Select Page

চার দশকের ইতিহাস

চার দশকের ইতিহাস

অনেকদিন বাদে বিশাল কলেবরে কোনো ছবি দেখা গেল। দীর্ঘ চার দশকের ইতিহাসকে এক সুতোয় বেঁধে নামকরা পরিচালক তানভীর মোকাম্মেল নির্মাণ করেছেন ‘রূপসা নদীর বাঁকে’ নামের অসাধারণ ছবি। ২০২০ সালের সেরা ছবি এটাই।

তানভীর মোকাম্মেল নামটির সাথে তাঁর নিজস্ব পরিচিতি ফুটে ওঠে। সাহিত্যভিত্তিক কিংবা মৌলিক গল্পের ছবিতে তিনি ইতোমধ্যে ব্র্যান্ডে পরিণত হয়েছেন। বেশ বিরতি দিয়েই নির্মাণ করলেন ‘রূপসা নদীর বাঁকে’ ছবিটি। সুনির্মিত ছবি বলতে যা বোঝায় এটা তাই হয়েছে।

নদীকেন্দ্রিক ছবি আমাদের অনেক আছে। নদীকে কেন্দ্র করে উপন্যাসও রচিত হয়েছে বাংলা সাহিত্যে। নদী তীরবর্তী মানুষের স্বপ্ন, সম্ভাবনা, শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন, নতুন ইতিহাস গড়ে বেঁচে থাকার নতুন স্বপ্ন তৈরি এসব নিয়ে ছবি হয়েছে যেমন-‘চিত্রা নদীর পারে, নদীর নাম মধুমতি, ধীরে বহে মেঘনা’ ইত্যাদি। এ তালিকার নতুন সংযোজন ‘রূপসা নদীর বাঁকে।’
রূপসার তীরে ঘটে যাওয়া দীর্ঘ একটি সময়ের আখ্যান হয়ে উঠেছে এ ছবি।

পরিচালক তানভীর মোকাম্মেল ছবিটিকে একটা সুপরিকল্পিত পদ্ধতিতে পরিবেশন করেছেন। তাঁর বাস্তবতাবোধ, পরিমিতিবোধ কোথাও বাধা পায়নি এত সচেতনভাবে তিনি ছবিটি নির্মাণ করেছেন। চার দশকের ইতিহাসকে তিনি পর্যায়ক্রমে দেখিয়েছেন এবং ইতিহাস বলার মধ্যে ক্রম ঠিক রেখেছেন।

চার দশকের ইতিহাসকে ছবিতে পরিবেশন করা হয়েছে এভাবে :
দেশবিভাগের আগের সময়
দেশবিভাগের পরের সময়
ছয় দফা দাবির সময়
মুক্তিযুদ্ধের সময়
দেশবিভাগের আগের সময়টাতে ১৯৪৭ পূর্ববর্তী পূর্ববঙ্গের মানুষের বাঁচার সংগ্রাম দেখানো হয়েছে। জমিদারপ্রথার শিকার কৃষকের নিজের অধিকার আদায় করা এ অংশের ইতিহাস ছিল ছবিতে। ডাকাতিয়া বিলে কৃষকের জমি রক্ষায় বাঁধ নির্মাণের সময় ‘প্রজাবন্ধী বাঁধ’ নামটা অন্যরকম দর্শন দেখায় এবং জন হেনরির গান পরিচালকের সচেতন ইতিহাসবোধকে তুলে ধরেছে। ‘ভাগরে ভাগ কৃষকের দুই ভাগ’ এ শ্লোগানটিও কৃষক অধিকারের জন্য দারুণ ছিল। দেশবিভাগের পরের সময়টাতে হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্ব, মতাদর্শের সমস্যা, সাংঘর্ষিক অবস্থা, জন্মভূমি ত্যাগের বাস্তবতা দেখানো হয়েছে। ‘হিন্দু মুসলমান ভাই ভাই/একসাথে থাকতে চাই’ এ শ্লোগানটিও অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে দেখিয়েছে। ছয় দফার সময়টাতে দেশজুড়ে নতুন সময়ের উত্থান, ছাত্র আন্দোলনের নতুন দিক পরিবর্তন, দ্বি-জাতি তত্ত্বের বিরুদ্ধে গণমানুষের অবস্থান দেখানো হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের শুরুর সময়টা পর্যন্ত দেখানো হয়েছে শেষ অংশে।

চার দশকের এ ইতিহাসকে দেখানো হয়েছে ছবির প্রধান চরিত্র মানবদাকে ঘিরে। এ চরিত্রে অভিনয় করেছেন যথাক্রমে জাহিদ হাসান শোভন এবং খায়রুল আলম সবুজ। এ চরিত্রটি মার্কসবাদী সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের কর্ণধার ছবিতে। তাঁর মাধ্যমে বামপন্থী আন্দোলন শুরু হয় কৃষক বিদ্রোহ থেকে এবং বিভিন্ন ইতিহাস পেরিয়ে তাঁর জীবনের একটা শীর্ষ সময়ে গিয়ে শেষ হয় চরিত্রটি। সমাজতন্ত্র সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ভুল মনোভাবকে মানবদা চরিত্রটি এভাবে খণ্ডন করে :
– আপনাগো সমাজতন্ত্র ভালো দর্শন কিন্তু এটা তো ইহুদি নাসারাদের দর্শন আমরা কিভাবে মুসলমানরা এটা মানি বলেন?
– দেখেন রোগ হলে ডাক্তারের কাছে ওষুধ নিয়েই তো খান তখন কি দেখেন ওষুধটা ইহুদি না মুসলমান বানাইছে! তেমনি সমাজে রোগ হইলে ওষুধ লাগবে সেটা কোথাকার বিষয় না।
একদম সাদা চোখে দেখা বাস্তবতায় আমরা যেভাবে চলাফেরা করি জাহিদ হাসান শোভন ঠিক সেভাবেই অভিনয় করে গেছেন। তাঁর অভিনয় সো মাচ ন্যাচারাল এবং খায়রুল আলম সবুজও তাঁর সহজাত অভিনয়গুণ দেখিয়েছেন।

তানভীর মোকাম্মেল ছবিটিকে এমনভাবে বেঁধেছেন যে এখানে একাধিক দর্শন থাকা সত্ত্বেও দেশাত্মবোধকে সেন্টার পয়েন্ট করে রেখেছেন। এটি সম্ভবত তাঁর নিজের দর্শনেরই বহিঃপ্রকাশ ছিল ছবিতে।

ছবির কলেবর বিশাল। প্রধান চরিত্র, পার্শ্ব চরিত্রসহ অন্যান্য চরিত্রগুলোও ন্যাচারাল অভিনয় করেছে। সাধারণত দেখা যায় সাধারণ মানুষকে দিয়ে ভালো অভিনয় করানো সম্ভব হয় না কিন্তু এ ছবিতে সেটা নেই। পথচারীসহ ভালো অভিনয় করেছে। ন্যাচারালিটি ধরে রেখে এত বড় কলেবরের কাজ করা সত্যিই চ্যালেঞ্জিং এবং ছবিটি সেটা করতে পেরেছে। নাজিবা বাশার গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে খুব ভালো অভিনয় করেছে, তার ভালো সম্ভাবনা আছে চলচ্চিত্রে, মিলি বাশার, খায়রুল বাশারসহ আরো পরিচিত কিছু অভিনয়শিল্পী আছে ছবিতে সবাই যার যার জায়গায় নিজেদের কাজটা ঠিকভাবে করেছেন।
ছবিতে গান ব্যবহার হয়েছে অনেক। দেশের গান, রবীন্দ্রসঙ্গীত, আসরের গান, সিচুয়েশন ডিমান্ডেও গান ব্যবহৃত হয়েছে। কবিতা ব্যবহৃত হয়েছে। রবার্ট ফ্রস্টের বিখ্যাত কবিতা ‘stopping by woods on a snowy evening’ খুব চমৎকারভাবে একটা টাচি সিচুয়েশনে ব্যবহৃত হয়েছে। সাংস্কৃতিক ব্যাপারটা ছবিতে দারুণভাবে এসেছে।

ছবিতে ক্যামেরা যেন কথা বলেছে। রূপসী বাংলা তানভীর মোকাম্মেলের ক্যামেরায় রূপসী হয়েই ধরা দিয়েছে। সিনেমাটোগ্রাফি, কালার গ্রেডিং, সাউন্ড সব দেখার মতো। টেকনিক্যালি পরিচ্ছন্ন ছবি বলতে যা বোঝায় ঠিক তাই।

‘রূপসা নদীর বাঁকে’ দেশাত্মবোধকে যেভাবে দরদ দিয়ে উপস্থাপন করেছে এ ধরনের ছবি কেন যে আরো হয় না সেটা প্রশ্ন থেকেই যায়। আর একজন তানভীর মোকাম্মেলের আরো দেয়ার আছে দেশের চলচ্চিত্রে এ দাবিও করা যায় নিঃসন্দেহে।

রেটিং – ৯/১০


মন্তব্য করুন