চম্পাকাহিনী
‘রাণী রাণী রাণী রাণী বৌরাণী
বৌরাণী প্রিন্ট শাড়ি বৌরাণী
রাণী রাণী রাণী রাণী বৌরাণী
বৌরাণী প্রিন্ট শাড়ি বৌরাণী’
নব্বই দশকে টিভি সেটের সামনে বসে তখনকার দর্শক এই বিজ্ঞাপন দেখেনি এমনটা পাওয়া যাবে না। বিজ্ঞাপনটি ‘বৌরাণী প্রিন্ট শাড়ি’-র এবং মডেল ছিল চম্পা। তিনি বাংলাদেশী চলচ্চিত্রের অন্যতম উল্লেখযোগ্য অভিনেত্রী। তাঁর নিজস্ব সফল ক্যারিয়ার আছে। দাপটের সাথেই কাজ করেছেন নিজের সময়টাতে।
মূলনাম গুলশান আরা আখতার। যশোরে জন্ম ১৯৬০ সালের ৫ জানুয়ারি। বাবা সরকারি চাকুরীজীবী মা ডাক্তার। দুই বড়বোন সুচন্দা ও ববিতা-ও চলচ্চিত্রের মানুষ। তাছাড়া রিয়াজ, মৌসুমী, ওমর সানী পারিবারিক আত্মীয়। স্বামী শহীদুল ইসলাম খান, মেয়ের নাম ইশা।
১৯৮১ সালে বিটিভিতে ‘ডুবসাঁতার’ নাটকের মাধ্যমে ক্যারিয়ার শুরু। ১৯৮৬ সালে শিবলি সাদিক পরিচালিত ‘তিনকন্যা’ ছবির মাধ্যমে চলচ্চিত্রে ক্যারিয়ার শুরু হয়।
উল্লেখযোগ্য ছবি : তিনকন্যা, ভেজা চোখ, পালাবি কোথায়, পদ্মানদীর মাঝি, সহযাত্রী, নীতিবান, বিরহ ব্যথা, নিষ্পাপ, দেশপ্রেমিক, অবুঝ হৃদয়, শঙ্খনীল কারাগার, আবার অরণ্যে, অচেনা, ভাই, শেষ সংগ্রাম, অন্যজীবন, উত্তরের খেপ, বন্ধন, মীরজাফর, ঘৃণা, আবদার, বিশ্বাস অবিশ্বাস, ত্যাগ, গর্জন, ববি, কান্দ কেন মন, অন্ধ প্রেম, খলনায়ক, ডিস্কো ড্যান্সার, নয়া লায়লা নয়া মজনু, জানের বাজি, প্রেমের স্মৃতি, বিশাল আক্রমণ, ভয়ঙ্কর বিষু, আরো ভালোবাসব তোমায়, জটিল প্রেম।
চম্পা প্রথমত নায়িকা তারপর অভিনেত্রী। কথাটা হয়তো অন্যরকম শোনাচ্ছে। এর পেছনে কিছু কথা আছে। অনেকে ভাবেন নায়িকা হওয়া বুঝি সহজ কিন্তু অভিনেত্রী হওয়া কঠিন। আসলে কোনোটাই সহজ না। হুট করে কেউ নায়িকা হতে পারে না। বাণিজ্যিক ছবির জন্য নায়িকা হওয়াটা প্রথমত জরুরি। অভিনয় করতে করতে পরিপক্বতা আসার পরে একটা সময় অভিনেত্রী হয়ে ওঠার পদ্ধতি শুরু হয়।
নায়িকা হিশাবে চম্পা অনবদ্য। নিজের সময়ের অন্যতম সেরা গ্ল্যামারাস নায়িকা ছিলেন তিনি। আবেদনময়ী একটা ইমেজ ছিল। হাঁটার ভঙ্গিতে নিজস্ব স্টাইল ছিল। নায়িকা চম্পার দাপট কেমন ছিল সে সম্পর্কে কিছু উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। চম্পার অন্যতম সেরা লেডি অ্যাকশন ছবি ‘শেষ সংগ্রাম।’ এ ছবিতে চম্পা ছিল মূল চরিত্র ছবির। নায়ক মান্না থাকলেও ছবির গল্প আবর্তিত হয়েছে চম্পাকে ঘিরে। ছবিতে চম্পা তাঁর পরিবারের মানুষদের হত্যার জন্য প্রতিশোধপর্বে অসাধারণ পারফর্ম করেছেন। ‘সাক্ষাৎ’ ছবিতে মান্নার ভীতু চরিত্রটি চম্পার মাধ্যমে সাহসী হয়ে ওঠে। ‘খলনায়ক’ ছবিতেও মান্নার হিরোইজমের আগে চম্পা ছিল দাপুটে পুলিশ ইন্সপেক্টর। নায়িকা চম্পা এভাবে বেশকিছু ছবিতে নিজের চরিত্রের গভীরতা রেখে ছবি করেছেন। চম্পার কস্টিউম সিলেকশন জমকালো হয়। আধুনিক সাজসজ্জায় তাঁকে দেখা যেত এবং সে ধরনের ইমেজে খুব সহজেই মানিয়ে যেত।
জুটিতে চম্পা ছিলেন খুবই সফল। মান্না-চম্পা, ইলিয়াস কাঞ্চন-চম্পা, জাফর ইকবাল-চম্পা, রুবেল-চম্পা জুটিগুলো সফল। তাঁকে সবগুলো জুটিতেই গর্জিয়াস লাগত। মান্না চম্পা-র ‘শেষ সংগ্রাম, শেষ খেলা, আমার জান, খলনায়ক, প্রেম দিওয়ানা, ডিসকো ড্যানসার, অন্ধ প্রেম’ ছবিগুলো উপভোগ্য। ‘প্রেম দিওয়ানা’ ছবিটি ১৯৯৩ সালের খুবই আলোচিত বাণিজ্যিক ছবি ছিল। ইলিয়াস কাঞ্চন-চম্পার ‘ভেজা চোখ, গোলাপি এখন ঢাকায়, ত্যাগ, অচেনা, আবদার, নয়া লায়লা নয়া মজনু, তিনকন্যা, বন্ধন’ জাফর ইকবাল-চম্পার ‘অবুঝ হৃদয়, গর্জন’, রুবেল-চম্পার ‘ঘৃণা, মীরজাফর’ সবগুলো ছবিই দুর্দান্ত। বাণিজ্যিক ছবির মধ্যে ‘ভেজা চোখ’ তাঁর অন্যতম সেরা ছবি। স্যুটিং-এর সময় ধারালো শিংযুক্ত মহিষের কবলে পড়েছিলেন এবং নায়কের মতোই বাস্তবে মহিষের সাথে লড়ে চম্পাকে রক্ষা করে ছবির নায়ক কাঞ্চন। চম্পা তাঁর ছবিতে নায়কের আধিপত্যের ভেতরেও নিজের ইমেজে ছবির অন্যতম প্রাণ হয়ে উঠতে পারতেন।
অভিনেত্রী চম্পা সেই নায়িকা চম্পার ভেতর দিয়েই ধীরে ধীরে গঠিত হয়ে ওঠেন। অভিনেত্রী চম্পার সবচেয়ে বড় কাজ ‘পদ্মানদীর মাঝি’ ছবিটি। এই এক ছবিই তাকে অমর করে রাখার জন্য যথেষ্ট। অনেকের বদ্ধমূল ধারণা উপন্যাস বা ছবিটিতে কপিলাই সব কিন্তু সেটা ঠিক নয়। মালা চরিত্রটি বাস্তবসম্মত অনেক অনেক বেশি। সবচেয়ে বড় কথা নিয়তি মেনে নেয়া একটি অসহায় চরিত্র মালা যার কোনো ভবিষ্যৎ নেই। এরকম একটি চরিত্রে চম্পা নিজের অভিনয়দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বৈকুণ্ঠের উইল’ উপন্যাস থেকে নেয়া ‘বিরহ ব্যথা’ ছবিতেও চম্পার অভিনয় প্রশংসিত হয়েছিল। ‘পালাবি কোথায়’ খুবই উল্লেখযোগ্য ছবি। ঝাড়ুদারের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। ‘চরি, কিলিং, লঞ্চ’ এই ভুল ইংরেজি শব্দের উচ্চারণে কমেডি উপহার দিয়েছেন। ‘উত্তরের খেপ’ তাঁর অভিনয়শক্তির অন্যতম সেরা ছবি। শওকত আলী-র উপন্যাস থেকে ছবিটি নির্মিত। স্বামী মান্না-র সাথে ডিভোর্সের পর দ্বিতীয় বিয়েতে সুখী হয় না চম্পা। মান্না-চম্পার করুণ জীবনকাহিনী শুরু হয়। ‘অন্যজীবন’ ছবিটিও অনবদ্য। এছাড়া টলিউডে ‘আবার অরণ্যে’ ছবিতে অভিনয় করেন চম্পা, সন্দ্বীপ রায়ের ‘টার্গেট’ ছবিতেও নির্বাচিত হন। ‘আবার অরণ্যে’ ছবি করার সময় বলিউডি অভিনেত্রী টাবু-র সাথে বন্ধুত্ব হয় চম্পা-র। তাঁদের মধ্যে পারিবারিক যোগাযোগ আছে। হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস থেকে নির্মিত ‘শঙ্খনীল কারাগার’ ছবিতে চম্পা অন্যতম প্রধান চরিত্রে ছিলেন।
চম্পা গানের মধ্যে গ্ল্যামারাস সবচেয়ে বেশি। আবেদনময়ীও। তাঁর অনেক জনপ্রিয় গান আছে। যেমন :
প্রিয়া আমার প্রিয়া আজ চিঠি দিয়েছে – ভেজা চোখ
আজ রাত সারারাত জেগে থাকব – নীতিবান
পৃথিবীর যত সুখ – সহযাত্রী
তারায় করে ঝিকিমিকি – গোলাপি এখন ঢাকায়
সুন্দর সন্ধ্যায় এ গান দিলাম উপহার – শেষ খেলা
কে তুমি বলো মায়াবিনী – শেষ সংগ্রাম
আর যাব না এমেরিকা – অচেনা
আমার চোখের মাঝে তুমি – খলনায়ক
আমি এক ডিসকো ড্যানসার – ডিসকো ড্যান্সার
আমি তোমার মনের মতো কিনা – গর্জন
চন্দ্র সূর্য সবই আছে – প্রেম দিওয়ানা
নিন্দার কাঁটা যদি না বিঁধিল পায়ে – অন্ধ প্রেম
যদি প্রেমের আরেক নাম জীবন হয় – বডিগার্ড
ঠিক ঠিক ঠিক মনে রবে এই দিনরাত – ত্যাগ
নীল আকাশের নিচে সবুজ সবুজ ঘাসে – জানের বাজি
আমার লাইন হইয়া যায় আঁকাবাঁকা – কান্দ কেন মন
চম্পা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান ৫ বার :
শ্রেষ্ঠ অভিনয়শিল্পী – পদ্মানদীর মাঝি (১৯৯৩), অন্যজীবন (১৯৯৫), উত্তরের খেপ (২০০০), পাশ্ব অভিনেত্রী – শাস্তি (২০০৫), চন্দ্রগ্রহণ (২০০৮)।
টিভিতে অভিনীত কিছু নাটক/টেলিফিল্ম – বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ, সেদিন তারাবানু আজ তারাবানু, বাজপাখি, সেকেন্ড ইনিংস, অতঃপর ভালোবাসা, এখানে নগর, আকাশ বাড়িয়ে দাও, অপয়া, সাহেবজাদীর কালো নেকাব ইত্যাদি।
চম্পা সফল দেশীয় চলচ্চিত্র তারকা। তাঁর ছবির মধ্যে বাণিজ্যিক ও এক্সপেরিমেন্টাল দুই ধরনের কাজই আছে। চম্পাকে দেখে শিখতে পারে ভবিষ্যৎ তারকারা।