান নির্মাতা আমাদের আর আসবে না। আমাদের নিজস্ব প্রযুক্তিতে তেল-গ্যাস তোলার ক্ষমতা হবে না, অতএব বিদেশিদের দিয়া দেও সব। তেল গ্যাসের ক্ষেত্রে যা হইতেছে ফিল্মেও এমন। কিন্তু মনে রাইখেন এইটা খালি পয়সার বিষয় না। সাংস্কৃতিক ভাবে যে আপনার দেশের লোকরে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে তার বিরুদ্ধে দেশের সরকারও দাঁড়াতে পারবে না। সেই কবে এইটা ম্যাকায়াভেলি বুঝাইয়া গেছিলেন দ্য প্রিন্সে।

৩০ জুন, ২০১৬

[১] ইন্ডিয়ান সিনেমা তো দু বছর ধরে ঢুকছে, তাহলে ১২০০ হল থেকে ২০০ হলে কেন নেমে আসলে তোমরা! -পীযুষ সাহা – লিংক

[২]  ভারতীয় পরিচয়ের ভার বহন করতে গিয়ে পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের জাতি পরিচয়টা মুছে যাচ্ছে। এসব বুঝতে পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের একটু সময় লাগবে। দিল্লি-হিন্দির আধিপত্যের গুণগান কোলকাতার শিল্পী-সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবীদরা যত করে থাকেন, ভারতের অন্য কোন শহরে এ চিত্র আপনি পাবেন না। কারণ অন্য শহরের মানুষের নিজস্ব ভাষা সংস্কৃতির সঙ্গে যে শিকড়ের সম্পর্ক আছে কোলকাতায় তা নেই। তাই হিন্দির সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য কোলকাতাতেই বেশি মেনে নিচ্ছে। আবার কোলকাতার সাহিত্যিক বা রাজনৈতিক নেতারা ঢাকায় এলে, তাদের বাংলা ভাষা প্রেম আকাশ স্পর্শ করে। এই দ্বিচারিতা কোলকাতার মজ্জাগত। কারণ কোলকাতা শহরটা হচ্ছে কলোনাইজেশনের প্রথম ডিচ। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের গোড়াপত্তন হয় ঐ শহরে। সেই কারণে সাম্রাজ্যবাদী প্রভাব কলকাতা শহরে যতোটা কাজ করে ভারতবর্ষের অন্য কোনও শহরে তা করে না। কোলকাতার লোক ভারত প্রেমিক, বিশ্বপ্রেমিক হতে পারেন, ভারতকে, বিশ্বকে বুকে মাথায় নিতে পারেন। কিন্তু বাংলার সমগ্র অন্তজ জনগোষ্ঠীকে নিয়ে বাংলা ও বাঙালির জন্যে কতটা কি করতে পারবেন, এ বিষয়ে আমার গভীর সংশয় আছে। -আহমদ ছফা – লিংক

: মুরাদুল ইসলামের ব্লগ – muradulislam.me


মন্তব্য করুন