Select Page

জননী: যুদ্ধশিশুদের প্রশ্নবিদ্ধ করলেন নীপা

janani

চলতি বছর ২৩ মে শিল্পকলার চিত্রশালা মিলনায়তনে হয়ে গেলো মুক্তিযুদ্ধে নারীনির্যাতন-ভিত্তিক স্বল্পদৈর্ঘ্যরে চলচ্চিত্র ‘জননী’র প্রিমিয়ার শো। ছবিটি নির্মাণ করেছেন এই প্রজন্মের পরিচালক রওশন আরা নীপা। গল্প ও চিত্রনাট্য তাঁরই রচিত। প্রিমিয়ার শোতে উপস্থীত ছিলেন কৃষি মন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, তথ্য মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকসহ আরো অনেকেই। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের ‘বীরাঙ্গনা’ নয় ‘মুক্তিযোদ্ধা’ বা ‘বীরমাতা’ বলার দাবি নিয়ে উপস্থীত ছিলেন বীরমাতা সূর্য বেগম।

ছবির গল্প একজন বীরাঙ্গনা নারীকে নিয়ে। প্রটাগনিস্ট মনিরা মুক্তিসংগ্রামে জড়িত। পাকসেনারা তার বাবা-মাকে নির্মমভাবে হত্যা করে তাকে গৃহবন্দী করে পুরো নয় মাস ধরে ধর্ষণ করে। ফলে মনিরা সন্তান-সম্ভ্যবা হয়। পাকসেনা খুরশীদ চায়, এই সন্তান পৃথিবীর আলোয় আসুক। কারণ তার বিশ্বাস, এই শিশুই হবে বাংলার বুকে আসল পাক-প্রতিনিধি। কিন্তু মনিরা কিছুতেই মেনে নিতে পারে না এই সন্তানকে। দেশ যখন স্বাধীন হল ঠিক সেই মুহূর্তে সে শিশুটিকে নিজগর্ভেই হত্যা করে এবং এই হত্যাকে সে উদযাপন করে।

এখানে, শিশুটিতে বাঁচিয়ে তোলা আর না তোলাই ছিল তার আর ক্যাপ্টেন খুরশীদের ভেতরকার যুদ্ধ। এই যুদ্ধে শেষপর্যন্ত মনিরাই জয়ী। কিন্তু প্রকৃত অর্থেই মনিরা জয়ী কি-না এই প্রশ্ন থেকে যায় মনিরার শিশু-হত্যার পক্ষে যুক্তি থেকে। মনিরা জানায়, সে একটা পাকস্তানী কীটকে হত্যা করেছে। এই কীটের বাংলার জলে-হাওয়ায় বেড়ে উঠার কোনো অধিকার নেই। এই কীট ভবিষ্যতে বাংলাকে আরো কলঙ্কিত করবে। মনিরার এই মোটাদাগের সিদ্ধান্ত প্রশ্নবিদ্ধ করেছে সকল যুদ্ধশিশুকে, যারা বাংলাদেশে থেকে কিংবা প্রবাশে থেকে নানাভাবে দেশগড়বার কাজে লিপ্ত আছেন। স্বাধীনতার এই তিতাল্লিশ বছর পরে যে সকল যুদ্ধশিশু বেঁচে আছেন এবং যারা বাংলাদেশকে মনেপ্রাণে ভালোবাসেন তাদের জন্য মনিরার এই সিদ্ধান্ত খুবই হতাশাজনক। একটা কথা ভীষণ সত্যি : নব্য রাজাকার যারা হয়েছেন, যারা মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করেছেন, তাদের দলে একটাও যুদ্ধশিশু নেই। যুদ্ধশিশুরা কোনোভাবেই পাকিস্তানী পরিচয় বহন করেননি। তাহলে, কীসের ভিত্তিতে স্বাধীনতার এত বছর পরে এসে পরিচালক রওশন আরা নীপা যুদ্ধশিশুদের এমন মোটা দাগে উড়িয়ে দিলেন? এখন, অন্তত এই পর্যায়ে এসে, যুদ্ধশিশুদের অস্বীকার করা মানেই বীরাঙ্গনা মায়েদের অস্বীকার করা। তাই কি করতে চেয়েছেন নীপা ? নাকি না-বুঝেই তিনি এমন একটা জটিল সিদ্ধান্ত দিয়ে দিলেন? এমন প্রশ্ন থেকেই যায়।

আর একটা বিষয় বলা প্রয়োজন : পাকিস্তানী আর্মি ধর্ষণ করলো বলে একজন নারী গর্ভবতী হলেন। এরপর ঐ নারী ১০ মাস নিজের রক্ত দিয়ে একটু একটু করে সন্তানকে নির্মাণ করলেন, নিজের বুকের দুধ খাইয়ে বড় করে তুললেন। এখন প্রশ্ন হলো, ঐ সন্তানের কার পরিচয়ে পরিচিত হওয়া উচিৎ? সন্তানের ওপর কার অধিকার বেশি? অবশ্যই মার। তাহলে ঐ সন্তানকে বীরাঙ্গনা বা মুক্তিযোদ্ধা মার সন্তান হিসেবে না দেখে আমরা ‘পাকিস্তানী কীট’ হিসেবে দেখছি কেন? নীপার এই বক্তব্যকে আমি কোনোভাবেই গ্রহণ করতে পারিনি।

মুক্তিযুদ্ধে বীরাঙ্গনা নারীদের মনস্তত্ত¡ বা মানসিক ট্রমাকে তিনি একালের প্রেক্ষাপটে তুলে আনতে পারতেন। মুক্তিযুদ্ধে নারীরা নির্মমভাবে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, সেটা আমরা জানি। এবং মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবিগুলোতে আমরা এতকাল তাই দেখে এসেছি। কিন্তু নির্যাতিত নারীদের মানসিক অবস্থা নিয়ে ইন ডেপথ কোনো মুভি নির্মাণ করা হয়নি। যেটি আজকের প্রেক্ষাপটে এসে আরো বেশি দরকারী হয়ে উঠেছে। ভবিষ্যতে যে নীপা করবেন, সে প্রত্যাশা আমরা অবশ্যই করতে পারি। মেকিং নিয়ে তেমন কিছু বলার নেই। কারণ, স্বল্প বাজেটের এই ছবিতে ক্যামেরার কাজ খানিকটা উৎরে গেলেও নির্মাণশৈলি সবমিলিয়ে অতি মধ্যমানের। তবে, আমাদের দেশে নারীনির্মাতা তুলনামূলকভাবে বেশ কম। তাই নীপার এই উজানপথের যাত্রায় আমার শুভকামনা রইল।


৩ টি মন্তব্য

  1. একটা মা ধর্ষণের শিকার হয়ে গর্ভবতী হওয়ার পর তার গর্ভের সন্তান দুনিয়ায় আসবে নাকি না আসবে সেটা মায়ের একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। ধর্ষণের শিকার হয়ে সে সন্তান স্বাভাবিকভাবে মানুষ করার অর্থ হলো সে ধর্ষণকে মেনে নিলো। আর এটা নিশ্চয়ই দুনিয়ার কোন মা-ই মেনে নেবেন না। একজন সাধারণ নারী কখনই চাইবেন না তার সন্তান তার ধর্ষিতা হওয়ার পর দুনিয়ায় আসুক। বর্তমান সময়ের যে কোন নারী ধর্ষিতা হয়ে গর্ভবতী হওয়ার পর তার হাতে যে কয়টা অপশন থাকে সেগুলো হলো ১. ধর্ষণকারীকে যেভাবেই স্বামী হিসেবে গ্রহণ করা ২. গর্ভপাত ঘটানো ৩. আত্মহত্যা করা। এই সিনেমার গল্পের জননীর জন্য প্রথম অপশনটা ছিল অসম্ভব। তৃতীয় অপশনটা ছিল ভীরুতার প্রতীক, আর দ্বিতীয় অপশনটা তৎকালীন সময়ে (মেডিক্যাল আনুসঙ্গিক কারণে) কঠিন হলেও যথাযথ সময়ে করা সম্ভব ছিল। পাকিস্তানী ঘাতকরা আমাদের দেশের মায়েদের গর্ভের সন্তানদেরকেও ছাড় দেয় নি। এমতাবস্থায় ওদের জাতের সন্তানকে দুনিয়ায় আনা আমাদের জন্যও কাম্য নয়। তবে একথা অনস্বীকার্য যে যুদ্ধশিশুদের অগ্রাহ্য করা ঠিক নয়। তবে এই সিনেমায় যা দেখানো হয়েছে সেটা ঐ মায়ের একান্তই ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। তার জায়গায় আমি আপনি থাকলে হয়তো অন্য যুক্তিতে অন্য কিছু করতাম, কিন্তু জননী তা-ই করেছেন যেটা তার যুক্তিতে উচিৎ বলে মনে হয়েছে।

  2. Moulovi Nezam

    তবে এই সিনেমায় যা দেখানো হয়েছে সেটা ঐ মায়ের একান্তই ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত।

    সিনেমায় যখন কোন উপসংহার টানা হয় তখন সেটা সম্ভবত আর “ব্যক্তিগত” থাকে না, সামগ্রিক কোন বক্তব্য দেয়ার চেষ্টা করা হয়।

মন্তব্য করুন