Select Page

চলচ্চিত্র বিষয়ক এজেন্ডাটা কী?

চলচ্চিত্র বিষয়ক এজেন্ডাটা কী?

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নিয়ে শিক্ষিতদের আলাপ-আলোচনা দীর্ঘদিন ধরে মোটামুটি তিনটা সম্পর্কিত বিষয়বস্তু নিয়ে ঘুরপাক খাচ্ছিল। আরও সূক্ষ্মভাবে বললে বিষয়বস্তুর চেয়ে মোড্যালিটি বা ভঙ্গি বলাই ঠিক হবে। সেগুলো হচ্ছে: রুচির ঘোষণা, চলচ্চিত্র-শৈলীর জ্ঞাত-ভাব, বিদেশি ছায়াছবির ভোগের প্রণালী। এভাবে না-লিখে বা লিখলেও বিশেষ অপরিমিত হতো না যে তিনটা কথিত মোড্যালিটি হচ্ছে – রুচি, শৈলী, মেলা ফিল্ম দেখা; এবং মুখ্যত সবক্ষেত্রেই বাহাদুরি। যেহেতু বাহাদুরিটাকে কমবেশি ঢাকার ও বাংলাদেশের মধ্যবিত্তীয় সকল কলাচর্চা ও বুদ্ধিবৃত্তির মধ্যে দেখতে পাই আমি, আলাদা করে সেটাতে মনোযোগ দিচ্ছি না।

 “হলে আর যাওয়া যায় না” কিংবা “এসব ছবি আর দেখা যায় না” এই বিলাপমূলক অভিশংসন ৮০ দশকের গোড়াতেই ছিল। চলচ্চিত্রের বাইরে বিশদ ‘সংস্কৃতি’ নিয়ে যারা বিলাপ করতেন, তারাও ‘অপসংস্কৃতি’ খুঁজে বেড়াতেন জিনস থেকে গিটার অবধি, টি-শার্ট থেকে ব্যান্ডগান অবধি। রেডিও-টেলিভিশনের মোড়কে পাওয়া ‘পল্লীগীতি’র বাইরে আর কোনও লোকশাস্ত্রীয় উপাদানকেও বরদাশত করতে অনিচ্ছুক ছিলেন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত।

এন্ড্রু কিশোর পর্যন্ত জীবিতকালে একবার একটা পুরস্কার পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলেছিলেন ‘এখন শিক্ষিতরাও আমাকে কদর করলেন’ বা এই জাতীয় কিছু। আরও পরে হয়তো গায়ে উল্কি-কাটা কিংবা (নারীদের) একাধিক কান ফুটানি ইত্যাদিও ‘অপসংস্কৃতি’ বা ‘অরুচিকর’ বলে সাব্যস্ত হয়েছে। ফলে মধ্যবিত্ত শ্রেণির রুচির বিষয়টা আমি চিরকালই তদন্ত করবার মনোভাব নিয়ে ছিলাম; আর বিষয়টা নেহায়েত চলচ্চিত্রের মধ্যেই পরিসীমিত ছিল না কখনো।

পরিস্থিতিটা ঘনীভূত হয় যখন ‘অশ্লীলতা’ বিষয়ক আলাপ মারাত্মক চর্চিত হতে শুরু করল। সেটা ৯০ দশকের শেষভাগ। অনেকগুলো ছায়াছবির হালহকিকত দুঃশ্চিন্তা করার মতোই বটে। কিন্তু কারণগুলো তদন্ত করার বদলে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের চলচ্চিত্রপ্রেমীরা অংশ নিলেন ‘অশ্লীলতা’ নিয়ে। এই বিষয়ক আলাপ-আলোচনা ও তৎপরতা এতোটাই পরাক্রমশালী হয়ে পড়েছিল যে, চলচ্চিত্র পরিচালকদের কেউ কেউ নিজেদের এই ‘সংগ্রামে’ শামিল করলেন। আর প্রযোজক-অভিনেতাদের বড় বড় চক্রও সভা-সমিতি করতে শুরু করলেন। কয়েকজন নায়িকা কালো তালিকাভুক্ত হলেন। আমি মনে করতে পারি না একটি স্বরও, ওই সময়ের বাংলাদেশে, যিনি একটা উৎপাদন-ব্যবস্থা হিসাবে চলচ্চিত্র নিয়ে কোনও একটি প্রতিপাদ্য বা বক্তব্য হাজির করেছিলেন তখন। আমার পেশাগত বিরক্তি ও সংক্ষোভ এই পর্যায়ের গিয়েছিল যে, আমি ২০০১ সালে একটি শ্লেষাত্মক রচনা লিখি এই প্রবণতা নিয়ে। সেটি দৈনিক সংবাদ প্রকাশ করার মহত্ত্ব দেখায়। আমি অবশ্যই চলমান বিতর্কটিতে ঘৃত সংযোগের ঝুঁকি সমেত থাকলাম কয়েক বছর, যেহেতু আমার অবস্থানটিকে ওই স্থূল রুচির প্রহরী আলাপগুলোর মধ্যে “অশ্লীলতা-পন্থী” বা এফডিসিপন্থী হিসাবে দেখা হচ্ছিল।

চলচ্চিত্র বিষয়ক মধ্যবিত্ত ওই হাহাকারের ধরন এবং অতি অবশ্যই “অশ্লীলতার” বিরুদ্ধে তাদের “যুদ্ধে”র সময়কাল প্রাযুক্তিক দিক থেকে অতিশয় চমকপ্রদ। ঠিক ওই সময়টাতেই এই শ্রেণির ঘরে ঘরে স্যাটেলাইট চ্যানেল। তারও আগের বছরগুলোতে ভিসিআরের মালিকানার তুলনায় এটা আরও সাশ্রয়ী বটে, বৈশ্বিক ছায়াছবি সেবন করার ক্ষেত্রে সুলভও বটে। অন্যদিকে, যেসব নির্মাতা কয়েক বছর আগেই “ভিডিও চলচ্চিত্র” অভিধা নিয়ে হাসিতামাশা করেছিলেন (একজন টার্গেট অবশ্যই চলচ্চিত্রকার শামীম আখতার), তারাই “ডিজিটাল চলচ্চিত্র” বানানোতে আগ্রহ বোধ করেছেন। আমার বলার উদ্দেশ্য তাদের চিন্তার দ্বৈততা তুলে ধরা নয়, বরং নতুন প্রাযুক্তিক পরিবেশ কী কী ধরনের নতুন সম্ভাবনা ও সংঘর্ষ তৈরি করেছিল সেটার দিকে নজর দেয়া।

আমার বিবেচনায় বদলমান পরিস্থিতিতে সব থেকে বড় আলোচনার দাবিদার হয়ে উঠছিল দুইটা বিষয়: খোদ সিনেমা হলগুলোর বিলোপ এবং চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা তথা এফডিসির আলুথালু একটা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়া। শেষোক্তটা শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মনোযোগ একদমই পায়নি, অরুচি-উৎপাদক হিসাবে গালমন্দ ছাড়া। লক্ষণীয় যে পাবলিক তামাম প্রতিষ্ঠানই এই দায়সারা মনোভাবের শিকার হয়েছে। স্বাস্থ্যখাত থেকে শিক্ষাখাত; মফস্বলের সরকারি হাসপাতাল থেকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত সবাই রাডারের বাইরে চলে গেছে রুচির দাবিদার এই নাগরিক শ্রেণির। ফলে এফডিসি বিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গিকে আমি খুব আচমকা দেখি না। সিনেমা হলগুলোর লাগাতার বিলোপ নিয়ে কিছু আহাজারি লক্ষ্য করা গেছে। কিন্তু শেষতক ওই আহাজারিই, যা সিনেপ্লেক্সগুলোর নগর-বিকাশে সন্তোষ প্রকাশ করে থেমেছে, কোনও রাজনৈতিক-অর্থশাস্ত্রীয় বিশ্লেষণ ছাড়াই।

বাস্তবতা হচ্ছে এই যে, সাম্প্রতিক পুঁজিবাদে একটা সিনেমা হল মানে হলও কম করেও ৩০-৪০টা দোকানের পজিশন-মানি, মাসিক ভাড়া মিলে এক নতুন মুদ্রা-সম্ভাবনা। হলের জায়গায় দোকান বানালেই যা মালিকেরা নগদ পেতে পারেন। সেটাই ঘটেছে। সিনেমা হলগুলোর মালিকদের জন্য একটা লোকসানের বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এটা বোঝার জন্য অর্থশাস্ত্র বা গণিতশাস্ত্র কোনটাতেই পণ্ডিত হওয়া লাগে না। কিন্তু বিষয়গুলো নন্দন-সচেতন সিনেমা-বোদ্ধারা আলাপ বা দরকষাকষির এজেন্ডা বানাননি।

সিনেমা হলের টিকে থাকতে হলে রাষ্ট্রীয় প্রণোদনা লাগবে। আমি খাম্বা দিয়ে “জাতীয় সংস্কৃতি” দাঁড় করিয়ে রাখার পক্ষপাতী লোক নই। রিকশা বা হারিকেনকে, ঢেঁকি কিংবা কুলাকে, জাদুঘরে রেখে “আমাদের” বলে প্রশস্তিগীতিতে কোনোরকম উৎসাহ আমি পাই না। স্ব-সংস্কৃতি সম্পূর্ণ ভিন্ন জিজ্ঞাসা আমার জন্য যেখানে জাগরুক জনপদ কেন্দ্রীয়। কিন্তু সিনেমা হল এগুলোর মত নয়; সিনেমা হল একটা সাবেক ‘কম্যুনিটি পরিসর’ও বটে। বিভিন্ন ছোট শহরে নানাবিধ মানুষের যৌথ ব্যবহারের একটা জায়গা। কিন্তু সাধারণ বুদ্ধি বলে যে, যারা পার্ক বা স্কুল মাঠ রাখতে পারেননি, তারা সিনেমা হলও পারবেন না, যদিও গুণগত ভাবে এই পরিসরটা কিছু ভিন্ন ভোক্তার কিছু খরচ করতে হয় বলে।

নতুন প্রযুক্তি আর সাইবার-পরিমণ্ডলের কারণে চলচ্চিত্র-উৎপাদন ও চলচ্চিত্র সেবনের বিষয়টা আগাপাছতলা বদলে গেছে। সেটা নিছক চলচ্চিত্র সেবনের বদল নয়, সামগ্রিক দৃশ্যগত সামগ্রী সেবনেরই বদল। দৃশ্যের সঙ্গে (সাধারণভাবে) মানুষের সম্পর্কের এই বদলে চলচ্চিত্র বিষয়ক উপলব্ধির মৌলিক ও গুণগত বদল ঘটেছে। এই বদলটা গভীরভাবে মনোগত, জগদ্দর্শনের কারিগরির বদল। এটা ‘ধ্রুপদী’র মৃত্যুর মত। কোনও চলচ্চিত্রই আর গুরুতর ‘আছর’ ফেলতে পারবে না। এটা নিখিল বিশ্বের সামগ্রিক বাণী ও অর্থ উৎপাদনের বিপুলতার একটা আবশ্যিক ফলাফল। ঠিক যেমন একটা বিপ্লবী দলের আচমকা-লিফলেট সেই স্পর্ধা তৈরি করবে না, যেমনটা করতে পারত (যদি কল্পনাও করি) যখন অল্পস্বল্প কাগজ ছাপা হতো। চলচ্চিত্রের সেই “সামর্থ্য” গত হয়েছে দৃশ্যের স্ফীতির কারণেই। মুশকিল হচ্ছে দুটো। এক, এই অমোঘ সত্যটি ক্লাসিসিস্ট, আবেগপ্রবণ চলচ্চিত্র বোদ্ধারা প্রায়শই উপলব্ধি করেন না। দুই, এই অমোঘ সত্য সত্ত্বেও সিনেমা হল সামাজিক মিলনায়তন। এর বিলোপ আরামদায়ক নয়, বিপজ্জনক। এটি যৌথ পরিসর কমে থাকার, দোকানপাট বাড়তে থাকার বাণিজ্যিক আউটলেট। প্রসঙ্গটি চলচ্চিত্র বিষয়ক যতখানি, ততখানিই মনুষ্যসমাজ বিষয়ক, রাষ্ট্রীয় কর্তব্য বিষয়ক।     

প্রাইভেট বাস মালিকদের স্বার্থে সামনে যারা বাংলাদেশ রেলওয়ে রক্ষা করতে পারেননি, তারা অবশ্যই সিনেমা হলও বাঁচাতে পারবেন না। তারা একমাত্র সরকার নন; সংস্কৃতি সেবী মধ্যবিত্ত আলোচক ও নীতিনির্ধারকও। বলছিলাম প্রণোদনার কথা। কিছু প্রোপাগান্ডা শোনা যায় অমুক তমুক হবে বলে। আমার আশঙ্কা অনেক দেরি হয়ে গেছে। রোগীটা বেঁচে থাকাকালীনই ‘লাইফ সাপোর্ট’টা দরকার ছিল। আমার এও আশঙ্কা উৎসাহী লোকজন সিনেমা হল রক্ষা করার একটা প্রজেক্টও বানিয়ে ফেলবেন অতি সত্বর, যেহেতু আওয়াজটা কানে এসেছে। কিন্তু সেটা সনাতনী সিনেমা হলগুলোর আয়ুবৃদ্ধিতে কাজ করবে বলে আমার আর মনে হয় না, প্রজেক্টের নিজস্ব আয়ু ছাড়া। মুঠোফোনে ছায়াছবি দর্শন, আর মুঠোভর্তি বাদাম নিয়ে প্রেক্ষাগৃহে দল বেঁধে ঢোকা সাংঘর্ষিক নাগরিক-চর্চা নয়। ঠিক যেমন বাড়ির শাওয়ারে গোসল করে পরের দিন রিসোর্টের সুইমিং পুলে (বা চৌবাচ্চা) ঝাঁপাঝাঁপি করতে আইনগত বা চৈত্তিক কোনও বাধা থাকে না।

ঝামেলাটা অন্যত্র এবং সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। এই যেমন উদাহরণটা দেবার সময় আমি সুইমিং চৌবাচ্চাই বললাম, পুকুর নয়, তার কারণ সামাজিক পুকুরের ক্রমাগত কমতে থাকা। মহানগরে শূন্য, অন্যত্র বিলীয়মান। উদাহরণটা দেবার সময় আমার কল্পনাশক্তিকে বাধ্য রাখতে হয়েছে চলতি বাস্তবতার স্বার্থে, বাণিজ্য তন্ত্রের কারণে। চলচ্চিত্র সামাজিক ভোগের সামগ্রী থাকবে কিনা সেটা একটা রাজনীতিগত মীমাংসার বিষয়। চলচ্চিত্রের নন্দন বা শৈলী বিষয়ক আলাপ-আলোচনাগুলো বিদ্যমান বাস্তবতায় শিবের গীত লাগে আমার!

/লেখাটি ঢাকা পোস্টে পূর্ব প্রকাশিত


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

মানস চৌধুরী

লেখক, শিক্ষক ও নৃবিজ্ঞানী

মন্তব্য করুন